Views Bangladesh Logo

টেকসই উন্নয়নের জন্য ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধির বিকল্প নেই

M A  Khaleque

এম এ খালেক

প্রতিটি রাষ্ট্রেরই লক্ষ্য থাকে কীভাবে দ্রুত এবং টেকসই উন্নয়ন অর্জন করা যায়। সীমিত সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে সর্বাধিক জনকল্যাণ সাধন এবং দেশকে উন্নয়নের শিখরে নিয়ে যাওয়াই একটি সরকারের মূল দায়িত্ব। যে সরকার এই দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করে সমাজের সর্বস্তরে উন্নয়নের ছোঁয়া পৌঁছে দিতে পারে, সেই সরকারই জনকল্যাণমূলক সরকার হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে। অনেকের মনে এমন একটি ধারণা আছে যে, শুধু অর্থনৈতিক উন্নয়ন সাধন করা গেলেই উন্নয়ন অর্জনের মূল লক্ষ্য বাস্তবায়িত হবে; কিন্তু এই ধারণা মোটেও ঠিক নয়। কারণ উন্নয়ন বলতে শুধু একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নকে বুঝায় না। উন্নয়ন হচ্ছে একটি সামগ্রিক ধারণা। অর্থনৈতিক উন্নয়ন কোনো দেশের উন্নয়নের একটি মাত্র সূচক কিন্তু এটাই সামগ্রিক উন্নয়নসূচক নয়। অর্থাৎ অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি অন্যান্য উন্নয়নসূচকে ইতিবাচক অগ্রগতি সাধন করা না গেলে তাকে কোনোভাবেই সুষম উন্নয়ন বলা যাবে না। অর্থনৈতিক উন্নয়ন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ; কিন্তু এটাই উন্নয়নের একমাত্র মাপকাঠি নয়।

অর্থনৈতিক উন্নয়নের সুফল যদি ন্যায্যতার ভিত্তিতে সাধারণ মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দেয়া না যায়, তাহলে সেই উন্নয়ন কখনোই জনকল্যাণমূলক এবং সুষম উন্নয়ন বলা যাবে না। অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি শিক্ষা, স্বাস্থ্য, চিকিৎসা, জনস্বাস্থ্য, সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠাসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে যদি সমতাভিত্তিক উন্নয়ন অর্জন করা না যায়, তাহলে সেটা কখনোই প্রকৃত উন্নয়ন বলা যাবে না। যে কোনো উন্নয়নের জন্য বিনিয়োগের প্রয়োজন। বিনিয়োগ ব্যতীত উন্নয়ন অর্জন করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। প্রকৃতি প্রদত্ত সম্পদ অনুসন্ধান এবং আহরণের জন্য যেমন বিনিয়োগের প্রয়োজন আছে। তেমনি কোনো নতুন পণ্য বা সেবা উৎপাদনের জন্যও বিনিয়োগ দরকার হয়। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলো সব সময়ই বিনিয়োগযোগ্য তহবিল বা সম্পদের স্বল্পতায় ভোগে। চাইলেই এসব দেশ উন্নয়নের জন্য অর্থ ব্যয় করতে পারে না। তাই স্থানীয় ও বিদেশি নানা সূত্র থেকে বিনিয়োগ আহরণ করতে হয়। প্রকৃতি অধিকাংশ দেশকেই বিপুল সম্পদ ভান্ডার দিয়েছেন; কিন্তু সেই সম্পদ অনুসন্ধান এবং আহরণের জন্য যে বিনিয়োগের প্রয়োজন হয়, তা বেশির ভাগ দেশেরই থাকে না।

তাই তাদের বিদেশি বিনিয়োগের ওপর নির্ভর করতে হয়। বিনিয়োগযোগ্য সম্পদ আহরণ এবং তার সঠিক ব্যবহারের জন্য এমন সরকারকে রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসীন থাকতে হয় জনগণের কাছে যার দায়বদ্ধতা আছে এবং সরকার চাইলেই বিনিয়োগযোগ্য সম্পদের অপব্যবহার করতে না পারে। কোনো দেশে যদি জনবিচ্ছিন্ন সরকার ক্ষমতায় থাকে, তাহলে তাদের মাঝে জনকল্যাণে কাজ করার কোনো বাধ্যবাধকতা থাকে না। জনকল্যাণবিরোধী সরকারের আমলে সাধারণত উন্নয়নের নামে ব্যক্তি এবং গোষ্ঠীস্বার্থ উদ্ধারের প্রচেষ্টা লক্ষ্য করা যায়। স্বৈরাচারি এবং জনবিচ্ছিন্ন সরকারের চরিত্র হচ্ছে উন্নয়ন প্রচেষ্টাকে দৃশ্যমান করা। সেটা টেকসই উন্নয়ন হোক আর ভঙ্গুর উন্নয়নই হোক। জনবিচ্ছিন্ন সরকারের উন্নয়নের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তারা উৎপাদনশীল খাতের চেয়ে অবকাঠামোগত খাতে বেশি বিনিয়োগ করে এবং উন্নয়নের চেষ্টা চালায়। অবকাঠামোগত উন্নয়নের সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো এর মাধ্যমে জনগণকে বোঝানো যায় যে, দেশে উন্নয়ন হচ্ছে; কিন্তু অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, অবকাঠামোগত উন্নয়নের উদ্দেশ্য হচ্ছে উৎপাদনশীল ব্যক্তি খাতকে সহায়তা করা।

রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ সাধারণত উৎপাদনশীল খাতে কাজে লাগে না। যেমন পদ্মা সেতু উদ্বোধনকালে বলা হয়েছিল এই সেতু নির্মাণের ফলে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ১ থেকে দেড় শতাংশ বৃদ্ধি পাবে; কিন্তু এটা কীভাবে বৃদ্ধি পাবে, তা বলা হয়নি। পদ্মা সেতু আপনা-আপনি জিডিপি বৃদ্ধিতে যেমন কোনো অবদান রাখতে পারবে না। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় এলাকায় যদি ব্যাপক শিল্পায়ন হয়, তাহলে পরিবহন সুবিধা প্রদানের মাধ্যমে পদ্মা সেতু অবদান রাখতে পারবে; কিন্তু আমরা কি বিনিয়োগের জন্য কার্যকর এবং উন্নত পরিবেশ তৈরি করতে পেরেছি? তাহলে কীভাবে জিডিপি প্রবৃদ্ধি কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় বৃদ্ধি পাবে? গণবিরোধী সরকারের আমলে শিক্ষা, স্বাস্থ্য- এসব খাত নিদারুণভাবে উপেক্ষিত হয়। এর বিপরীতে অবকাঠামোগত খাতের উন্নয়নের প্রতি অত্যধিক গুরুত্ব দেয়া হয়। একইভাবে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে সম্পদ আহরণের পরিবর্তে বিদেশি ঋণের ওপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীল হয়ে পড়ে।

বাংলাদেশের উন্নয়ন কৌশল পর্যালোচনা করলে আমরা কি দেখতে পাই? সাম্প্রতিক সময়, বিশেষ করে বিগত সাড়ে ১৫ বছর আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে অবকাঠামোগত খাতে যে উন্নয়ন হয়েছে বিগত ৫৩ বছরে অন্য কোনো সরকারের আমলে তা হয়নি। একই সঙ্গে এই সময়ে উন্নয়নের নামে যে অর্থ লোপাট ও দুর্নীতি করা হয়েছে তাও নজিরবিহীন। উন্নয়নের নামে অবকাঠামোগত উন্নয়ন দৃশ্যমান করা হয়েছে। এর বিপরীতে বিপুল পরিমাণ অর্থ নানা প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আত্মসাৎ করা হয়েছে। এই অঞ্চলে অবকাঠামোগত খাতে সবচেয়ে বেশি হয়েছে বিগত সাড়ে ১৫ বছরে। এর আগে জাতীয় পার্টির ৯ বছরের শাসনামলে অবকাঠামোগত খাতে ব্যাপক উন্নতি হয়েছে। তারও আগে পাকিস্তান আমলে জেনারেল আইয়ুব খানের সময় অবকাঠামোগত খাতে ব্যাপক উন্নয়ন সাধিত হয়। আইয়ুব খানের আমলে গ্রামগঞ্জে যেসব পাকা ব্রিজ ও রাস্তা নির্মিত হয়েছে তার কিছু কিছু নজির এখনো দৃশ্যমান। এমনকি রাজধানীর বড় বড় অনেক স্থাপনা আইয়ুব খানের আমলে তৈরি। স্বেচ্ছাচার সরকারের আমলে অবকাঠামোগত উন্নয়ন বেশি হয়। কারণ অবকাঠামোগত উন্নয়ন দৃশ্যমান হয় এবং এগুলো তৈরির ক্ষেত্রে অর্থ আত্মসাতের সুযোগ বেশি থাকে।

জনবিরোধী সরকার সাধারণত অভ্যন্তরীণ সূত্র থেকে সম্পদ আহরণের মতো কষ্টসাধ্য কাজটি করতে আগ্রহী হয় না। তারা বিদেশি নানা সূত্র থেকে ঋণ গ্রহণ করার মাধ্যমে অর্থ চাহিদা পূরণ করে থাকে। এই ঋণের দায়ভার শেষ পর্যন্ত সাধারণ মানুষকেই বহন করতে হয়। যেসব অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে সম্পদ আহরণের পরিবর্তে বিদেশি ঋণ দিয়ে উন্নয়ন সাধনের প্রচেষ্টায় রত থাকে, তাদের ট্যাক্স-জিডিপি রেশিও তুলনামূলকভাবে কম হয়। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে শ্রীলঙ্কা এবং বাংলাদেশের ট্যাক্স-জিডিপি রেশিও সবচেয়ে কম। শ্রীলঙ্কার ট্যাক্স-জিডিপি রেশিও হচ্ছে ৭ দশমিক ৪ শতাংশ। অর্থাৎ দেশটি প্রতি বছর যে পরিমাণ ট্যাক্স আহরণ করে তার পরিমাণ মোট জিডিপির ৭ দশমিক ৪ শতাংশ। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ট্যাক্স-জিডিপি রেশিও হচ্ছে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ। অথচ জাপানের ট্যাক্স-জিডিপি রেশিও হচ্ছে ৩৪ দশমিক ১ শতাংশ। দক্ষিণ কোরিয়ার ক্ষেত্রে এটা ৩২ শতাংশ। চীনের ক্ষেত্রে এটা ২০ দশমিক ১ শতাংশ। এমনকি পাকিস্তানের ট্যাক্স-জিডিপি রেশিও হচ্ছে ১০ শতাংশ এবং ভুটানের ১১ দশমিক ৩ শতাংশ। যেসব দেশের ট্যাক্স-জিডিপি রেশিও তুলনামূলকভাবে কম, তারা যদি উন্নয়ন করতে চায়, তাহলে বিদেশি ঋণ গ্রহণ ব্যতীত কোনো উপায় থাকে না।

বাংলাদেশ সাম্প্রতিক সময়ে যে উন্নয়ন কার্যক্রম সম্পাদন করেছে, তা মূলত বৈদেশিক ঋণনির্ভর। বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ গত ডিসেম্বর মাসে প্রথমবারের মতো ১০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার অতিক্রম করে গেছে। এ সময় জনগণের মাথাপিছু বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৫৯২ মার্কিন ডলার বা ৬৫ হাজার টাকা। গত বছরের ডিসেম্বর মাসে ব্যক্তি খাত এবং রাষ্ট্রীয় খাত মিলে গৃহীত বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ছিল ১০০ দশমিক ৬৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা স্থানীয় মুদ্রায় টাকার অঙ্কে ১১ লাখ ৭ হাজার ৪০ কোটি টাকা। ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশ বৈদেশিক ঋণের কিস্তি বাবদ ৩২৮ কোটি মার্কিন ডলার পরিশোধ করেছে। চলতি অর্থবছরে এটা ৪০২ কোটি মার্কিন ডলারে উন্নীত হবে। ২০২৯-৩০ অর্থবছরে বৈদেশিক ঋণের কিস্তি বাবদ ৫১৫ কোটি মার্কিন ডলার পরিশোধ করতে হবে। আগামীতে এমন দিন আসবে, যখন নতুন করে ঋণ নিয়ে পুরোনো ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে হবে। ঋণের অর্থ লুটপাট করতে বিবেকে বাধে না বা কোনো ধরনের প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হতে হয় না।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর অর্থনীতির বাস্তব অবস্থা জানার জন্য শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি গঠন করেছিল। সেই কমিটি তাদের প্রাথমিক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, গত সাড়ে ১৫ বছরে বাংলাদেশ থেকে উন্নয়নের নামে যেসব প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে, সেখান থেকে ২৪ হাজার কোটি মার্কিন ডলার সমপরিমাণ অর্থ বিদেশে পাচার করা হয়েছে। শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির একজন সদস্য বলেছেন, দেশ থেকে যে পরিমাণ অর্থ বিদেশে পাচার হয়েছে তার চেয়ে অনেক বেশি অর্থ বিদেশে লেনদেন হয়েছে। অর্থাৎ এসব অর্থ দেশে আসেনি। বিদেশেই পরস্পর যোগসাজশে লেনদেন হয়েছে। গণবিরোধী সরকারের একটি সাধারণ প্রবণতা হচ্ছে তারা উৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগ করে না বা উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য তেমন কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করে না। তারা কার্যত শুধু অবকাঠামোগত খাতের উন্নয়নে ব্যাপৃত থাকে। একটি উদাহরণ দেয়া যেতে পারে।

বাংলাদেশ গ্যাস সম্পদে সমৃদ্ধ; কিন্তু বর্তমানে প্রমাণিত যে মজুত রয়েছে গ্যাসের তা দিয়ে আগামী ১২ থেকে ১৫ বছর চলতে পারে। এর মধ্যে নতুন গ্যাস ক্ষেত্রে আবিষ্কৃত না হলে বাংলাদেশ গ্যাসশূন্য হয়ে যেতে পারে। সরকার ইচ্ছে করলে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সারা দেশব্যাপী গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেন; কিন্তু তা না করে বিদেশ থেকে তরলীকৃত গ্যাস (এলএনজি) আমদানির প্রতিই সরকারের বেশি আগ্রহ। স্থানীয়ভাবে গ্যাস পাওয়া গেলে যে খরচে গ্যাস সরবরাহ করা সম্ভব হবে, তার চেয়ে অন্তত ৫ গুণ বেশি অর্থ ব্যয় করে বিদেশ থেকে এলএনজি আমদানি করতে হচ্ছে। তারপরও এলএনজি আমদানিতে আগ্রহের কারণ হচ্ছে এখানে কমিশন ভোগ করার সুযোগ রয়েছে। বাংলাদেশের ভূ-অভ্যন্তরে যে বিপুল পরিমাণ সম্পদ রয়েছে তা উত্তোলনের চেয়ে আমদানির মাধ্যমে চাহিদা পূরণের প্রতিই আমাদের বেশি আগ্রহ।

প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণ অথবা নতুন করে কোনো পণ্য বা সেবা উদ্ভাবন ও আহরণের জন্য বিনিয়োগের প্রয়োজন। এ জন্য স্থানীয় এবং বিদেশি বিভিন্ন সূত্র থেকে অর্থায়ন সংগ্রহ করতে হবে। আর কোনো অর্থায়ন সংগ্রহের জন্য উপযুক্ত বিনিয়োগ পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা হচ্ছেন শীতের অতিথি পাখির মতো। অতিথি পাখি যেমন কোনো পুকুরে বা বিলে পর্যাপ্ত খাবার এবং জীবনের নিরাপত্তা না পেলে আশ্রয় গ্রহণ করে না। বিদেশি বিনিয়োগকারীরাও তেমনি কোনো দেশে পুঁজির নিরাপত্তা এবং পর্যাপ্ত পরিমাণ মুনাফার সম্ভাবনা না দেখলে বিনিয়োগে আগ্রহী হন না। বাংলাদেশ বিনিয়োগের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টিতে কতটা উৎসাহী তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। কয়েক বছর আগে বিশ্বব্যাংকের উদ্যোগে প্রণীত সর্বশেষ ‘ইজ অব ডুয়িং বিজনেস’সূচকে ১৯০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৭৬তম। এতে সহজেই অনুধাবন করা যায়, আমাদের বিনিয়োগ পরিবেশ কেমন। অতি সম্প্রতি বিশ্বব্যাংক ‘বিজনেস রেডি’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এতে ৫০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান চতুর্থ পর্যায়ে। জাপানি একটি সংস্থা বাংলাদেশে ব্যবসায়-বাণিজ্যেরত জাপানি উদ্যোক্তাদের ওপর জরিপ চালিয়ে দেখেছে জাপানি উদ্যোক্তাদের মধ্যে ৭০ শতাংশই বাংলাদেশের ব্যবসায়-বাণিজ্যের পরিবেশ নিয়ে সন্তুষ্ট নন।

আমাদের উদ্দেশ্যই যেন কীভাবে দেশটিতে ঋণনির্ভর করে উন্নয়ন সাধন করা যায়, সে প্রচেষ্টা চালানো। প্রকৃতি প্রদত্ত সম্পদ আহরণ অথবা নতুন সম্পদ সৃজন উভয় ক্ষেত্রেই পর্যাপ্ত পরিমাণ বিনিয়োগ প্রয়োজন; কিন্তু সে দিকে আমাদের কোনো মনোযোগ আছে বলে মনে হয় না। ফলে প্রতিনিয়তই আমাদের ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ সম্ভাবনা বিনষ্ট হচ্ছে। উল্লেখ্য, ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগের অর্থ হচ্ছে উৎপাদনশীল খাতে উৎপাদন বৃদ্ধি। আর রাষ্ট্রীয় খাতে বিনিয়োগের অর্থ হচ্ছে দুর্নীতি আর অনিয়মকে প্রশ্রয় দেয়া। ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ এখন আশঙ্কাজনকভাবে কমে গেছে। গত বছরের নভেম্বর মাসে ব্যক্তি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৭ দশমিক ৬৬ শতাংশ। ব্যাংক ঋণের এই প্রবৃদ্ধি ২০২১ সালের মে মাসের পর সর্বনিম্ন। এর আগে যখন ব্যাংক ঋণের সর্বোচ্চ সুদহার ৯ শতাংশে নির্ধারিত ছিল, সেই সময় এক মুদ্রানীতিতে ব্যক্তি খাতে ব্যাংক ঋণের প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল ১৪ দশমিক ১ শতাংশ। আর অর্জিত হয়েছিল ১৪ দশমিক ৭ শতাংশ। অথচ সেই সময় শিল্পে ব্যবহার্য ক্যাপিটাল মেশিনারিজ, কাঁচামাল এবং মধ্যবর্তী পণ্য আমদানি ব্যাপকভাবে কমে গিয়েছিল।

দেশের একজন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ বলেন,বাংলাদেশের মতো বিকাশমান অর্থনীতিতে ব্যক্তি খাতে জিডিপির অন্তত ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ বিনিয়োগ হওয়া প্রয়োজন; কিন্তু গত দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগের হার জিডিপির ২২-২৩ শতাংশে ওঠানামা করছে। সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনাকলে জিডিপির ২৮ শতাংশ ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল; কিন্তু সেই লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়নি। চলতি অর্থবছরের বাজেটে ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগের হার জিডিপির ২৭ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত আছে, যা কোনোভাবেই অর্জনযোগ্য নয়। বিভিন্ন ক্ষেত্রে যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়, প্রতিনিয়তই তা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়; কিন্তু সেই ব্যর্থতার জন্য কাউকে জবাবদিহি করতে হয় না। আমরা যদি দ্রুত এবং টেকসই উন্নয়ন অর্জন করতে চাই, তাহলে ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই; কিন্তু আমরা কি তা নিয়ে ভাবছি?

এম এ খালেক: অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার ও অর্থনীতিবিষয়ক লেখক।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ