Views Bangladesh Logo

আইএলডিটিএস পলিসি সংশোধন

খসড়া প্রস্তাব ভালো, তবে কিছু ক্ষেত্রে অসামঞ্জস্যতা দূর করতে হবে

র্তমান সময় কিংবা আগামী দিনে তথ্যপ্রযুক্তির চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার উপযোগী টেলিযোগাযোগ কাঠামো নিশ্চিত হওয়া জরুরি। এই লক্ষ্য সামনে রেখে আইএলডিটিএস পলিসি সংশোধনে বিটিআরসির উদ্যোগ একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। প্রায় দুই দশক ধরে চলমান পুরোনো লাইসেন্সিং ব্যবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এই সংস্কার এক অর্থে অনিবার্য। বাংলাদেশের টেলিকম শিল্পে অর্থপূর্ণ ও টেকসই প্রবৃদ্ধি নিশ্চিতে একটি ভিত্তি তৈরির জন্য এই সংশোধনের উদ্যোগ পরিচালিত হবে, এটাই কাম্য। প্রথমেই খসড়াটির ইতিবাচক প্রস্তাবের দিকে চোখ রাখি। খসড়াটিতে অ্যাক্সেস নেটওয়ার্ক পরিষেবা প্রদানকারীদের গ্রাহকের কাছে সেবা পৌঁছে দেওয়া বা ক্ষেত্রে কিছু শর্ত ও সীমাবদ্ধতা দূর করতে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।

ওই শর্তগুলো দুই দশক আগের প্রেক্ষাপটে উপযোগী হলেও বর্তমানে অপ্রয়োজনীয়। এ ছাড়াও টিভাস এবং ভেহিক্যাল ট্র্যাকিং পরিষেবা ‘ডিরেগুলেটেড’ করার অনুমতি দেওয়া একটি ভালো পদক্ষেপ। এর ফলে ক্ষুদ্র প্রযুক্তি উদ্যোক্তাদের বাজারে প্রবেশের প্রাথমিক বাধা দূর হবে এবং তারা উন্নত দেশগুলোর মত উন্মুক্ত নীতিতে লাখ লাখ গ্রাহকের কাছে তাদের পরিষেবা বাজারজাত করতে পারবে। একই সঙ্গে উদ্যোক্তাদের মধ্যে উদ্ভাবনের প্রতিযোগিতা এবং দক্ষতা বৃদ্ধি পাবে। খসড়া নীতিতে বেশ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য প্রস্তাব রয়েছে, যার মধ্যে কিছু প্রশংসার দাবিদার হলেও, অন্যগুলো আরও যাচাই-বাছাইয়ের দাবি রাখে। যে প্রস্তাবগুলোর আবার যাচাই-বাছাইয়ের মধ্য দিয়ে যাওয়ার দরকার, সেগুলো নিচে তুলে ধরছি।

বিদেশি বিনিয়োগের বিধিনিষেধের সমন্বয়
সংশোধিত নীতিমালায় ইন্টারন্যাশনাল কানেকটিভিটি সার্ভিস প্রোভাইডারদের (আইসিএসপি) জন্য ৪৯ শতাংশ এবং ন্যাশনাল ইনফ্রাস্ট্র্যাকচার অ্যান্ড কানেকটিভিটি সার্ভিস প্রোভাইডারদের (এনআইসিএসপি) জন্য ৭০ শতাংশ বিদেশি মালিকানার প্রস্তাব করা হয়েছে। একই সঙ্গে অ্যাক্সেস নেটওয়ার্কগুলোতে শতভাগ বিদেশি বিনিয়োগের অনুমতি দেয়া হয়েছে। এই বৈষম্য আর্থিক ও প্রযুক্তিগত, উভয় ক্ষমতাসম্পন্ন কিছু আন্তর্জাতিক কোম্পানিকে টেলিকম বাজারে প্রবেশে নিরুৎসাহিত করতে পারে। আবার দেশীয় উদ্যোক্তাদের মাধ্যমে গড়ে ওঠা প্রতিষ্ঠানগুলোকেও বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলতে পারে। এ কারণে সমান প্রতিযোগিতামূলক ক্ষেত্র তৈরি এবং টেকসই বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণের জন্য উপযুক্ত নীতিমালা প্রয়োজন। গত এক দশকের বাস্তবতায় এমন একটি নীতিমালা হওয়া দরকার যেখানে বিদেশি কোম্পানিগুলো স্থানীয় উৎস থেকে ঋণ নিতে নিয়ে বিনিয়োগ না করে এফডিআই নিশ্চিত করবে।

ভার্টিক্যাল ইন্টেগ্রেশনের সুযোগ অপব্যবহারের বিরুদ্ধে সতর্ক থাকা
দ্রুত বিকাশমান টেলিকম বাজারের গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ হলো, কয়েকটি বৃহৎ কোম্পানির বাজার আধিপত্য রোধ করা। খসড়া নীতিমালায় সঠিকভাবে ক্রস-মালিকানা নিষিদ্ধের প্রস্তাব করা হয়েছে, বিশেষ করে এএনএসপি বা আইসিএসপি লাইসেন্সধারীদের এনআইসিএসপি লাইসেন্স ধারণ থেকে বিরত রাখা হয়েছে (৭ দশমিক ৯৯)। তবে প্রভাবশালী কোম্পানিগুলো কঠোর ক্রস-মালিকানা বিধিনিষেধ পাশ কাটিয়ে অন্য স্তরের ব্যবসাও নিজের নিয়ন্ত্রণে নিতে পারে, এমন সুযোগও খসড়ায় আছে। এ কারণে প্রতিযোগিতাবিরোধী অনুশীলন প্রতিরোধে পরিষেবা স্তরগুলোর স্পষ্ট সীমানা নির্ধারণ অপরিহার্য। এক লাইসেন্সের বিদেশি মালিকদের অন্যস্তরে লাইসেন্স পাওয়ার সুযোগ উন্মুক্ত রাখা (৭.১০.৭) তাই এই নীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

হরিজেন্টাল ইন্টেগ্রেশনে অনৈতিক অনুশীলনের ঝুঁকি এড়ানো
উল্লম্ব একীকরণের পাশাপাশি, অনুভূমিক একীকরণও নিবিড়ভাবে পরীক্ষা করা উচিত। নীতিমালায় এক ক্যাটাগরি লাইসেন্সপ্রাপ্ত কোম্পানিকে অন্য ক্যাটাগরির লাইসেন্সপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানের ব্যবসায় আংশিক প্রবেশের সুযোগ রাখাও সঠিক নয়। মোবাইল অপারেটরদের (এমএনও) ফিক্সড টেলিকম সার্ভিস লাইসেন্স (এফটিএসএল) বা ন্যাশনাল গ্লোবাল স্যাটেলাইট অপারেটর (এনজিএসও) উভয় লাইসেন্স ধারণের অনুমতি দিলে অন্যায্য বা অনৈতিক অনুশীলনের ঝুঁকি তৈরি হবে, যা ছোট প্রতিযোগীদের আরও বিপদগ্রস্ত করে তুলবে। এ ধরনের সুযোগ প্রতিযোগিতার ক্ষতি করতে এবং সাধারণ গ্রাহকের স্বার্থ ক্ষুণ্ন করতে পারে । তবে, প্রতিযোগিতা আইনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে নিয়ন্ত্রক সংস্থা যাচাই-বাছাই করে কেস-বাই-কেস ভিত্তিতে ব্যবসায়িক অংশীদারত্ব বিবেচনা করা যেতে পারে।

খসড়া নীতিমালায় সেলুলার মোবাইল সার্ভিস লাইসেন্সধারীদের (সিএমএসএল) এন্টারপ্রাইজ ইন্টারনেট সেবায় মোবাইল নেটওয়ার্ক এবং ফিক্সড ব্রডব্যান্ড, দুই ক্যাটাগরিতেই সেবা দেওয়ার অনুমতি দেয়া হয়েছে। অথচ এটি সিএমএসএলধারীদের ফিক্সড টেলিকম সার্ভিস লাইসেন্স (এফটিএসএল) পেতে নিষেধ করেছে। এ ধরনের বিষয়গুলো দেশীয় ফিক্সড ব্রডব্যান্ড সেবাদাতাদের মধ্যে সন্দেহ এবং বিভ্রান্তি তৈরি করবে। এ ক্ষেত্রে আরও স্পষ্ট ও সামঞ্জস্যপূর্ণ পদ্ধতি খুঁজে দেখা উচিত। কারণ অ্যান্টারপ্রাইজ সেবায় মোবাইল অপারেটররা দুই ধরনের নেটওয়ার্কে সেবা দেওয়ার সুযোগ পেলে দেশীয় আইএসপিদের বড় ধরনের ব্যবসায়িক ক্ষতির ঝুঁকি থেকেই যাবে।

এনআইসিএসপি লাইসেন্স শ্রেণি
নীতিমালায় উল্লেখ করা হয়েছে যে, অবকাঠামো কোম্পানিগুলোকে ইউনিয়ন স্তর পর্যন্ত পরিষেবা দিতে হবে। তবে, পূর্ববর্তী অবকাঠামো লাইসেন্সগুলোতেও একই শর্ত অন্তর্ভুক্ত থাকলেও কার্যকরভাবে প্রয়োগ করা হয়নি। এই সমস্যা সমাধানে লাইসেন্সিং কাঠামোকে অঞ্চলভিত্তিক, সীমিত লাইসেন্সে পুনর্গঠন করা যেতে পারে, যেন কোম্পানিগুলো নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে প্রতিটি লাইসেন্সপ্রাপ্ত অঞ্চলকে ইউনিয়ন স্তরে সংযুক্তির ক্ষমতা প্রদর্শন করে, যতক্ষণ না তারা সমস্ত অঞ্চলের জন্য সর্বনিম্ন এক থেকে সর্বোচ্চ লাইসেন্সের জন্য আবেদন করতে পারে। এই মডেলটি সক্ষম নতুন প্রবেশকারীদের জন্য বাজার উন্মুক্ত এবং বর্ধিত বিনিয়োগ ও প্রতিযোগিতাকে উৎসাহিত করতে পারে।


স্থানীয় ইন্টারনেট বিতরণে বিশৃঙ্খলা প্রতিরোধ
খসড়াটি নীতিমালাতে সহজ তালিকাভুক্তির মাধ্যমে তৃণমূল পর্যায়ে ইন্টারনেট বিতরণের জন্য ‘স্মল আইএসপি’র অনুমতি দেয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। এটা হয়তো তৃণমূল পর্যায়ে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের উৎসাহিত করবে; কিন্তু রেগুলেটরি কাঠামো শিথিল হয়ে যাওয়ার পর বড় বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির ঝুঁকিও থেকে যাবে। বিশেষ করে তৃণমূলে ইন্টারনেট সেবার যথাযথ গুণগত মান নিশ্চিত করা, নিরাপদ ইন্টারনেট ব্যবস্থা নিরাপত্তা করার বিষয়টি নিশ্চিত না হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়। তালিকাভুক্তির সহজ সুযোগ নিয়ে একগুচ্ছ প্রতিষ্ঠান তৈরি করে গোষ্ঠী স্বার্থকেন্দ্রিক ব্যবসাও হতে পারে, যেটা জাতীয় পর্যায়ের ফিক্সড ব্রডব্যান্ড লাইসেন্সধারী ব্যসায়িক ক্ষতির মুখে ফেলতে পারে। এ কারণে জাতীয় পর্যায়ে লাইসেন্সপ্রাপ্তদের সঙ্গে স্থানীয় উদ্যোক্তাদের অংশীদারত্ব করার অনুমতি দেয়া উচিত, যা স্থানীয় উদ্যোক্তাদের গুণগত মানসম্পন্ন সেবা নিশ্চিত করবে, একটি রেগুলেটরি কাঠামোর ভেতরেও রাখবে।

সিডিএন এবং ক্যাশ সার্ভার অন্তর্ভুক্তি
খসড়ায় ডাটা সার্ভার, কনটেন্ট ডেলিভারি নেটওয়ার্ক (সিডিএন) এবং স্থানীয় ক্যাশ সার্ভার সম্পর্কিত আলোচনা অগ্রসর পদক্ষেপ। তবে, খসড়া নীতিতে সিডিএন অপারেটরদের জন্য কি ধরনের রেগুলেশন পদ্ধতি হবে সে সম্পর্কে যথেষ্ট বিবরণ নেই। এ বিষয়ে অবশ্যই এখন থেকেই এমন উদ্যোগ নেওয়া হয়, যেন দেশীয় বিনিয়োগকারীরা স্থানীয়ভাবে আন্তর্জাতিক মানের ডাটা সেন্টার তৈরি করতে পারে। স্থানীয়ভাবে বিশ্ব মানের ডাটা সেন্টার হলে আন্তর্জাতিক বড় বড় কনটেন্ট প্ল্যাটফর্মগুলোও এই ডাটা সেন্টার ব্যবহারে উৎসাহী হবে। স্থানীয় কনটেন্ট প্রোভাইডাদের বড় অংশও স্থানীয় প্রতিষ্ঠানের ডাটা সেন্টার হোস্টিং এবং স্টোরেজের জন্য ব্যবহার করতে পারবে। ফলে স্থানীয় পর্যায়ে কনটেন্ট প্ল্যাটফর্মের জন্য বিনিয়োগ উৎসাহিত হবে। ভারচুয়াল প্ল্যাটফর্মে দেশের ব্যবহারকারীদের ডাটা নিরাপত্তাও সুদৃঢ় হবে।

একটি সময়োপযোগী ও বাস্তবস্মত নীতিকাঠামো টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি খাতে দেশে দেশীয় উদ্যোক্তা তৈরি করবে, দেশি এবং বিদেশি উভয় বিনিয়োগকারীদের উৎসাহিত করবে। বিটিআরসির খসড়া নীতিমালাটি প্রয়োজনীয় সংশোধনের মাধ্যমে যথোপযুক্ত করা হলে এই নীতিমালা বাংলাদেশে সত্যিকার অর্থেই ভবিষ্যতের জন্য টেলিযোগাযোগ ইকোসিস্টেমের মজবুত ভিত্তি স্থাপন করতে পারে।

আবু নাজম ম তানভীর হোসেন: পাবলিক পলিসি অ্যাডভোকেট

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ