কবি রফিক আজাদের ধানমন্ডির বাসভবন গুঁড়িয়ে দেয়ায় প্রতিবাদের ঝড়
প্রয়াত বীর মুক্তিযোদ্ধা কবি রফিক আজাদের ধানমন্ডির বাড়ির একাংশ ভেঙে ফেলা হয়েছে। বাড়িটিতে প্রায় ২৯ বছর সপরিবারে বসবাস করেছেন রফিক আজাদ। বুধবার (১৫ এপ্রিল) সকালে বাড়িটি ভাঙার কাজ শুরু করে গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ। চার ইউনিটের বাড়িটির একটিতে থাকছেন কবির স্ত্রী দিলারা হাফিজ। বাকি তিন ইউনিট অন্যদের নামে বরাদ্দ রয়েছে। বুধবার বাড়িটির পূর্বাংশের দুটি ইউনিট গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
ধানমন্ডির ১ নম্বর সড়কের ১৩৯/৪এ ঠিকানার বাড়িটিতে (পশ্চিমাংশ) কমবেশি ৫ কাঠা পরিমাণ জায়গা রয়েছে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ১৯৮৮ সালে একতলা এ বাড়িটি রফিক আজাদের স্ত্রী কবি দিলারা হাফিজের নামে সাময়িকভাবে বরাদ্দ দেয় ‘এস্টেট অফিস।’ দিলারা হাফিজ তখন ইডেন কলেজে প্রভাষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। বরাদ্দ কপিতে দেখা যায়, গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের সহকারী পরিচালক এম বেগমের স্বাক্ষর করা এ বরাদ্দ নামায় উল্লেখ করা হয়, এই বরাদ্দের দ্বারা বাসার ওপর কোনো অধিকার বর্তাবে না, তবে পরবর্তী আদেশ না হওয়া পর্যন্ত সেখানে বসবাস করতে পারবেন।
দীর্ঘদিন পর বাড়িটি নিজের বলে দাবি করেন সৈয়দ নেহাল আহাদ নামের এক ব্যক্তি। ২০১২ সালে নিজের মালিকানার পক্ষে আদালতের রায় পান তিনি। এ নিয়ে সৈয়দ নেহাল, হাউজিং অ্যান্ড পাবলিক ওয়ার্কস এবং গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়কে বিবাদী করে মামলা করেন দিলারা হাফিজ। ফলে আদালত বাড়িটির ওপর স্থিতাবস্থা দেন। পরের বছর এই স্থিতাবস্থা স্থায়ী করেন আদালত।
পরবর্তীতে মামলাটি ঢাকার সপ্তম সহকারী জজ আদালতে স্থানান্তরিত হয়। আগামী মে মাসের ২৫ তারিখ এ মামলার সাক্ষ্য গ্রহণের কথা রয়েছে। এসব তথ্য উল্লেখ করে গতকাল মঙ্গলবার গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান, একই মন্ত্রণালয়ের সচিব ও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সচিব বরাবর পৃথক চিঠি দেন দিলারা হাফিজ। এর মাঝেই আজ বুধবার সকালে বাড়িটি উচ্ছেদে অভিযান চালানো হয়।
দিলারা হাফিজ শিক্ষা ক্যাডারের একজন প্রভাষক হিসেবে বাড়িটির বরাদ্দ পেয়েছিলেন। সর্বশেষ সরকারি তিতুমীর কলেজে ৪ বছর অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন শেষে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসেবে চাকরি জীবন থেকে অবসর নিয়েছেন তিনি। তার স্বামী রফিক আজাদ একুশে পদক, বাংলা একাডেমিসহ বহু পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা। বর্তমানে তাদের দুই সন্তান- অভিন্ন আজাদ ও অব্যয় আজাদ প্রবাসে রয়েছেন।
এ বিষয়ে দিলারা হাফিজ বলেন, জাতীয় জীবনে একজন অগ্রগণ্য কবি ও বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিক আজাদ। তার স্মৃতি সংরক্ষণ ও ধারণের জন্য বাড়িটির অংশবিশেষের স্থায়ী বন্দোবস্তের আদেশ পেতে গতকালও তিনি গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের ঘুরেছেন। মামলা চলমান থাকাবস্থায় উচ্ছেদ অভিযান চালানোর আশা করেননি তিনি।
ক্ষোভ-প্রতিবাদ
কবি হেলাল হাফিজের বাসভবন ভাঙায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে কবি সাহিত্যিক সাংবাদিক ও কবির শুভাকাঙ্ক্ষীরা নানা ধরনের বিরূপ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন কবির শুভাকাঙ্ক্ষীরা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে অনেকে ব্যঙ্গ করে লিখছেন ‘সংস্কার চলছে’, ‘ভাঙচুরের সরকার’, ‘সব শেষ করে দিবে ইউনূস গং’, ‘খুব বেদনাদায়ক’ ইত্যাদি।
বীর মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন বলেই কি প্রতিহিংসা- এমন প্রশ্ন রেখে কবি ফারহান ইশরাক ফেসবুক প্রতিক্রিয়ায় জানান, ‘গত জুলাইয়ের পর থেকে বাংলাদেশে যা যা ঘটছে, সেসব দেখে দেখে এক ধরনের বুদ্ধি প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়েছে আমার মধ্য। কোনো কিছুই দেখেই কেন যেন আর অবাক হই না। তবে কবি রফিক আজাদ ও কবি দিলারা হাফিজের বাড়িটি গুঁড়িয়ে দেয়া হচ্ছে দেখে কেমন যেন স্তব্ধ হয়ে গেলাম। বাড়িটি ঐতিহ্য সংবলিত একটি বাড়ি এটিকে মিউজিয়াম বানানো যেত। যেমন করে পৃথিবীর আর সব দেশে এ ধরনের বাড়িগুলোকে সংরক্ষণ করা হয় সেরকম করা যেত। অথচ এটিকে গুঁড়িয়ে দেয়া হলো? এটিকে একটি ঐতিহাসিক স্থাপনা হিসেবে না রেখে শুধু কবি রফিক আজাদ বীর মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন বলেই কি প্রতিহিংসা চরিতার্থ করা হলো কী না, সেটিও ভেবে দেখার বিষয়। মনে হচ্ছে ফেসবুক আবারও আনস্টল করতে হবে। তা নাহলে হয়তো এসব দেখে পাগলই হয়ে যেতে হবে...
কবি সাংবাদিক জাহিদ সোহাগ লিখেছেন, জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের ডিজি থাকাকালীন বরাদ্দের বিষয়টি নিয়ে আমার অস্পষ্টতা থাকলেও হাসিনা-সরকার তাদের উচ্ছেদের সব আয়োজন করেছিল, যা উচ্চ আদালত পর্যন্ত গড়ায়। মনে রাখতে হবে এটি সরকারি সম্পত্তি।
ক্ষোভ প্রকাশ করে কবি মানিক বৈরাগী বলেন, বর্তমান তদারকি সরকার কি একজন প্রয়াত কবিকেও ভয় পাচ্ছেন? কবি রফিক আজাদ একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা, প্রয়াত হয়েছেন অনেক আগে। বাংলার ঐতিহ্য রফিক আজাদ বিগত সরকারের আমলারাও এ বাড়িটি দখল করতে চেয়েছিল, আদালত রফিক আজাদ কে সম্মান করেছিলেন। আর বর্তমান সরকার যা চাইবে তা-ই হবে। শুধু থাকে গ্রামীণ ব্যাংক আর ইউনূস সেন্টার। তিনি আরও বলেন, উল্লেখ্য মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়ে কবি রফিক আজাদের টাঙ্গাইলের গ্রামের বাড়ি লুট করেছিল হানাদার বাহিনী এবং পুড়িয়ে দিয়ে ক্ষান্ত হয়েছিলেন। যখন রফিক আজাদের বাড়ি পুড়িয়ে দিচ্ছে, তখন তিনি কাদেরিয়া বাহিনীর যোদ্ধা হিসাবে মুক্তিযুদ্ধে ছিলেন।
বাসভবনটিতে রফিক আজাদের নামে কালচারাল সেন্টার বানানোর দাবি জানিয়ে কবি আহমেদ শিপলু বলেন, এটা সরকারি হলেও সংরক্ষণ করে এখানে রফিক আজাদের নামে কালচারাল সেন্টার বানানো যায়। এখনও সময় আছে। কথা বলতে হবে। এটাকে যদি নিশ্চিহ্ন করা হয়, তবে তা বাজে উদাহরণ হবে। ধানমন্ডির মতো জায়গায় বাড়ি, মার্কেট, অ্যাপার্টমেন্টের অভাব নেই, কিন্তু ‘ভাত দে হারামজাদা’র কবি, প্রেম ও দ্রোহের কবি রফিক আজাদের বাড়ি আর একটা হবে না। এরা জাতির সম্পদ। প্রয়োজনে এটাকে ট্রাস্টির আন্ডারে দিয়ে দিক।
বিষয়টিকে ভিন্নভাবে দেখছেন গবেষক মীর শামছুল আলম বাবু। তিনি ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, এটা সরকারি বাড়ি সরকার বরাদ্দ দিয়েছিল। সরকারি বাড়ি সরকার বরাদ্দ বাতিল করে ফেলেছে। বিল্ডিং করার জন্য ভেঙে ফেলা হচ্ছে। আইনগত কোন ব্যত্যয় নেই। সরকারি বাড়ি সরকার যদি কাউকে বরাদ্দ দেয়, তারপর যদি সরকার বরাদ্দ বাতিল করে সরকার সেখানে অন্যকিছু বানাতেই পারে। আইনগত কোন অসুবিধা নাই। এরকম অনেক বাড়ি আছে পাকিস্তান আমলে যেমন গুলিস্তান সিনেমা হলও পাকিস্তানিদের সম্পত্তি ছিল পরে এটা ভেঙে বিল্ডিং বানিয়েছে। সেটাই নিয়ে তো আমরা কোনো প্রতিবাদ দেখাইনি। তাই না?
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে