সচিবালয়, এনবিআর ও নগর ভবনে একযোগে আন্দোলন: রাজধানীতে অস্থিরতা
রাজধানী ঢাকার প্রশাসনিক অঙ্গনে অস্থিরতা চলছে। সচিবালয়, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে (ডিএসসিসি) প্রশাসনের এই তিনটি গুরুত্বপূর্ণ প্রাণকেন্দ্রে আন্দোলন চলমান ভিন্ন ভিন্ন ইস্যুতে। নানা দাবিতে কর্মবিরতিতে যাচ্ছেন সিভিল সার্ভিসের ২৫ ক্যাডারের কর্মকর্তা এবং পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও।
দাবি আলাদা আলাদা হলেও একটি বিষয়ে তাদের মধ্যে মিল রয়েছে, ‘সরকারি সিদ্ধান্তে অখুশি কর্মচারীরা এবং তাদের দৃঢ় প্রতিরোধ।’ সোমবারও (২৬ মে) সচিবালয় ও ডিএসসিসিতে একযোগে চলেছে বিক্ষোভ, অবস্থান কর্মসূচি এবং কর্মবিরতি।
তবে রোববার (২৫ মে) কর্মবিরতি প্রত্যাহার করে নিলেও এনবিআরের চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খানকে অপসারণের দাবিতে লাগাতার অসহযোগ কর্মসূচি পালন করতে যাচ্ছেন সংস্থাটির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। সোমবার সংবাদ সম্মেলনে বৃহস্পতিবারের (২৯ মে) মধ্যে তাকে অপসারণের আলটিমেটাম দিয়েছে এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদ।
এদিকে বিভিন্ন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের সাময়িক বরখাস্ত ও বিভাগীয় মামলার প্রতিবাদে এবং কৃত্য পেশাভিত্তিক মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা, ডিএস পুলের কোটা বাতিল ও সব ক্যাডারের সমতা বিধানের দাবিতে মঙ্গলবার (২৭ মে) ও বুধবার (২৮ মে) কলমবিরতি করবেন সিভিল সার্ভিসের ২৫টি ক্যাডারের কর্মকর্তারা। আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদের ব্যানারে তারা ওই দুদিন সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত দেশজুড়ে এ কর্মসূচি পালন করবেন। মঙ্গলবার থেকে সারা দেশে কর্মবিরতির ঘোষণা দিয়েছেন পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও।
‘কালাকানুন’ প্রত্যাহারের দাবিতে উত্তাল সচিবালয়
‘সরকারি চাকরি (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫’-এর খসড়ার প্রতিবাদে এবং সেটি দ্রুত প্রত্যাহারের দাবিতে সচিবালয়ের ভেতরে দ্বিতীয় দিনের মতো বিক্ষোভ মিছিল-সমাবেশ করেন বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রণালয়ের কর্মচারীরা। তারা বলছেন, এই খসড়া অধ্যাদেশটি সরকারি চাকরিজীবীদের জন্য ‘নিবর্তনমূলক ও সংবিধানবিরোধী।’ আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছে বাংলাদেশ সচিবালয় কর্মকর্তা-কর্মচারী সংযুক্ত পরিষদ।
অধ্যাদেশটিতে আত্মপক্ষ সমর্থনের যথাযথ সুযোগ না দিয়েই চাকরিচ্যুতির বিধান, কর্তব্যে বিঘ্ন ঘটানো, ছুটি ছাড়া অনুপস্থিতি- এসব অভিযোগে শাস্তি ও পুনর্বহালের সুযোগ সীমিত বলে মনে করছেন বিক্ষোভকারীরা। তাদের দাবি, এই অধ্যাদেশে সরকারি চাকরিজীবীদের ‘নিরাপত্তা ও মর্যাদা’ হুমকির মুখে পড়েছে। তারা পরিষ্কার বার্তা দিয়েছেন, অধ্যাদেশটি প্রত্যাহার না হলে সচিবালয়ে তালা ঝুলবে।
চেয়ারম্যানের অপসারণ দাবিতে এনবিআরে অচলাবস্থা
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ও অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ বিলুপ্তির পর দুটি নতুন বিভাগ, রাজস্ব নীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা চালু করায় ক্ষোভে ফুঁসছিলেন রাজস্ব কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।
আগারগাঁওয়ে এনবিআর কার্যালয়ে রোববার সকাল ৯টা থেকে দিনভর পূর্ণাঙ্গ কর্মবিরতি করেন তারা। প্রধান ফটকে অবস্থান নিয়ে প্রতিবাদ জানান ১২ মে ঘোষিত ‘এনবিআর বিলুপ্তির অধ্যাদেশ’-এর বিরুদ্ধে। সরকারের পদক্ষেপকে ‘অপেশাদার ও সমন্বয়হীন সংস্কার’ হিসেবে আখ্যা দিয়ে এনবিআরের কর্মীরা বলেন, এতে রাজস্ব ব্যবস্থার অস্থিরতা বাড়বে, দক্ষতা কমবে এবং নিয়ন্ত্রণ দুর্বল হবে। প্ল্যাকার্ড হাতে বিক্ষোভরত কর্মচারীদের ভাষায়- ‘আমরা রাজস্ব সংগ্রাহক, শিকারি নই।’
ওইদিনই সরকার ‘এনবিআর বিলুপ্তির অধ্যাদেশ’ পুনর্বিবেচনার আশ্বাস দিলে আপাতত পূর্ণাঙ্গ কর্মবিরতি স্থগিত করেন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। তবে আগে থেকেই দেয়া জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যানকে অপসারণের দাবিতে অনঢ় তারা।
সংবাদ সম্মেলনে এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদ বলেছে, চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খানের প্রতি বিশ্বাস ও আস্থার চরম সংকট তৈরি হওয়ায় আগামী তিনদিনের মধ্যে তাকে অপসারণের দাবি করা হয়েছে। তিনি অসহযোগিতা, নিয়মতান্ত্রিক কর্মসূচির ব্যাপকতা ও যৌক্তিকতার বিষয়ে সরকারের নীতিনির্ধারকদের সঠিক তথ্য না দিয়ে আড়াল করেছেন। আগের কর্মসূচি অনুসারে এনবিআরের চেয়ারম্যানের সঙ্গে লাগাতার অসহযোগ কর্মসূচি যথারীতি অব্যাহত থাকবে বলেও সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়েছে।
ইশরাক সমর্থকদের অবস্থানে নগর ভবনে তালা
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) নগর ভবনের সামনে চলছে বিএনপির নেতাকর্মীদের টানা অবস্থান কর্মসূচি। তাদের দাবি একটাই, বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেনকে মেয়রের দায়িত্ব দিতে হবে। এই আন্দোলন ১৪ মে থেকে মাঝখানে ৪৮ ঘণ্টার বিরতি দিয়ে অব্যাহতভাবে চলছে।
নগর ভবনের সব ফটকে তালা দিয়ে ‘ঢাকাবাসী’ ব্যানারে বিক্ষোভ চালিয়ে যাচ্ছেন অবস্থানকারীরা। তাদের স্লোগান, ‘জনতার মেয়র ইশরাক হোসেন, হক আদায় করব এবার!’ ফলে বন্ধ ট্রেড লাইসেন্স, জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধন, হোল্ডিং ট্যাক্সসহ সব ধরনের সেবা, নগরবাসীর ভোগান্তি চরমে।
পরবর্তী পদক্ষেপ কী?
সব আন্দোলনকারীরাই স্পষ্টভাবে বলছেন, তাদের দাবি না মানা পর্যন্ত পিছু হটবেন না। এই আন্দোলনগুলোকে তাই নিছক কর্মক্ষোভ হিসেবে দেখা যথেষ্ট নয়, বলছেন বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, এর পেছনে রয়েছে প্রশাসনিক নীতিগত পরিবর্তনের প্রশ্ন, নিয়োগের স্বচ্ছতা, সাংবিধানিক অধিকার এবং রাজনৈতিক স্বার্থ।
সরকারের কাছে এখন চ্যালেঞ্জ দুটি। প্রথমত, আন্দোলনকারীদের যুক্তিগুলো বিবেচনা করে দায়িত্বশীল সংলাপে সমাধান আনা এবং দ্বিতীয়ত, নাগরিক ও প্রশাসনিক কার্যক্রম স্বাভাবিক রাখা।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে