নারীর অগ্রগতি ও একজন জান্নাতুল ফেরদৌস
অতি সম্প্রতি বিবিসি বিশ্বের ১০০ প্রভাবশালী ও অনুপ্রেরণাদায়ী নারীর যে তালিকা করেছে, সেখানে স্থান পেয়েছে বাংলাদেশের জান্নাতুল ফেরদৌস নামের এক লেখক ও মানবাধিকারকর্মী। এ ছাড়া তিনি চলচ্চিত্রও নির্মাণ করেন। ব্যক্তিগতভাবে আমি জান্নাতুল ফেরদৌসকে চিনি না, নামও জানতাম না, যদি বিবিসি বিশ্বের ১০০ প্রভাবশালী ও অনুপ্রেরণাদায়ী নারীর তালিকায় তাকে স্থান না দিত। এটা আমার কিংবা আমাদের ব্যর্থতা। বিবিসির তালিকায় তার নাম প্রতিষ্ঠিত করতে পেরে সে যেমন নিজেকে সম্মানিত করেছে, তেমনি আমাদেরও। কারণ ওই তালিকায় জান্নাতুলের সঙ্গে আরও আছেন সাবেক মার্কিন ফার্স্ট লেডি মিশেল ওবামা, মেয়েদের ব্যালন ডি’অরজয়ী আইতানো বনমাতি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) বিশেষজ্ঞ টিমনিত জিবরু ও হলিউড অভিনেত্রী আমেরিকা ফেরেইরার মতো নারীরা।
সংবাদমাধ্যম থেকে জানতে পেরেছি, জান্নাতুল দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে ফেরা একজন অ্যাক্টিভিস্ট। ১৯৯৭ সালে রান্না করার সময় জান্নাতুলের ওড়নায় আগুন লাগে। তখন তার শরীরের ৬০ শতাংশ পুড়ে গিয়েছিল। আগুনে পুড়ে- কুঁচকে বিকৃত হয় তার মুখ ও শরীরের একটা অংশ। এ পর্যন্ত চামড়া প্রতিস্থাপনসহ তার শরীরে প্রায় ৫০ বার অস্ত্রোপচার করা হয়েছে। তবুও সে এত বড় প্রতিবন্ধকতা নিয়ে একজন চলচ্চিত্র নির্মাতা, লেখিকা এবং প্রতিবন্ধী অধিকার প্রচারক হয়ে ওঠেন, এটা আমাদের কাছে গর্বের বিষয়। তা ছাড়া জান্নাতুল ‘ভয়েস অ্যান্ড ভিউজ’ নামের একটি মানবাধিকার সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা, যারা অগ্নিদগ্ধ নারীদের অধিকার নিয়ে কাজ করেন। একজন অগ্নিদগ্ধ নারী কতটা অদম্য শক্তির অধিকারী হলে এত কাজ করতে পারেন, তা অনুধাবন করে আমি তার মুগ্ধ হয়েছি। আর মনে হয়েছে এখানেই তো নারীর শক্তি।
তবু দুঃখ পাই, যখন জানতে পারি এই জান্নাতুলকে দগ্ধ শরীরের কারণে বিভিন্ন সময় নানা কটু কথা শুনতে হয়েছে। নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে বিয়ে পর্যন্ত করেননি জান্নাতুল। এই সমাজে এ ধরনের সমস্যা শুধু একজন জান্নাতুল ফেরদৌস ফেস করেছেন এমন নয়, বরং তার মতো অগণিত নারী ঘরে বাইরে বিভিন্ন ধরনের সহিংসতার শিকার হচ্ছেন। যদিও আজকের বাংলাদেশে প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেত্রী, সংসদের স্পিকার এবং গুরুত্বপূর্ণ অনেক মন্ত্রী নারী। নারীরা এখন সচিবসহ আমলাতন্ত্রের উচ্চ পর্যায়ে অধিষ্ঠিত রয়েছেন। জেলা প্রশাসক, ইউএনও, পুলিশের ডিআইজি, পুলিশ সুপারসহ বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালন করছেন। বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, উচ্চ আদালতের বিচারপতি পদও অলঙ্কৃত করছেন উচ্চশিক্ষিত নারী। সামরিক বাহিনী, নেভি ও বিমান বাহিনীতে মেয়েরা যোগ দিচ্ছে। অনেকে নারী জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনীতে বিভিন্ন দেশে দায়িত্ব পালন করছেন। খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে শেখ হাসিনার আগ্রহ সম্পর্কে সবাই জানেন। তার সময় ফুটবল ক্রিকেটসহ ক্রীড়াঙ্গনে মেয়েরা দেশে ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে চমৎকার সাফল্য অর্জন করছে। তবুও সমাজে থেমে নেই নারীর প্রতি সহিংসতা।
পৃথিবীতে বসতি শুরু হয়েছিল নারী-পুরুষের যৌথ প্রচেষ্টায়। সভ্যতার শুরুতেই নারী-পুরুষের লিঙ্গভিত্তিক তফাত তৈরি হয়নি। মানুষ হিসেবে বিকশিত হওয়ার শ্রেয় বোধটি ছিল প্রধান; কিন্তু সময় এক রকম থাকেনি। গড়িয়েছে প্রবল ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে। নারী ছিটকে পড়েছে মানুষ নামের বিশেষণ থেকে। শুরু হয়েছে পুরুষের একতরফা কর্তৃত্ব। তারা এ কর্তৃত্ব গড়ে তোলে দুটি ভিত্তির ওপর। ধর্ম আর অর্থনীতি। এ দুটি ক্ষেত্র নারীকে প্রবলভাবে কোণঠাসা করে রেখেছে। এ দুটি সংস্কৃতির মধ্যে নারী-সংক্রান্ত ভাবনার মৌল সত্য। এর পাশাপাশি নানা ধরনের ভিন্নমুখী তরঙ্গ এসে আঘাত করতে শুরু করেছে।
দীর্ঘকালের পুরুষ শাসিত এ সমাজে এখনো নানাভাবে মেয়েশিশু ও নারীরা সামাজিক নিগ্রহের শিকার হচ্ছেন। নারীর প্রতি সহিংসতা, নারী পাচার এবং নারীর অধিকার লঙ্ঘন এখনো এ সমাজের অভিশাপ হিসেবে টিকে আছে। মূল্যবোধের অভাবে নষ্ট মানুষ নির্যাতনের জায়গাটি ধরে রেখেছে। নানাভাবে শিশু-কিশোরী-তরুণীদের প্রতি তাদের নির্যাতনের মাত্রায় সুস্থ সামাজিক ব্যবস্থাকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রত্যাশা করে দেশবাসী।
ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের বিদ্রোহী প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার ১৯৩২ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রামের ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণের আগে যে বক্তৃতা দিয়েছিলেন তার শেষ লাইন কয়টি এমন, ‘নারীরা আজ কঠোর সংকল্প নিয়েছে যে, আমার দেশের ভগিনীরা আজ নিজেকে দুর্বল মনে করিবেন না। সশস্ত্র ভারতীয় নারী সহস্য বিপদ ও বাধাকে চূর্ণ করিয়া এই বিদ্রোহ ও সশস্ত্র মুক্তি আন্দোলনে যোগদান করিবেন এবং তাহার জন্য নিজেকে তৈয়ার করিবেন এই আশা লইয়াই আমি আজ আত্মদানে অগ্রসর হইলাম।’
১৯৪৬ সাল থেকে কৃষকদের ধানে ন্যায্য অধিকার আদায়ের জন্য কৃষক আন্দোলনে সম্পৃক্ত হয়েছিলেন ইলামিত্র। ১৯৫০ সালের ৭ জানুয়ারি তিনি পাকিস্তান পুলিশের হাতে ধরা পড়েন। পুলিশের হাতে ধর্ষণের শিকার হন। একটা বিবৃতি দিয়ে তিনি তার ওপরের নির্যাতনের কথা ছড়িয়ে দেন দেশবাসীর সামনে। বিবৃতির শুরুর লাইন এমন, ‘বিগত ৭ জানুয়ারি ১৯৫০ সালে আমি রোহনপুরে গ্রেপ্তার হই এবং পর দিন আমাকে নাচোল নিয়ে যাওয়া হয়। যাওয়ার পথে পুলিশ আমাকে মারধর করে এবং তারপর আমাকে একটা সেলের মধ্যে নিয়ে যাওয়া হয়। তারা আমার সমস্ত কাপড়-চোপড় খুলে নেয় এবং সম্পূর্ণ উলঙ্গভাবে সেলের মধ্যে আমাকে বন্দি করে রাখে।’ এভাবে বাংলাদেশের নারী সমাজ দেশের স্বাধীনতার স্বপ্নে, সমাজ পরিবর্তনের সংগ্রামে সবসময় যুক্ত ছিলেন। তাই নারীকে বাদ দিয়ে কোনো বড় অর্জন এ দেশে সম্ভব হয়নি।
আমরা দেখেছি, কখনো কোনো নারী রাষ্ট্রক্ষমতায় থেকে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার পুরুষতন্ত্রের কাছে বন্দি হন। তার প্রমাণ ভারতের ইন্দিরা গান্ধী। তার সময়ে ১৯৭৪ সালে ভারত পরমাণু শক্তির বিকাশ ঘটায়। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোয় পরমাণু শক্তি হিসেবে প্রথম আত্মপ্রকাশ করে ভারত। ১৯৯৮ সালে ভারত ও পাকিস্তান পারমাণবিক পরীক্ষা চালানো প্রসঙ্গে ভারতীয় লেখক অরুন্ধতী রায় লেখেন, ‘পারমাণবিক বোমা নিয়ে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা। এ প্রবন্ধে শান্তির পক্ষে, মানুষের পক্ষে তার আবেদন ছিল সংবেদনশীল। এ ক্ষেত্রে নারীর মেধা ও মননের সমন্বয় পুরুষতন্ত্রের কাছে নতি স্বীকার করেনি। অধিকার মানুষের বেঁচে থাকার ন্যূনতম চাহিদার স্বীকৃতি।’ যদি তাই হয়, তবে শুধু নারীর অধিকার নিয়ে প্রশ্ন ওঠে কেন? যেখানে বঞ্চনা, সেখানেই অধিকারের প্রশ্ন। আর নারীর বঞ্চনার শিকড়টি অনেক গভীরে প্রোথিত। কেননা, এই সংস্কৃতির একটি লক্ষণীয় দিক হলো, নারীকে মানুষ হিসেবে বিবেচনা না করে তাকে নারী হিসেবে চিহ্নিত করার প্রবণতা। ফলে মৌল সত্য থেকে দূরে সরিয়ে রাখার কারণে এই সংস্কৃতিতে নারীর প্রতি বিবেচনা অনেক ক্ষেত্রেই নেতিবাচক।
ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ পুরোটা সময় নারী তার মর্যাদার অবদান রেখেছে ইতিহাসের ক্রান্তিলগ্নের প্রতিটি সময়ে। নারীর পিছুহাঁটার কোনো ইতিহাস এ দেশে নেই। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনেও তারা ব্যাপক ভূমিকা রেখেছেন। তবে আমরা আশাবাদী বর্তমান প্রধানমন্ত্রী যেভাবে শক্ত হাতে নারীর অগ্রযাত্রা কণ্টকমুক্ত করার ব্রত নিয়েছেন তাতে নিশ্চিতভাবে দেশ সুফল পাবে। উন্নয়নের এই পর্যায়ে আমরা বিশ্বাস করি, সচেতন নারী-পুরুষের সম্মিলিত প্রয়াসে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে আমাদের অগ্রগতি সময়ের ব্যাপার মাত্র।
আমরা গত দুই দশকে অনেক উন্নয়ন করেছি। এগুলো অবকাঠামোগত উন্নয়ন। এই উন্নয়নের সঙ্গে যদি মানবিক বোধের সমুন্নত ধারণা ব্যক্তি-মানুষের মধ্যে না থাকে, তাহলে তা বিশ্বজুড়ে মানুষের সামনে প্রশ্নবিদ্ধ হয়। আমরা যদি ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনের মতো অপরাধ রুখতে না পারি, তাহলে আগামী দিনে আমাদের আরও বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে। কেন ঘটছে ধর্ষণের ঘটনা? আমাদের সংকট কোথায়? এর জন্য দায়ী বিকৃত মানসিকতা ও বিচারহীনতার সংস্কৃতি। এখনো অনেকেই নারীদের সম্মানের চোখে না দেখে ভোগ্যসামগ্রী হিসেবে বিবেচনা করে। নারীকে একা দেখলেই তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে চায়। অনেক সময় ধর্ষণের পর হত্যাও করে। এরপরও অনেকেই বিচারের মুখোমুখি হয় না, আবার অনেকেই আইনের ফাঁকে বেরিয়ে আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠে।
এর আগে নারীর প্রতি যেসব সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে সেগুলোর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হলে হয়তো আমাদের এই বেদনাবিধুর মুহূর্ত প্রত্যক্ষ করতে হতো না। কয়েক মাসের শিশু থেকে শুরু করে বৃদ্ধা পর্যন্ত সব বয়সের নারীই ধর্ষণ-নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। সব ঘটনা আমরা জানতেও পারি না। সাধারণত আমাদের নিকটতম কেউ আক্রান্ত হলে আমরা প্রতিক্রিয়া দেখাই, বিচার চাই। এ ঘটনাটির পরিপ্রেক্ষিতে আমরা যে প্রতিবাদমুখর পরিস্থিতি লক্ষ্য করছি তাও সৃষ্টি হয়েছে নৈকট্যবলে; কিন্তু আমাদের দাবি ছিল যে কোনো ধরনের সহিংস ঘটনার বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া, দ্রুত সব মামলার বিচার হওয়া এবং অপরাধীদের শাস্তি কার্যকরের; কিন্তু যুগযুগ ধরে এর ব্যত্যয় ঘটছে।
লেখক: কথাসাহিত্যিক; বাংলা একাডেমির সভাপতি
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে