সমস্যা মিয়ানমারের, ভিকটিম বাংলাদেশ!
বাইরে চিৎকার চেঁচামেচি আর মানুষের কান্নার আওয়াজ শুনে দরজা খুলে দেখলেন সশস্ত্র কিছু লোক কয়েকজন নিরীহ মানুষকে মেরে ফেলার চেষ্টা করছে। তারা জীবন বাঁচাতে আপনার সহায্য চাইছেন। বলছেন একটু পানি দিন। আপনার কাছে আশ্রয় চাইছেন। এ মুহূর্তে আপনি কী করবেন? নিতান্ত পাষাণ ও স্বার্থপর হলে আপনি দরজা বন্ধ করে ঘরের ভেতরে উচ্চস্বরে গান বাজিয়ে বসে থাকবেন—যাতে বিপন্ন মানুষের কান্নার আওয়াজ কানে না আসে। আর যদি মানবিক হন তাহলে ওই মুমূর্ষু মানুষগুলোকে খাদ্য ও পানি দেবেন। আশ্রয় দেবেন। জীবন বাঁচাতে সহায়তা করবেন।
কিন্তু কিছুদিন পরে দেখা গেলো, মানবিক কারণে যাদের আশ্রয় দিয়েছিলেন; খাদ্য ও পানীয় দিয়ে জীবন বাঁচালেন—তারাই আপনার বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেখলেন এই ধরনের আশ্রয় ও সহায়তার বিষয়টি নিয়মিত ঘটনায় পরিণত হয়েছে। অর্থাৎ আপনি এমন একটি ঘটনায় বারবার ভিকটিম হচ্ছেন—যে ঘটনায় আপনার নিজের কোনো দায় নেই। আপনার দায় শুধু মানবিকতার! যদি আপনি সেই মানবিকতা না দেখান, তাহলে সারা পৃথিবী আপনাকে ১৯৭১ সাল স্মরণ করিয়ে বলবে, আপনারাও একসময় শরণার্থী হয়েছিলেন। এক কোটি মানুষ পাশের দেশে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন।
প্রতিবেশী রাষ্ট্র মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের কারণে বাংলাদেশ বারবার এরকম একটি শাঁখের করাতে পড়ে যাচ্ছে। তাদের কারণে এতদিন অর্থনীতি, পরিবেশ ও প্রাণপ্রকৃতি এবং কিছু সামাজিক সংকটের সৃষ্টি হলেও এবার সরাসরি আঘাত আসছে বাংলাদেশের মানুষের জীবনের ওপর। বেশ কয়েকদিন ধরে উত্তপ্ত বান্দরবান সীমান্ত। ওপারে মিয়ানমারের সরকারি বাহিনীর সঙ্গে বিদ্রোহী আরাকান আর্মির লড়াই। মর্টার শেল ও গুলি এসে পড়ছে বাংলাদেশের ভেতরে। এরই মধ্যে মিয়ানমার থেকে ছোড়া মর্টার শেলের আঘাতে বাংলাদেশি নারীসহ দুজনের নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। আহত হয়েছে এক শিশু। গত সোমবার দুপুর পৌনে ৩টার দিকে ঘুমধুমের চার নম্বর ওয়ার্ডের জলপাইতলী গ্রামে এই ঘটনা ঘটে।
নিহতদের একজনের নাম নবী হোসেন। তিনি উখিয়া কুতুপালং ৮ নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাসিন্দা। প্রশ্ন হলো, রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাসিন্দা কী করে ঘটনাস্থলে গেলেন? ক্যাম্প থেকে কি তাদের বাইরে বের হওয়ার অনুমতি আছে? এভাবে ক্যাম্পের বাইরে গিয়ে তারা চাইলে সহজেই বাংলাদেশের মূল স্রোতে মিশে যেতে পারেন। এরই মধ্যে অসংখ্য রোহিঙ্গা যে শুধু বাংলাদেশের মূল স্রোতে মিশে গেছে, তা নয়। অনেকে জাতীয় পরিচয়পত্র ও পাসপোর্ট পেয়েছেন—এরকম সংবাদও গণমাধ্যমে এসেছে।
বিষয়টি নিয়ে কথা হয় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, রোহিঙ্গা গবেষক ড. রাহমান নাসিরউদ্দীনের সঙ্গে। তিনি বলছেন, কাগজে কলমে রোহিঙ্গারা ক্যাম্পের বাইরে যেতে পারে না; কিন্তু প্রায়োগিকভাবে তাদের বাইরে যাওয়ার ব্যাপারে কোনো বাধা-নিষেধ নেই। কেবল কক্সবাজার শহরে আসতে চাইলে তাদের দুটি চেকপোস্টের মুখোমুখি হতে হয়। কিন্তু উখিয়া-টেকনাফে তারা অবাধে চলাচল করে। কোনো বিধিনিষেধ কাজ করে না।
তাহলে প্রশ্ন হলো, এ পর্যন্ত কত শত, কত হাজার বা কত লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশের মূল স্রোতে মিশে গেছে—তার পরিসংখ্যান কি সরকার বা রোহিঙ্গাদের নিয়ে কাজ করে এরকম কোনো আন্তর্জাতিক সংস্থার কাছে আছে? ছোট্ট আয়তনের বাংলাদেশ নিজেই যেখানে জনসংখ্যার ভারে ন্যূব্জ—সেখানে আরেকটি দেশের ‘রাষ্ট্রহীন’ জাতির লোক এসে সেই সংখ্যা যদি আরও বাড়িয়ে দেয়—তাহলে দীর্ঘমেয়াদে এর দ্বারা বাংলাদেশ কীভাবে ভিকটিম হবে, সেই হিসাবও করা দরকার।
বান্দরবান সীমান্তের সাম্প্রতিক ঘটনায় যে দাবিটি জোরালো হচ্ছে এবং সরকারের তরফেও যেটি বলা হচ্ছে যে, কোনোভাবেই আর মিয়ানমারের ভেতর থেকে কাউকে বাংলাদেশে প্রবেশ করতে দেয়া হবে না, তখন গণমাধ্যমের খবর বলছে, ‘ঘুমধুম সীমান্তে অনুপ্রবেশের অপেক্ষায় মিয়ানমারের ৪০০ চাকমা।’ কক্সবাজারের শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) মো. মিজানুর রহমানের বরাতে দিয়ে খবরে বলা হয়, দুপক্ষের সংঘর্ষের মধ্যে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের অপেক্ষায় আছেন মিয়ানমারের চাকমা সম্প্রদায়ের প্রায় ৪০০ জন। পাশাপাশি কিছুসংখ্যক রোহিঙ্গাও সীমান্তে জড়ো হচ্ছেন। কেননা সংঘর্ষের কারণে সীমান্তে বসবাসকারীদের মধ্যে খাদ্যসংকট দেখা দিয়েছে। তাদের জীবনও ঝুঁকির মধ্যে।
এখানেও ওই মানবিকতার প্রশ্নটিও বড় হয়ে দেখা দেবে। যদি বিপন্ন মানুষগুলোকে প্রতিবেশী দেশ হিসেবে বাংলাদেশে আশ্রয় না দেয় এবং তার ফলে যদি সেই মানুষগুলো মরে যায়, তাহলে এটি একসময় শরণার্থী হওয়া বাংলাদেশের মানুষের জন্য একটি বেদনার কারণ হবে। আবার এদেরকে আশ্রয় দিলে এবং আশ্রিত হওয়ার পরে তাদের ফেরত পাঠানো না গেলে সেটি বাংলাদেশের জন্যই বুমেরাং হবে। এরকম একটি শাঁখের করাতে অবস্থান করে, অর্থাৎ একদিকে নিজের মানবিক বোধ জাগ্রত রাখা অন্যদিকে দীর্ঘমেয়াদে নিজের দেশের বিপদের কথা ভেবে মধ্যবর্তী কোনো সিদ্ধান্ত নেয়া খুব কঠিন।
এই ঘটনার একমাত্র সমাধান আন্তর্জাতিক কূটনীতি। মিয়ানমার যে ধরনের রাষ্ট্র এবং এখানে বরাবরই যে ধরনের লোকেরা শাসনক্ষমতায় থাকে—তারা কেউই রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে মানবিক নয়। তারা রোহিঙ্গাদেরকে মিয়ানমারের নাগরিক বলেই স্বীকার করে না। তাদেরকে জাতিগতভাবে নিশ্চিহ্ন করার (এথনিং ক্লিনজিং) চেষ্টা চলছে বহু বছর ধরে। সেই অভিযানের মুখে বারবার জীবন নিয়ে পালিয়ে এসে তারা আশ্রয় নিয়েছে বাংলাদেশে; কিন্তু বাস্তবতা হলো, এই ১১-১২ লাখ রোহিঙ্গা এখন বাংলাদেশের জন্য ‘গলার কাঁটা’য় পরিণত হয়েছে।
মিয়ানমারের এই ধরনের তৎপরতা ঠেকানো তথা রোহিঙ্গাদের নাগরিক স্বীকৃতি ও মানবাধিকার নিশ্চিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বিশেষ করে জাতিসংঘের যে ভূমিকা থাকার কথা সেটি আছে কি না, এটি অনেক পুরোনো তর্ক। তার চেয়ে বড় প্রশ্ন, মিয়ানমার যে ধরনের রাষ্ট্র তথা যে ধরনের সরকার দেশটির রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকে, তারা আদৌ জাতিসংঘ বা অন্য কোনো আন্তর্জাতিক সংস্থাকে পাত্তা দেয় কি না? যদি না দেয় তাহলে তাদের বিরুদ্ধে কি জাতিসংঘ যুদ্ধ ঘোষণা করবে? সেটিও কাজের কথা নয়। কারণ যুদ্ধ মানেই সেখানে প্রধানত প্রাণ যায় সাধারণ মানুষের। অতএব মিয়ানার যার কথা শোনে বা তার ওপর যার নিয়ন্ত্রণ আছে, তাকে দিয়েই এই সমস্যার সমাধান করতে হবে।
মিয়ানমার চীনের কথা শোনে। চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। মিয়ানমারে যেমন চীনের বিরাট বিনিয়োগ আছে, একইভাবে বিনিয়োগ আছে বাংলাদেশেও। অর্থাৎ মিয়ানমার ও বাংলাদেশের অভিন্ন বন্ধু হচ্ছে চীন। অতএব, রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের সঙ্গে কূটনৈতিক সমস্যা রয়েছে, চীন সেখানে মধ্যস্থতা করতে পারে—এ কথাও বহুদিন ধরে বলা হচ্ছে; কিন্তু দৃশ্যমান কোনো ফলাফল নেই। তার মানে সমস্যাটা অন্য কোথাও।
সমস্যা যেখানেই হোক, মিয়ানমারের নিজস্ব সমস্যার কারণে বাংলাদেশে বারবার ভিকটিম হবে, হতে থাকবে—এটি কোনো কাজের কথা নয়। যুক্তরাষ্ট্র-কানাডা-চীন বা ভারতের মতো বাংলাদেশের বিশাল ভূখণ্ড নেই যে ১০-১২ লাখ মানুষ এক কোণায় পড়ে থাকবে। এখানে নগর-শহর এমনকি গ্রামেও জনঘনত্ব পৃথিবীর অধিকাংশ দেশের চেয়ে বেশি। তাছাড়া ক্যাম্প বানিয়ে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়ার ফলে পুরো কক্সবাজারের পরিবেশ ও প্রাণ-প্রকৃতির যে বিপুল ক্ষতি হয়েছে, সেটি টাকার অঙ্কে হিসাব করা যাবে না।
সুতরাং রোহিঙ্গা সংকট সমাধান তথা তাদের হয় নিজ দেশ মিয়ানমার অথবা অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী তৃতীয় কোনো দেশে পাঠানো এবং বাংলাদেশ সীমান্তে মিয়ানমারের বিদ্রোহ দমন অভিযানের ফলে বাংলাদেশের ভেতরে যাতে কোনো সমস্যা তৈরি না হয়—সেটি নিশ্চিত করার কাজে শুধু চীন নয়, বরং এই অঞ্চলের পরাশক্তি ভারতকেও যুক্ত করা দরকার।
লেখক: কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এডিটর, নেক্সাস টেলিভিশন।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে