টানা চতুর্থ দিনের মতো সচিবালয়ে বিক্ষোভ, স্থবির কার্যক্রম
চার দিন ধরে সচিবালয়ের ভেতর ও বাইরে কর্মচারীদের ঢল। স্লোগানে মুখর চারপাশ- ‘চাকরি চাই নিরাপত্তা, আইন চাই সহমর্মিতা’, ‘দমনমূলক আইন মানি না, মানব না- প্রতিধ্বনি যেন পুরো প্রশাসনিক কাঠামোকে নাড়িয়ে দিচ্ছে। সরকারি কর্মচারীদের আচরণ বিধিমালা সংশোধনের নামে পাস হওয়া অধ্যাদেশকে কেন্দ্র করে উদ্ভূত এই অচলাবস্থা প্রশাসনের জন্য এক নতুন সংকেত হয়ে উঠছে। এমন অস্থির পরিস্থিতিতে আইন ও বিচার বিভাগের সচিব শেখ আবু তাহেরকে প্রধান করে ‘সরকারি চাকরি (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫’ বাতিলের দাবিতে কর্মচারীদের লাগাতার আন্দোলনের মধ্যে এই অধ্যাদেশ পর্যালোচনায় একটি কমিটি গঠন করতে যাচ্ছে সরকার।
বিক্ষোভের সূচনা ও প্রেক্ষাপট
সর্বশেষ ২০২৫ সালের মে মাসের মাঝামাঝি সময়ে সরকার একটি অধ্যাদেশ জারি করে যার মাধ্যমে সরকারি চাকরিজীবীদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নিয়মাবলিতে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনা হয়। নতুন এই অধ্যাদেশে কিছু শর্তাবলি সংযোজন করা হয়েছে যা বহু কর্মচারীর মতে, তাদের ‘চাকরি নিরাপত্তা’র পরিপন্থি। বিশেষ করে, সামান্য অভিযোগের ভিত্তিতেও চাকরিচ্যুতির সম্ভাবনা তৈরি হওয়ায় অসন্তোষ তৈরি হয়েছে।
‘সরকারি চাকরি (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫’ অনুমোদনের প্রতিবাদে সচিবালয়ে সোমবারও (২৬ মে) বিক্ষোভ সমাবেশ করবে বাংলাদেশ সচিবালয় কর্মকর্তা-কর্মচারী সংযুক্ত পরিষদ। ‘নিবর্তনমূলক ও কালাকানুন’ আখ্যায়িত করে এই অধ্যাদেশ প্রত্যাহারের দাবি জানায় সংগঠনটি। এছাড়া কর্মচারীদের রেশন ও সচিবালয় ভাতা চালুর দাবিও জানান তারা।
উল্লেখ্য, সরকারি চাকরি অধ্যাদেশ (সংশোধন) ২০২৫ জারি করেছে সরকার। রোববার (২৫ মে) সন্ধ্যায় অধ্যাদেশটি জারি করেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন। অধ্যাদেশে চার অপরাধের জন্য চাকরিচ্যুতির বিধান রাখা হয়েছে। অধ্যাদেশটির পুরো নাম হবে ‘সরকারি চাকরি (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫’। সচিবালয় কর্মকর্তা-কর্মচারী সংযুক্ত পরিষদের আহ্বানে ২৪ মে থেকে সচিবালয়ের বিভিন্ন শাখা, অধিদপ্তর ও মন্ত্রণালয়ের শত শত কর্মচারী কর্মবিরতি ও অবস্থান কর্মসূচিতে অংশ নিচ্ছেন। এতে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন সংযুক্ত পরিষদের সভাপতি বাদিউল কবীর ও মহাসচিব নিজাম উদ্দিন আহমেদ।
ঘটনাস্থল থেকে চিত্র: প্রশাসনিক স্তব্ধতা
সচিবালয়ের মূল ভবনের সামনে কয়েকশ কর্মচারী সকাল ৯টা থেকেই জড়ো হন। কাঁধে ঝুলানো ব্যাগ, হাতে ফাইল, কিন্তু গন্তব্য অফিস ডেস্ক নয়, বরং বিক্ষোভস্থল। ভেতরে ঢুকেও কেউ কাজ করছেন না- বিভিন্ন বিভাগের গেটের সামনে দাঁড়িয়ে ফ্লেক্স ও ব্যানার হাতে অবস্থান করছেন কর্মচারীরা। বাংলাদেশ সচিবালয় কর্মকর্তা-কর্মচারী সংযুক্ত পরিষদের সভাপতি বাদিউল কবীর বলেছেন, ‘আমাদের দাবি ক্লিয়ার, আর তা হলো কেবিনেটে অনুমোদন পাওয়া কালো আইন বাতিল করতে হবে।’ আজকের কর্মসূচি স্বাভাবিক নিয়মেই চলবে বলেও জানান তিনি।
সকাল থেকেই কিছুক্ষণ পর পর সংযুক্ত পরিষদের সভাপতি বাদিউল কবীর ও মহাসচিব নিজাম উদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ মিছিল অনুষ্ঠিত হচ্ছে। মিছিলটি পুরো সচিবালয় প্রদক্ষিণ করছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, “আমরা সরকারি সেবক, দেশের জন্য কাজ করি। কিন্তু এমন আইন কার্যকর করা হলে আমাদের মত সাধারণ কর্মচারীরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগবে। একটি লিখিত অভিযোগই যথেষ্ট হবে চাকরি হারানোর জন্য- এটা কি ন্যায্য?”
পরিস্থিতি এমন জায়গায় পৌঁছেছে যে সচিবালয়ের বহু গুরুত্বপূর্ণ ফাইলপত্র আটকে গেছে। কোনো নথিপত্র স্থানান্তর হচ্ছে না, অর্থ ছাড় কিংবা প্রশাসনিক চিঠিপত্রের কাজ স্থবির হয়ে পড়েছে। এমনকি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সঙ্গে সমন্বয়ের কাজও ব্যাহত হচ্ছে বলে জানা গেছে।
কর্মচারীদের ক্ষোভের নেপথ্য গল্প
সচিবালয় কর্মচারী সূত্র বলছে, সরকারি কর্মচারীদের অভিযোগ, প্রশাসনিক দুর্নীতি রোধ করার অজুহাতে যে বিধিমালা আনা হয়েছে, সেটি মূলত 'নিম্নপর্যায়ের কর্মচারীদের ঘাড়ে' চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। একজন অফিস সহায়ক, একজন সহকারী সচিব, বা একজন প্রশাসনিক কর্মকর্তা- সবাই সমানভাবে হুমকির মুখে পড়েছেন।
শাহানাজ পারভীন, সচিবালয়ের একজন অফিস সহকারী বলেন, “আমাদের ছোট একটি ভুল বা কারও অপছন্দের কারণে চাকরি যাবে- এমন শঙ্কায় কে কাজ করবে? আমাদের বিচার চাইলে আইনগত নিরাপত্তা থাকা জরুরি।”
কয়েকজন কর্মচারী জানিয়েছেন, ইতিমধ্যে কয়েকজনকে সাময়িক বরখাস্ত করার নোটিশ দেওয়া হয়েছে, যা পরিস্থিতিকে আরও উত্তপ্ত করেছে।
সরকারের অবস্থান
অস্থির পরিস্থিতি নিরসনে আইন ও বিচার বিভাগের সচিব শেখ আবু তাহেরকে প্রধান করে ‘সরকারি চাকরি (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫’ বাতিলের দাবিতে কর্মচারীদের লাগাতার আন্দোলনের মধ্যে এই অধ্যাদেশ পর্যালোচনায় একটি কমিটি গঠন করতে যাচ্ছে সরকার। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, “অধ্যাদেশটি মূলত প্রশাসনিক জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার জন্যই করা হয়েছে। এতে কোনো কর্মচারীকে অন্যায়ভাবে চাকরিচ্যুত করার সুযোগ নেই। বরং এটি দুর্নীতিবিরোধী পদক্ষেপের অংশ।”
জনসাধারণ ও সেবার প্রভাব
এই আন্দোলনের প্রভাব পড়েছে সাধারণ সেবাগ্রহীতাদের ওপরও। সচিবালয়ে বিভিন্ন সেবার জন্য আগত নাগরিকরা ভোগান্তির মুখে পড়েছেন। কুষ্টিয়া থেকে আগত কৃষি বিভাগের সঙ্গে দেখা করতে আসা আবুল হোসেন বলেন, “তিন দিন ধরে অফিসে এসে ঘুরছি। কেউ কথা বলে না, ফাইল নিচ্ছে না। বেতন বাড়ল কি কমল তাতে আমার লাভ নাই, আমি তো শুধু আমার সমস্যার সমাধান চাই।” একই অভিযোগ নিয়ে এসেছেন ময়মনসিংহের মোজাম্মেল হোসেন, যিনি ভূমি মন্ত্রণালয়ের একটি বিষয় নিয়ে আসেন। “সরকারি অফিস মানেই দেরি, এখন তো একেবারে বন্ধ। আমরা কোথায় যাব?”
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের দৃষ্টিতে
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও প্রশাসনিক বিশেষজ্ঞ ড. রওশন আরা চৌধুরী বলেন, “এটি শুধু প্রশাসনিক নয়, একটি রাজনৈতিক সংকেতও। দীর্ঘদিন ধরে যে আমলাতান্ত্রিক কাঠামো এক ধরনের 'অস্পষ্ট' ক্ষমতা চর্চা করেছে, সেখানে এখন নিয়ন্ত্রণ আরোপের প্রচেষ্টা চলছে। তবে এই প্রয়াস যদি কর্মচারীদের মধ্যে অনিশ্চয়তা তৈরি করে, তবে তা বুমেরাং হতে পারে।” তিনি আরও বলেন, “সরকারের উচিত ছিল আলোচনার মাধ্যমে ধাপে ধাপে এই সংস্কার প্রক্রিয়া চালানো।”
সরকারের ভবিষ্যৎ করণীয়
সূত্রমতে, প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর থেকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে কর্মচারীদের সঙ্গে আলোচনার উদ্যোগ নিতে। এরই অংশ হিসেবে অধ্যাদেশ পর্যালোচনায় একটি কমিটি গঠন করতে যাচ্ছে সরকার।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সরকার যদি দ্রুত কোনো সমঝোতায় না পৌঁছায়, তবে এই আন্দোলন আরও ছড়িয়ে পড়তে পারে, যা প্রশাসনিক কার্যক্রমকে দুর্বল করে তুলবে।
'গ্যাং অব সেভেন'
সরকারি চাকরি বিধিমালার সংশোধনী নিয়ে গঠিত আন্দোলন আপাতদৃষ্টিতে কর্মচারীদের স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদ হলেও, এর নেপথ্যে কাজ করছে একটি সংগঠিত গোষ্ঠী বলে কানাঘুষা চলছে। এরা সচিবালয়ে পরিচিতি ‘গ্যাং অব সেভেন’ নামে পরিচিত। জানা গেছে, সচিবালয়ের সাতজন সিনিয়র প্রশাসনিক কর্মকর্তা এই আন্দোলনের মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে কাজ করছেন।তাদের মধ্যে রয়েছেন দুইজন যুগ্ম সচিব, তিনজন উপসচিব ও দুজন অতিরিক্ত সচিব, যাদের সবাই মূলত ২৫-৩০ বছরের প্রশাসনিক অভিজ্ঞতাসম্পন্ন এবং বিগত সরকারগুলোতেও 'সেটেলড' ক্যাডার হিসেবে পরিচিত।
সচিবালয়ের একটি পক্ষের দাবি, এই ‘গ্যাং অব সেভেন’ কৌশলে আন্দোলনের মাধ্যমে নিজেদের অবস্থানকে আরও শক্তিশালী করতে চাইছে। তারা মনে করছেন, নতুন আইন কার্যকর হলে তাদের অনেকের বিরুদ্ধে পুরোনো অনিয়ম, অপ্রকাশিত সম্পদ ও রাজনৈতিক যোগাযোগ ব্যবহারের অভিযোগ উঠে আসবে। ফলে তারা সচেতনভাবেই এই আইনের বিরুদ্ধে গণবিক্ষোভের পটভূমি তৈরি করেছেন।
একজন আন্দোলনরত কর্মচারী বলেন, “আমরা জানতাম না এই আন্দোলনের আড়ালে আরেকটা খেলা চলছে। কয়েকজন কর্মকর্তা অনেক আগে থেকেই আমাদের বলতেন এই আইন এলে সবাই বিপদে পড়বে। এখন বোঝা যাচ্ছে, এটা শুধু আমাদের স্বার্থ না, বরং তাদের নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করাও বড় কারণ।” এসব কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলা সম্ভব না হওয়ায়, তাদের ব্যাপারে বিস্তারিত প্রকাশ করা সম্ভব হচ্ছে না। তবে সচিবালয়ে এরকম গোষ্ঠীর ইতিহাস নতুন কিছু নয়। অতীতে প্রশাসনিক নিয়োগ, পদোন্নতি, বিশেষ বরাদ্দ কিংবা আন্তর্জাতিক প্রশিক্ষণ প্রাপ্তির ক্ষেত্রে এদের একচ্ছত্র দাপট ছিল। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে তাদের নিজস্ব লোক বসিয়ে রাখার অভিযোগও রয়েছে।
এই গোষ্ঠীর সদস্যদের কেউ কেউ অতীতে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের ঘনিষ্ঠ ছিলেন, আবার কেউ বিরোধী দলের সরকারের সময়ও সুবিধাভোগী ছিলেন। ভেতরের লোকজন বলছেন, তারা প্রশাসনের মধ্যেই একটি ‘ছায়া সরকার’ গঠন করতে চায়- যেখানে নীতিনির্ধারণ নয়, ‘নিয়ন্ত্রণ’ই তাদের লক্ষ্য। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, প্রশাসনে এমন গোষ্ঠীর সক্রিয়তা একদিকে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে, অন্যদিকে সাধারণ কর্মচারীদের ন্যায্য আন্দোলনকে বিভ্রান্তিকর করে তোলে।
মহাপরিচালকের সতর্কবার্তা ও গোয়েন্দা নজরদারি
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের এক অভ্যন্তরীণ মেমোতে দেখা গেছে, সচিবালয়ে কর্মচারীদের মধ্যে উসকানিমূলক আচরণ ও বিভ্রান্তি সৃষ্টির পেছনে কিছু সিনিয়র কর্মকর্তার ‘অস্বাভাবিক সক্রিয়তা’ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ইতোমধ্যে কয়েকজন কর্মকর্তার ওপর গোয়েন্দা নজরদারি শুরু হয়েছে। সরকার চাইছে আন্দোলনকে দমন না করে, এর নেতৃত্ব ও পৃষ্ঠপোষকদের চিহ্নিত করে আলাদা কৌশলে মোকাবিলা করতে। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের একজন কর্মকর্তা বলেন, “বেশ কিছু চক্র আছে যারা নীতিগত সংস্কার পছন্দ করে না। তারা চায় না প্রশাসনে স্বচ্ছতা আসুক।
সরকার চায় গঠনমূলক আলোচনা, কিন্তু এসব গোষ্ঠী আন্দোলনের মাধ্যমে একটি বেনিফিট বের করতে চায়।” এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, কর্মচারীদের দাবি অন্যায্য নয়, তবে রাষ্ট্রের প্রশাসনিক কাঠামোর প্রাণকেন্দ্র সচিবালয়ের অচলাবস্থা কোনোভাবেই কাম্য নয়। সরকার ও কর্মচারীদের মধ্যে সুসংহত সংলাপ ছাড়া এই সমস্যা থেকে উত্তরণ সম্ভব নয়। নীতিনির্ধারকদের এখন প্রয়োজন কৌশলী ও মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি। এই মুহূর্তে দরকার প্রশাসন ও কর্মচারীদের মধ্যকার একটি আস্থাভাজন সমঝোতা- যেখানে কর্মচারীরা নিরাপদ থাকবেন এবং প্রশাসন স্বচ্ছ থাকবে।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে