অধ্যাপক আনিসুর রহমান ছিলেন আমার শিক্ষক ও গাইড
যে কোনো মৃত্যুই কষ্টদায়ক। আর তা যদি হয় অধ্যাপক আনিসুর রহমানের মতো ব্যক্তির মৃত্যু, তাহলে তা সহ্য করা খুবই কঠিন। অধ্যাপক আনিসুর রহমান ছিলেন আমার সরাসরি শিক্ষক। তিনি অনেক দিন ধরেই বার্ধক্যজনিত নানা জটিলতায় ভুগছিলেন। অসুস্থ অবস্থায় অধ্যাপক আনিসুর রহমানকে রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। সেখানেই তিনি গত ৫ জানুয়ারি ইন্তেকাল করেন। অধ্যাপক আনিসুর রহমান ১৯৩৩ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় জন্মগ্রহণ করেন। যদিও তার পৈতৃক নিবাস নেত্রকোনার কেন্দুয়ায়। তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের একজন অন্যতম সংগঠক ছিলেন। তিনি ষাটের দশকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৬ দফা ঘোষণাপত্র প্রণয়নের ক্ষেত্রে সহায়তা করেন। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে গঠিত বাংলাদেশের প্রথম পরিকল্পনা কমিশনের তিনি অন্যতম সদস্য ছিলেন। তার এই মৃত্যুতে জাতির অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেল। মানুষমাত্রই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে; কিন্তু অধ্যাপক আনিসুর রহমানের মতো মানুষের মৃত্যুশোক মেনে নেয়া খুবই কঠিন।
আনিসুর রহমান ছিলেন আমার শ্রদ্ধাভাজন একজন খুব প্রিয় শিক্ষক। ১৯৭৪ সালে আমি যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে ভর্তি হই, তখন অধ্যাপক আনিসুর রহমান ছিলেন অর্থনীতি বিভাগের চেয়ারম্যান। সে সময় নিয়ম ছিল যারা সবচেয়ে সিনিয়র অধ্যাপক, তারাই প্রথম বর্ষের ক্লাস নিতেন। আমাদের প্রথম বর্ষের মাইক্রো ইকোনমিক্সের ক্লাস নিতেন আনিসুর রহমান স্যার। প্রথম দিন ক্লাসে ঢুকেই আনিসুর রহমান স্যার বললেন, তোমরা কারা অর্থনীতিতে সবচেয়ে বেশি নাম্বার পেয়েছ? আমাদের মধ্যে অনেকেই হাত তোলে। আমিও হাত তুলি। তারপর স্যার আমাদের বললেন, তোমাদের দুধরনের অসুবিধা হবে। স্যারের এই কথা শুনে আমরা খুব অবাক হয়ে গেলাম। আমরা জানতে চাইলাম কেন অসুবিধা হবে? তিনি বললেন, তোমরা আগে যা শিখেছ তার অধিকাংশই ভুল। সেই ভুলগুলো তোমাদের ভুলতে হবে। এটা তোমাদের প্রথম সমস্যা।
আর দ্বিতীয় সমস্যা হচ্ছে, এখন আমি তোমাদের যা শেখাব, তা নতুন। সেটাও তোমাদের শিখতে হবে। কাজেই তোমাদের দুধরনের সমস্যায় পড়তে হবে। আমরা স্যারের অদ্ভুত কথা শুনে খুব মজা পেয়েছিলাম। কারণ এমন কথা আমাদের আগে কেউ বলেননি। ভালো ছাত্র হিসেবে আমাদের যে গর্ব তা তিনি মুহূর্তের মধ্যে ধূলিস্যাৎ করে দিলেন। প্রথম দিনের ক্লাসেই তিনি আরও একটি কথা বললেন। তিনি জানতে চাইলেন, অর্থনীতির সংজ্ঞা কী? আমরা যে যা পড়ে এসেছি, তাই বললাম। কেউ বলল সীমাবদ্ধ সম্পদ দিয়ে কীভাবে অসীম চাহিদা পূরণ করা যায়, তার পথ নির্দেশনা দেয়াই অর্থনীতির মূল কাজ। আরও নানাজন নানাভাবে অর্থনীতির সংজ্ঞা প্রদান করল। আমি তখন হাত তুলে বলেছিলাম, অর্থনীতির সংজ্ঞা হচ্ছে উৎপাদন সম্পর্ক নিয়ে সে আলোচনা করে। স্যার আমার প্রতি সপ্রশংসনীয় দৃষ্টি নিয়ে বললেন, আমি মার্ক্সের গন্ধ পাচ্ছি। প্রথম দিনের ক্লাসেই আরও বলেছিলেন, তোমাদের কোনো টেক্সট বই আমি দেব না। তিনি পরিষ্কারভাবে বলেছিলেন,বাংলাদেশের পরিশ্রমী কৃষক হবে তোমাদের শিক্ষক। কৃষক কীভাবে অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। তারা কীভাবে উৎপাদন বৃদ্ধি করে, সেটা তোমাদের জানতে হবে। তিনি মাইক্রো অর্থনীতির যে মার্জিনাল অ্যানালাইসিস, সেটা তিনি গ্রাফের মাধ্যমে বুঝালেন। একজন তৃণমূল পর্যায়ের কৃষকের কী কী সমস্যা হয় এবং সেই সমস্যা সমাধানে তিনি কী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন, তা তিনি আমাদের বলতেন। কৃষকের সমস্যা তিনি আমাদের বলতেন এবং সেগুলো সমাধানের পথ বের করার জন্য আমাদের দায়িত্ব দিতেন। তিনি বারবার বলতেন, কৃষকই তোমাদের শিক্ষক আমি কিন্তু শিক্ষক নই।
যে কোনো বিষয়ে কিছুটা আলোচনা করেই তিনি চক-ডাস্টার আমাদের হাতে দিয়ে ছাত্রদের টিচার বানিয়ে পেছনে চলে যেতেন এবং চুপচাপ বসে থাকতেন। আমরাই আমাদের পড়াতাম। এই পদ্ধতি অত্যন্ত কার্যকর বলে প্রতীয়মান হয়েছিল। সবচেয়ে দুর্বল এবং সবচেয়ে ভালো উভয় শ্রেণির ছাত্ররাই এই পদ্ধতি দ্বারা উপকৃত হয়েছিল। আমরা যারা পরবর্তীতে শিক্ষকতা পেশায় এসেছি, তারা আনিসুর রহমান স্যারের এই শিক্ষণ পদ্ধতি কাজে লাগিয়েছি। আনিসুর রহমান স্যার যে পদ্ধতিতে ক্লাসে পড়াতেন, তা সম্ভবত এরিস্টেটলের শিক্ষা পদ্ধতি। এই পদ্ধতিকে বলা হয় ম্যাথড অব মিডওয়াইফ। ম্যাথড অব মিডওয়াইফ পদ্ধতির মূল কথা হচ্ছে, যার কাছ থেকে তুমি বাচ্চাটা বের করতে চাও তার কাছ থেকেই এটা বের করতে হবে। তুমি তার ওপর কিছু চাপিয়ে দেবে না। আনিসুর রহমান স্যার ছাত্রদের ওপর কোনো কিছু চাপিয়ে দেয়ার পক্ষপাতি ছিলেন না। তিনি চাইতেন ছাত্ররা নিজেরাই নিজেদের সমস্যা সমাধান করুক। যে শিক্ষা তিনি দিতে চান, তা ছাত্রের উপলব্ধি এবং ভেতর থেকেই বেরিয়ে আসুক।
আরও একটি পদ্ধতি তিনি অনুসরণ করতেন। প্রতি সপ্তাহে অথবা পনেরো দিন পর একদিন তিনি টিএসসিতে আমাদের নিয়ে দুপুরের খাবার খেতেন। খাবার সময় আমরা তাকে যে কোনো বিষয়ে প্রশ্ন করতে পারতাম। এমনকি আমরা আমাদের ব্যক্তিগত অনেক প্রশ্নও তাকে জিজ্ঞাসা করতে পারতাম। কার জীবনের কি লক্ষ্য, কারও কোনো সমস্যা আছে কি না, এসবও অবলীলায় আমরা নির্দ্বিধায় আলোচনা করতে পারতাম। বাসায় আমরা কী করছি? কোন বই পড়ছি এসবও আলোচনা হতো। আনিসুর রহমান স্যার প্লানিং কমিশন থেকে পদত্যাগ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করেছিলেন। তার পদত্যাগ করার কারণও তিনি আমাকে বলেছিলেন। তিনি বঙ্গবন্ধুকে বলেছিলেন, আপনার যে জনপ্রিয়তা, তাকে কাজে লাগিয়ে আপনি যদি সারা বাংলাদেশ ঘুরে মানুষকে স্বেচ্ছাশ্রমে উদ্বুদ্ধ করেন, তাহলে দেশের অনেক বড় উপকার হতে পারে। বঙ্গবন্ধু অবশ্য আনিসুর রহমান স্যারের পরামর্শ শোনেননি। তিনি বঙ্গবন্ধুকে আরও একটি পরামর্শ দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, আমরা একটি আদর্শ গ্রাম স্থাপন করি। শেখ মুজিব তখন আনিসুর রহমান স্যারকে বলেছিলেন, আপনি তো একটি আদর্শ গ্রাম তৈরি করছেন সেটাই আমার গ্রাম। তার দ্বিতীয় পরামর্শও গৃহীত হয়নি। জাসদ ছাত্রলীগ গঠিত হলে আনিসুর রহমান স্যার বঙ্গবন্ধুর অনুমতি নিয়ে পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত ছাত্রলীগের সভায় বক্তব্য উপস্থাপন করেন। সে সময় তিনি পরিকল্পনা কমিশনে কর্মরত ছিলেন। বঙ্গবন্ধু আনিসুর রহমান স্যারকে বলেছিলেন, অধ্যাপক সাহেব আপনি সভায় যান। তবে ওদের একটু বুঝিয়ে বলবেন, সমাজতন্ত্রের নামে আমার বিরুদ্ধে কিছু করার দরকার নেই। আমিই সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করব।
জীবনের শেষের দিকে তিনি বুর্জোয়া অর্থনীতি সম্পর্কে পুরোপুরি আস্থা হারিয়ে ফেলেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের যে দর্শন আত্মশক্তি তার ওপর আস্থাশীল হন। তিনি রবীন্দ্রসংগীত চর্চা করতেন। অধ্যাপক আনিসুর রহমান বামপন্থিদের এটাই শেখাতে চেয়েছিলেন যে, তোমরা মার্কসবাদ-লেলিনবাদ মানুষের ওপর চাপিয়ে দিও না। বরং মানুষকেই জিজ্ঞাসা কর, তারা কি চায়। জনগণের চাওয়ার সঙ্গে মিলিয়ে তোমরা মার্কসবাদ-লেলিনবাদকে প্রয়োগ কর। তিনি মাও সেতুংয়ের একটি কথা প্রায়ই বলতেন। তিনি বলতেন, মাও কখনো তার দেশের মানুষকে বলেননি যে, তোমরা গরিব। মাও সব সময় বলতেন, তোমরা শ্রমজীবী এবং সৃজনশীল। তোমরা সব কিছু করবে। দরিদ্র বলে তাদের ছোট করা হয়নি। দারিদ্র্যের যে কনসেপ্টকে আমরা ব্যবহার করি, সেটাকে তিনি ঘৃণা করতেন। তিনি বলতেন এটা হচ্ছে লাইফস্টক কনসেপ্ট অব প্রোভার্টি। একটা পশু খেতে চায় এবং খেয়ে বেঁচে থাকতে চায়; কিন্তু মানুষের শুধু বেঁচে থাকলেই চলে না, তার আরও নানা চাহিদা আছে, তা পূরণ করতে হয়। মানুষকে খাবারের পাশাপাশি শিক্ষা, স্বাস্থ্য, চিকিৎসা- এসব নিয়েও চিন্তা করতে হয়। তিনি মনে করতেন, পুঁজিপতিরা সস্তায় শ্রম শক্তির জোগান পাওয়ার জন্য দারিদ্র্য রেখার ধারণাটি প্রবর্তন করেছে।
মানুষ যেহেতু সৃজনশীল, তাই সে কখনোই দরিদ্র ছিল না। আদিম সমাজে কোনো বৈষম্য ছিল না। কিন্তু তারা তো এখনকার মানুষের চেয়েও কম পরিমাণ খাওয়া-দাওয়া করত। যে কোনো সময় তারা মৃত্যুবরণ করত। অসুস্থ হয়ে পড়ত। প্রকৃতির কাছে তারা অসহায় ছিল; কিন্তু কেউ তো তাদের দরিদ্র বলেনি। এই মহৎ চিন্তাটা কেন আমরা এখন পরিত্যাগ করব? মানুষ শ্রেষ্ঠ জীব। মানুষের কৃতিত্ব হচ্ছে সব অজেয়কে জয় করা। অসম্ভবকে সম্ভব করা। আনিসুর রহমান স্যারও সেজন্য মানুষের আত্মশক্তিকে জাগিয়ে তোলার স্বপ্ন দেখতেন।
ড. এম এম আকাশ: অর্থনীতিবিদ ও অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
অনুলিখন: এম এ খালেক
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে