দুর্বল ব্যাংকগুলোকে রক্ষার মানে ফুটোপাত্রে পানি ঢালা
অর্থনীতিবিদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ড. এম এম আকাশ বলেছেন, ব্যাংকিং খাতের খেলাপি ঋণ আদায়ের জন্য বৃহৎ ঋণখেলাপিদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করতে হবে। বর্তমানে দেশের অধিকাংশ ব্যাংক তারল্য সংকটে পতিত হয়েছে। এদের মধ্যে যেগুলো টিকে থাকার সম্ভাবনা আছে, তাদের নতুন করে অর্থায়ন করা যেতে পারে। আর যেগুলো টিকে থাকার সম্ভাবনা নেই, তাদের ব্যাপারে বিকল্প ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে। ড. এম এম আকাশ ভিউজ বাংলাদেশের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে এ কথা বলেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন, অর্থনীতিবিষয়ক লেখক এম এ খালেক ও ‘ভিউজ বাংলাদেশ’-এর সহকারী সম্পাদক গিরীশ গৈরিক।
ভিউজ বাংলাদেশ: নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব গ্রহণের আর্থিক ক্ষেত্রে বিভিন্ন অনিয়ম-দুর্নীতি চিহ্নিতকরণের জন্য শ্বেতপত্র প্রকাশের উদ্যোগ নিয়েছে। এ জন্য ১২ সদস্যের একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি গঠন করা হয়েছে। শ্বেতপত্রে কী কী বিষয় অন্তর্ভুক্ত হতে পারে বলে মনে করেন?
ড. এম এম আকাশ: শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি জিডিপি প্রবৃদ্ধির বিষয়টি পর্যালোচনা করবে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অর্থনীতির বিভিন্ন ক্ষেত্রে যে সূচক প্রকাশ করেছে, তা কতটা সঠিক এবং বাস্তবসম্পন্ন ছিল, তা পর্যালোচনা করবে। সাধিত উন্নয়ন কতটা টেকসই এবং আগামীতে কীভাবে টেকসই উন্নয়ন অর্জন করা সম্ভব তার সুপারিশ করবে। অর্থাৎ কমিটি ম্যাক্রো ইকোনমি সংশ্লিষ্ট বিষয়াদি পর্যালোচনা করবে। বিগত দিনগুলোতে অর্থনীতির বিভিন্ন ক্ষেত্রে যে অনিয়ম-দুর্নীতি হয়েছে, সেসব ঘটনা এরা উদ্ঘাটন করবে কি না, তা এখনো নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। প্রবৃদ্ধি কেন কম হলো, স্থানীয় এবং বিদেশি বিনিয়োগ কেনো প্রত্যাশিত মাত্রায় হলো না, খেলাপি ঋণের পরিমাণ কেনো কমানো যাচ্ছে না, এসব বিষয় আলোচিত হওয়া প্রয়োজন; কিন্তু শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি এতদূর যাবে কি না সে সম্পর্কে এখনই কিছু বলা যাচ্ছে না। শ্বেতপত্র কনসেপ্টের মধ্যে আছে যারা অতীতের অর্থনীতির বিভিন্ন ক্ষেত্রে অনিয়ম বা দোষ-ত্রুটি করেছেন তাদের খুঁজে বের করা।
ভিউজ বাংলাদেশ: ‘বাংলাদেশ ব্যাংক’ ব্যাংকিং খাতের বিভিন্ন অনিয়ম খুঁজে বের করার জন্য একটি কমিশন গঠনের কথা বলছে। এই কমিশন কতটা কার্যকর হবে বলে মনে করেন?
ড. এম এম আকাশ: নতুন গভর্নর ব্যাংকিং সেক্টরের বিদ্যমান সমস্যার স্বরূপ অনুসন্ধান ও তা প্রতিকারের জন্য পন্থা খুঁজে বের করার জন্য একটি উচ্চ পর্যায়ের কমিশন গঠনের কথা বলেছেন। ব্যাংকিং খাত নানা ধরনের সমস্যায় জর্জরিত হয়ে আছে। এর মধ্যে সবচেয়ে জরুরি সমস্যা কি, তা আমাদের খুঁজে বের করতে হবে। এই মুহূর্তে একটি জটিল বা জরুরি সমস্যা হচ্ছে বেশ কিছু ব্যাংক তারল্য সংকটে ভুগছে। এসব ব্যাংককে যদি তরল অর্থ না দেয়া যায় তাহলে তারা আমানতকারির অর্থ ফেরত দিতে পারবে না। এমনকি দৈনন্দিন কার্যক্রম পরিচালনা করতেও ব্যর্থ হবে। এই অবস্থা চলতে থাকলে আমানতকারিরা একযোগে এসব ব্যাংক থেকে আমানত উত্তোলন শুরু করবে। সেই অবস্থায় সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলো দেউলিয়া হয়ে যাবার আশঙ্কা রয়েছে। দেশে কোনো ব্যাংক দেউলিয়া না হোক আমরা যদি এটা চাই তাহলে প্রথমেই সমস্যাগ্রস্ত ব্যাংকগুলোর জন্য তরল অর্থের জোগান নিশ্চিত করতে হবে; কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, কীভাবে তা করলে ব্যাংকগুলোকে রক্ষাও করা হবে আবার তাদের ফুটোপাত্রে পানি ঢালার মতো বিষয়ও হবে না?
ভিউজ বাংলাদেশ: খেলাপি ঋণ আদায়ের জন্য বিশেষ কী ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে বলে মনে করেন?
ড. এম এম আকাশ: তবে প্রথমেই সরকারকে ঋণখেলাপিদের কাছ থেকে অর্থ আদায় এবং পাচারকৃত অর্থ ফিরিয়ে আনতে হবে। উদ্ধারকৃত অর্থ দিয়ে একটি তহবিল গঠন করতে হবে। তহবিল গঠনের পর প্রয়োজন মতো অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ব্যাংকগুলোকে অর্থায়ন করা যেতে পারে। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর বলেছেন, তারা নতুন করে কোনো টাকা ছাপাবেন না। নতুন করে টাকা ছাপানো হলে মূল্যস্ফীতি আরও বেড়ে যাবার আশঙ্কা থাকবে। তাই বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে খেলাপি ঋণ আদায়ের জন্য যত রকম ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন তা করতে হবে।
যারা বৃহৎ ঋণখেলাপি তাদের গৃহীত ঋণের বিপরীতে কি পরিমাণ সম্পদ আছে তা খুঁজে বের করতে হবে। সেই সম্পদ বিক্রি করে যে অর্থ পাওয়া যেতে পারে তা দিয়ে তার গৃহীত ঋণের অর্থ পুরোটা আদায় করা যাবে কিনা তা যাচাই করে দেখতে হবে। যদি বন্ধকীকৃত সম্পদ বিক্রি করে ঋণ পুরোপুরি আদায় করা না যায় তাহলে তার অন্য স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি বিক্রি করে টাকা আদায়ের ব্যবস্থা করতে হবে। এ ক্ষেত্রে অবশ্য কোর্টের অনুমোদন প্রয়োজন হবে। দরকার হলে বিদ্যমান আইন সংশোধন করা যেতে পারে। আর যদি ঋণ গ্রহীতার নিকট থেকে নগদ অর্থ উদ্ধার করা যেতে পারে তাহলে কোনো ঝামেলায় যেতে হবে না। তবে নগদ অর্থ উদ্ধার হবার সম্ভাবনা খুবই কম। তাই তাদের বাড়ি-ফ্লাট এবং অন্যান্য সম্পদ আটক করে তা বিক্রির ব্যবস্থা করা হলেও টাকা উদ্ধার হতে পারে। সাধারণভাবে ঋণ গ্রহীতারা ঋণের বিপরীতে যে সম্পদ বন্ধক দেয় তা অতিমূল্যায়িত করে দেখানো হয়। কাজেই বন্ধকী সম্পদ বিক্রি করে পুরো ঋণের অর্থ আদায় করা সম্ভব নাও হতে পারে। তাই বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে অন্যান্য দেশি-বিদেশি স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি অধিগ্রহণ করে তা বিক্রি করার উদ্যোগ নিতে হবে। আইনে সেটা সম্ভব না হলে আইন পরিবর্তনের উদ্যোগ নিতে হবে।
ভিউজ বাংলাদেশ: খেলাপি ঋণের পরিসংখ্যান নিয়ে বিভ্রান্তি লক্ষ্য করা যায়। এটা কীভাবে সমাধান করা সম্ভব বলে মনে করেন?
ড. এম এম আকাশ: ব্যাংকিং সেক্টরের খেলাপি ঋণের পরিসংখ্যান নিয়েও বিভ্রান্তি রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশের ব্যাংকিং সেক্টরে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ২ লাখ ১১ হাজার ৩৯১ কোটি টাকা; কিন্তু এই হিসাব কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য বা সঠিক নয়। কারণ অবলোপনকৃত ঋণ হিসাব, পুনঃতপশিলিকৃত হিসাবের কাছে পাওনা অর্থ এবং মামলাধীন প্রকল্পের কাছে দাবিকৃত অর্থ এই হিসাবের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। অনেকেই মনে করেন, আন্তর্জাতিক সংজ্ঞা অনুসারে খেলাপি ঋণ হিসাব করা হলে মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৪ লাখ কোটি টাকা অতিক্রম করে যাবে। খেলাপি ঋণের পরিমাণ কম দেখানোর জন্য দায়ী হচ্ছে খেলাপি ঋণের সংজ্ঞা।
সাম্প্রতিক সময়ে নানাভাবেই আইনি সংস্কারের মাধ্যমে খেলাপি ঋণকে কমিয়ে দেখানোর রাস্তা বের করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক সংজ্ঞা মোতাবেক খেলাপি ঋণকে সংজ্ঞায়িত করা হলে মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ প্রদর্শিত খেলাপি ঋণের চেয়ে অনেক বেশি হবে। তাই আমাদেরকে খুব দ্রুত খেলাপি ঋণের বিদ্যমান সংজ্ঞা পরিবর্তন করে তা আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করতে হবে। সাম্প্রতি ঋণ হিসাব পুনঃতপশিলীকরণের নিয়ম সহজীকরণ করা হয়েছে। ঋণ হিসাব অবলোপনের সময়সীমা কমানো এবং পদ্ধতি সহজীকরণ করা হয়েছে। এসব ক্ষেত্রে পূর্ববর্তী আইনি সংজ্ঞা, যা আইএমএফ বা বিশ্বব্যাংকের পরামর্শে প্রণীত হয়েছিল তা অন্তত এখন থেকে কঠোরভাবে পুনর্বহাল করা যেতে পারে। প্রয়োজনে সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে আইনগুলো আরও কঠিন করা যেতে পারে। কিস্তি আদায়ের মাধ্যমে খেলাপি ঋণ কমানোর পরিবর্তে আইনি মারপ্যাঁচে খেলাপি ঋণ কমিয়ে দেখানোর মধ্যে কোনো বাহাদুরী নেই।
ভিউজ বাংলাদেশ: আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক বা এ ধরনের কোনো কোনো আন্তর্জাতিক সংস্থা প্রতি বছর বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার নিয়ে যে তথ্য প্রকাশ করে বাংলাদেশ সরকারের দেয়া একই তথ্যের সঙ্গে তার গরমিল লক্ষ্য করা যায়। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো যে পরিসংখ্যান প্রকাশ করে বাংলাদেশ সরকারের দেয়া পরিসংখ্যান তার চেয়ে অন্তত এক শতাংশ থেকে দেড় শতাংশ বেশি থাকে। পরবর্তীতে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো তাদের দেয়া পরিসংখ্যান থেকে সরে আসে না। বাংলাদেশ সরকারও তাদের দেয়া পরিসংখ্যানকেই সঠিক বলে প্রচার করে। একই ইস্যুতে দেয়া পরিসংখ্যানের এই ভিন্নতার কারণ কী?
ড. এম এম আকাশ: বাংলাদেশ সরকার তার সাফল্য প্রদর্শনের জন্য কোনো কোনো পরিসংখ্যান অতিমূল্যায়িত করে দেখায়। আবার কোনো কোনো পরিসংখ্যান কমিয়ে দেখায়। যেমন, মূল্যস্ফীতি, বেকারত্বের হার, ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ইত্যাদি পরিসংখ্যান যতটা সম্ভব কমিয়ে দেখানোর চেষ্টা করে। আবার জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার, স্থানীয় ও বিদেশি বিনিয়োগ আহরণের পরিমাণ, রেমিট্যান্স আহরণ ইত্যাদি তথ্য অতিরঞ্জিত করে দেখানো হয়। বিশেষ করে স্বৈরাচারী রাজনৈতিক সরকার আমলে এই ঘটনাগুলো বেশি ঘটে থাকে।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার অর্থনীতির বিভিন্ন সূচকের অর্জিত সাফল্য- ব্যর্থতা সঠিকভাবে চিহ্নিতকরণ এবং প্রকাশের ওপর গুরুত্বারোপ করেছে। আশা করা হচ্ছে, আগামীতে অর্থনীতির বিভিন্ন সূচকের সঠিক পরিসংখ্যান হয়তো আমরা পেতে পারি। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কর্তৃক গঠিত শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির একটি কাজ হচ্ছে বিভিন্ন ক্ষেত্রে যে অতিরঞ্জিত বা মিথ্যা পরিসংখ্যান প্রকাশ করা হয়েছে তা খুঁজে বের করা। শ্বেতপত্র প্রকাশিত হবার পর এ ক্ষেত্রে চূড়ান্ত মূল্যায়ন করা যাবে। গৃহ গণনা, বেকার সমস্যা, খানা আয়-ব্যয় জরিপ ইত্যাদি বিষয়ে যে তথ্য প্রকাশ করা হয় তা নিয়ে বিতর্ক দেখা দেয়। সরকার ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ এবং বিদেশি বিনিয়োগ আহরণের যে পরিসংখ্যান প্রকাশ করে তা কতটা বাস্তবসম্মত তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, অনেক ক্ষেত্রে নিবন্ধিত বিনিয়োগকে বাস্তব বিনিয়োগ হিসেবে দেখানো হয়; কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে বিনিয়োগ প্রস্তাব নিবন্ধিত হলেও তার অধিকাংশই শেষ পর্যন্ত বাস্তবায়িত হয় না।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে