প্রিয়াঙ্কা গান্ধী বনাম বিজেপির সাম্প্রদায়িক রাজনীতি
আমরা যারা শ্রীমতী ইন্দিরা ও তার ছেলে রাজীব গান্ধীকে চোখের সামনে খুন হতে দেখেছি, তাদের কাছে রাহুল ও প্রিয়াঙ্কা গান্ধীর রাজনৈতিক সত্তার পাশাপাশি অন্য এক চেহারা দেখতে পাই। রাহুল গান্ধীর চর্চা না হয় আজ থাক। অন্য কোনোদিন না হয় বিস্তারে রাজীব সোনিয়ার ছেলেকে নিয়ে কথা হবে। আজ শুধুই পাতাজুড়ে থাক প্রিয়াঙ্কা।
ইন্দিরা গান্ধী খুন হলেন তার দেহরক্ষীদের হাতে। সে হত্যারহস্য আজও পুরোপুরি পরিষ্কার হয়নি। সাংবাদিক সাগরিকা ঘোষের একটা বই আছে শ্রীমতী গান্ধীকে নিয়ে। সেখানে অদ্ভুত কিছু বিষয় চোখে পড়ে। গুলি খেয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে যাবার পরেও কোনো অ্যাম্বুলেন্স পাওয়া যায়নি মিসেস গান্ধীকে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যাবার জন্য। অথচ তিনি তখন দেশের প্রধানমন্ত্রী।
বাড়ির গাড়িতে সনিয়া গান্ধীর কোলে মাথা রাখা অবস্থায় রক্তাক্ত ইন্দিরা গান্ধীকে ডাক্তাররা যখন দেখলেন, তখন অনেক দেরী হয়ে গেছে। গোটা বিষয়টি পড়তে পড়তে মনে হয়, শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীকে মারার পেছনে স্রেফ খালিস্তানি বিদ্রোহীদের হাত ছিল না, আরও বড় কোনো ষড়যন্ত্রের তিনি শিকার হয়েছিলেন। বাংলাদেশ লিবারেশন ওয়ারের সময় থেকেই, আমার মনে হয়, কংগ্রেস দলের মধ্যেই চরম দক্ষিণপন্থার অনুপ্রবেশ ঘটেছিল। তাদের হাত থাকতে পারে শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর হত্যার পেছনে।
প্রিয়াঙ্কা গান্ধী সম্পর্কে লিখতে গিয়ে এত কথা লিখছি এই জন্য যে, রাহুল-প্রিয়াঙ্কা নিয়ে আমাদের আজকের দক্ষিণপন্থি শাসকদের ব্যক্তি আক্রমণ যেভাবে তীব্র হচ্ছে, যত কুৎসিত ভাষায় তাদের আক্রমণ করা হচ্ছে, তা নিছক কংগ্রেসের বিরুদ্ধে নয়। এ আক্রমণ নেহরুর ভাবধারা, চিন্তা, দর্শনের সঙ্গে দক্ষিণপন্থি দর্শনের। আমরা বড় হয়েছি বামপন্থি পরিবারে। ফলে নেহেরু নিয়ে কোনদিনই আলাদা করে কোনো আবেগ অনুভব করিনি।
কিন্তু আজ বুঝতে পারছি যে নেহরুর ভারতের সঙ্গে আকাশ-পাতাল পার্থক্য হয়ে গেছে নরেন্দ্র মোদির ভারতের। আজকের ভারত বিভাজনের রাজনীতিতে বিশ্বাসী। সাম্প্রদায়িক রাজনীতি বিজেপির ইউ, এস, পি। সে দেশ গড়তে নয়। দেশের ধর্ম ও জোট নিরপেক্ষ সংবিধান ভাঙতে আগ্রহী। ফলে নেহেরু পরিবারের ইউরোপিয়ান সমাজতন্ত্র তার চক্ষুশূল। বিজেপির থিঙ্ক ট্যাঙ্ক আর এস এস জন্মলগ্ন থেকেই বহুত্ববাদী দেশের বিপক্ষে। সে চায় স্বৈরতান্ত্রিক, একদলীয় শাসনব্যবস্থা। ১৯২৫ সালে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের জন্মের পর থেকেই সে চরম সাম্প্রদায়িক। দেশভাগের আগে পরে এমন কোনো দাঙ্গা হয়নি, যেখানে আর এস এস, হিন্দু মহাসভার নাম জড়ায়নি।
১৯৪৭ সালের পর থেকে চেষ্টা করেও সেভাবে মাথা তুলতে পারেনি সাবেক জনসংঘ, অধুনা বিজেপি। এই জনসংঘ ছিল ব্রিটিশ শাসকদের অনুগত। স্বাধীনতা সংগ্রামের দিনে এদের কোথাও কোনো ভূমিকা ছিল না। ফলে আজকের ভারতে, যাদের, যে পরিবারের বিশেষ ভূমিকা ছিল তাদের অস্বীকার করাটা দক্ষিণপন্থিদের বাধ্যবাধকতা। না হলে নিজেদের ম্লান অতীতের পাশে আরও উজ্জ্বল দেখাবে গান্ধী পরিবারকে। ঠিক সেকারণেই বিজেপির তাবৎ নেতারা নির্বাচনি জনসভায় নিয়ম করে সকাল-বিকেল মৃত জহরলাল নেহেরু, ইন্দিরা গান্ধী, রাজীব গান্ধী থেকে সোনিয়া, রাহুল, প্রিয়াঙ্কা সবাইকে অত্যন্ত অশোভন ভাষায় নিন্দে করে চলেছেন।
এদেশে এই রাজনৈতিক মিথ্যাচার ও অশ্রাব্য শব্দবন্ধের জন্ম হয়েছে নিঃসন্দেহে বিজেপির হাত ধরে। ইন্দিরা গান্ধীর মৃতদেহের সামনে ছোট্ট রাহুল ও প্রিয়াঙ্কার শোকাহত চেহারা কখনো ভোলার নয়। বাবা রাজীব গান্ধী খুন হবার সময় দুজনের বয়স বেড়েছে। তখন ধীর, শান্ত ভাইবোনের মাকে আগলে রাখার ছবি আজও ভারতবাসী মনে রেখেছে। তারপর তো গঙ্গা দিয়ে অনেক জল গড়িয়েছে। প্রিয়াঙ্কা, রাহুল পরিণত হয়েছেন।
রাজনীতিতে এসেছেন খারাপ সময়ে দলের হাল ধরতে। প্রিয়াঙ্কা গান্ধীর মধ্যে কংগ্রেস কর্মী সমর্থকরা শুধু নন, অনেকেই ইন্দিরা গান্ধীর মিল পান। হাঁটা, চলা, কথাবলায়। প্রিয়াঙ্কা বাধ্য হয়ে খানিকটা বোধহয় কংগ্রেসে যোগ দিয়েছিলেন। কংগ্রেস তখন বেশ কোণঠাসা। জনমনে শ্রীমতী গান্ধীর ভাবমূর্তি তখনো উজ্জ্বল। ফলে কঠিন পরিস্থিতিতে বিষণ্ন কংগ্রেস সমর্থকরা স্বতঃস্ফূর্ত গলায় আওয়াজ তুলেছিলেন- প্রিয়াঙ্কা লাও দেশ বাঁচাও।
প্রিয়াঙ্কা এলেন। তারপরেও কংগ্রেসের সুদিন আসেনি; কিন্তু চরম দক্ষিণপন্থিদের হিংস্র আক্রমণের মধ্যেও প্রিয়াঙ্কা গান্ধীর স্তিতধী, পরিশীলিত আচরণ নিঃসন্দেহে কংগ্রেসের লাখ লাখ কর্মীকে আত্মবিশ্বাস অনেক ফিরিয়ে দিয়েছে। রাহুল গান্ধী যদি কংগ্রেসের প্রাণ হন, প্রিয়াঙ্কা তবে বিশুদ্ধ আবেগ। আমেথি এবার ধরে নিয়েছিল যে প্রিয়াঙ্কা গান্ধী প্রার্থী হবেন। যে কোনো কারণেই হোক তিনি হননি; কিন্তু আমেথির জনগণের নয়নমনি তিনিই। প্রিয়াঙ্কা গান্ধীর বৈশিষ্ট্য এটাই যে, তিনি ভীষণভাবে ঘরোয়া। পাশাপাশি চোয়াল শক্ত করা লড়াই করতে জানেন। ঠান্ডা মাথায় তিনি বিজেপির হেভিওয়েট বক্তাদের যেভাবে মোকাবিলা করেন, তাকে প্রাজ্ঞ বলে কুর্নিশ না করে পারা যায় না।
প্রিয়াঙ্কা এক দিকে আমাদের ঘরোয়া মেয়ে। অন্যদিকে কংগ্রেসের অক্সিজেন। তবে প্রথমেই বলেছি যে, দুই প্রিয়াঙ্কা গান্ধী আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। একজন প্রিয়াঙ্কা কঠিন রাজনীতিক। তার কথা স্বাভাবিকভাবেই চর্চা হয় বেশি। প্রিয়াঙ্কার আরেকটি দিক আছে, যার কথা লোকে কম জানেন। সেই প্রিয়াঙ্কা তামিলনাড়ু জেলে গিয়ে বাবা, রাজীব গান্ধীর অন্যতম হত্যাকারী নলিনীকে মাফ করে দেন। এই ঔদার্য বুঝতে পারা বিজেপির অসংবেদনশীল নেতাদের সম্ভব নয়। ভারতের যে পারিবারিক কাঠামো- মা-বাবা, ভাই-বোন মিলিয়ে যে-স্বর্গীয় পরিবার তা পৃথিবীর বুকে চিরকালীন পরিচিত। আপনি মানুন বা না মানুন গান্ধী পরিবার সেই ধারার প্রতিনিধি।
উল্টো দিকে পারিবারিক জীবনে যিনি নিঃসঙ্গ, ব্যর্থ তিনি তো গান্ধী পরিবারকে আক্রমণ করবেনই; কিন্তু সব শস্তা বিষ গায়ে না লাগিয়ে প্রিয়াঙ্কা গান্ধী যেভাবে দৃপ্ত ভঙ্গিতে হেঁটে যান, তাতে বোঝা যায় ভোটের ফল যাই হোক, গান্ধী পরিবারকে শেষ করে দেয়া চরম দক্ষিণপন্থিদের পক্ষে অসম্ভব।
সৌমিত্র দস্তিদার: ভারতীয় চলচ্চিত্র নির্মাতা ও লেখক।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে