'দাবি আদায়ের' বিক্ষোভে স্বাস্থ্য খাতে অচলাবস্থা
স্বাস্থ্য খাতজুড়ে চলছে অস্থিরতা। বিশেষ করে সরকারি হাসপাতালগুলোতে প্রশাসনিক বিশৃঙ্খলার কারণে চিকিৎসাসেবা ব্যাহত হচ্ছে। প্রায় প্রতিদিনই হাসপাতালগুলোর সামনে বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে জড়ো হচ্ছেন বিক্ষুব্ধ কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। অস্থিরতার পরিস্থিতির কারণে সাধারণ চিকিৎসকরাও হাসপাতালে আসতে ভয় পাচ্ছেন। অনেকে কর্মস্থলে এসে হেনস্তার শিকার হচ্ছেন। ফলে ব্যাহত হচ্ছে চিকিৎসাসেবা।
গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর, দেশজুড়ে চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যসেবা কর্মীদের একাংশ লাগাতার বিক্ষোভ ও অবস্থান কর্মসূচি পালন করে আসছে। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দায়িত্ব পাওয়া চিকিৎসক, স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের দুর্নীতিবাজ আখ্যায়িত করে বিভিন্ন প্রশাসনিক পদে ব্যাপক রদবদল চাচ্ছেন তারা। এসব বিক্ষোভের কারণে পুরো স্বাস্থ্য খাত মূলত একটি অচলাবস্থার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। স্বাস্থ্যসেবা খাতের এই সংকট নিয়ে ভিউজ বাংলাদেশ তিন কিস্তির একটি বিস্তারিত প্রতিবেদন তৈরি করেছে। আজ প্রকাশিত হচ্ছে প্রথম কিস্তি।
রাজনৈতিক অস্থিরতা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে কার্যত অচল করে ফেলেছে:
স্বাস্থ্যসেবা অধিদপ্তর বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীন বৃহত্তম প্রশাসনিক সংস্থা। এই সংস্থার প্রধান কাজ হলো- বিভিন্ন স্বাস্থ্য কর্মসূচির বাস্তবায়ন, স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা, পরিকল্পনা এবং বিভিন্ন নীতির বাস্তবায়ন। এর পাশাপাশি এই প্রতিষ্ঠান স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে প্রযুক্তিগত সহায়তা প্রদান করে।
সরেজমিন খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, গত ৭ আগস্ট থেকেই প্রশাসনে ব্যাপক রদবদলের দাবি নিয়ে আন্দোলনে নামে স্বাস্থ্য খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কয়েক ডজন সংগঠন। আওয়ামী লীগপন্থি চিকিৎসক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের অপসারণের দাবিতে প্রতিদিনই এসব বিক্ষোভ চলছে। তাদের এই বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ সমাবেশ চলছে অফিস সময়ের মধ্যেই। গত ১১ আগস্ট তিন দফা দাবিতে মহাখালীতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করে সরকারি চিকিৎসকদের সংগঠন বিসিএস হেলথ ক্যাডার অ্যাসোসিয়েশন। গত ১৩ আগস্ট মহাপরিচালক এ বি এম খুরশীদ আলমের পদত্যাগসহ দুই দফা দাবিতে কর্মবিরতি শুরু করেন তারা।
গত ১৭ আগস্ট ব্যাপক প্রতিবাদের মুখে ডিজিএইচএসের মহাপরিচালক হিসেবে অধ্যাপক এ বি এম খুরশিদ আলমের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল করা হয় এবং পরের দিনই অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ বিভাগের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ রোবেদ আমিনকে নতুন মহাপরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়; কিন্তু এই নিয়োগেও আপত্তি জানিয়ে আন্দোলনকারীরা অবস্থান কর্মসূচি অব্যাহত রাখেন।
গত ১৯ আগস্ট স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নুরজাহান বেগম মহাখালী ডিএনসিসি কোভিড হাসপাতালে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে আহতদের চিকিৎসার বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে বসেন। অধিদপ্তরের বিদায়ী ও নতুন মহাপরিচালক অন্যান্য কর্মকর্তা ও কর্মচারীসহ সেখানে উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকের একপর্যায়ে বিক্ষুব্ধ আন্দোলনকারীরা সভাকক্ষে ছুটে আসেন এবং স্বাস্থ্য উপদেষ্টার উপস্থিতিতেই বিক্ষোভ করেন। এ সময় বিক্ষোভকারীদের একজন অধিদপ্তরের জনসংযোগ কর্মকর্তা আক্কাস আলীর দিকে ছুটে এসে তাকে লাঞ্ছিত করেন বলেও ঘটনার একাধিক প্রত্যক্ষদর্শী জানিয়েছেন।
এই বিক্ষোভের মধ্যেই গত ২২ আগস্ট অন্তর্বর্তীকালীন সরকার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের উচ্চপর্যায়ের কয়েকটি পদে ব্যাপক রদবদল আনেন। অধিদপ্তরের দুই অতিরিক্ত মহাপরিচালক- অধ্যাপক ডক্টর আহমেদুল কবির (প্রশাসন) ও প্রফেসর ডা. মীরজাদি সেব্রিনা ফ্লোরা (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) এবং আরও চার সিনিয়র কর্মকর্তাকে বদলি করা হয়। এরপরেও অধিদপ্তরের মহাপরিচালকসহ অন্যান্য কর্মকর্তা অফিসে প্রবেশ করতে পারছেন না বলে জানা যায়। কারণ হিসেবে তারা বলছেন, চিকিৎসক ও কর্মচারীদের একটি গ্রুপ এখনো নতুন নিয়োগ পাওয়া মহাপরিচালক রোবেদ আমিনসহ আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে নিয়োগ পাওয়া কর্মকর্তাদের পদত্যাগ দাবি করে বিক্ষোভ চালিয়ে যাচ্ছেন।
নিরাপত্তা উদ্বেগ:
গত ২২ আগস্ট সরেজমিন স্বাস্থ্য অধিদপ্তর পরিদর্শন করে ভিউজ বাংলাদেশ দেখতে পেয়েছে যে বিক্ষোভকারীরা প্রধান প্রবেশদ্বারের সিঁড়িতে অবস্থান নিয়েছে এবং বিভিন্ন স্লোগান দিচ্ছে। বিভিন্ন সংগঠনের ব্যানারে এই বিক্ষোভে ঢাকার বাইরেরসহ বিভিন্ন হাসপাতালের চিকিৎসক ও কর্মীরা উপস্থিত ছিলেন। বেশির ভাগ সংগঠনই নবগঠিত।
ভিউজ বাংলাদেশের সঙ্গে কথা বলার সময় বেশিরভাগ অংশগ্রহণকারী নিশ্চিতভাবে বলেননি, কেন তারা এই রদবদলের দাবি তুলেছেন। তাদের বক্তব্য নিতে চাইলে পত্রিকার কাছে তাদের পরিচয় প্রকাশ না করার জন্য অনুরোধ করেন। ভেতরে সরেজমিন দেখা গেছে, পরিচালক, প্রোগ্রাম ম্যানেজার, ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজারসহ অধিকাংশ কর্মকর্তাই সেখানে অনুপস্থিত। কর্মচারীদের কাছে জানতে চাইলে তারা বলেন, নিরাপত্তার অভাব বোধ করাতে বেশিরভাগ কর্মকর্তাই আসছেন না আর যারা আসছেন, তারা আন্দোলন করছেন। ফলে কাজের কোনো অগ্রগতি হচ্ছে না।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, ‘আমাদের কিছু সহকর্মী বিক্ষোভকারীদের দ্বারা লাঞ্ছিত হওয়ার কারণে আমাদের মধ্যে নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। আমরা ১৫ দিন থেকে কাজে যোগ দিতে পারছি না। কয়েকজন কর্মকর্তা হয়তো দুর্নীতিগ্রস্ত; কিন্তু সামগ্রিকভাবে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে নিয়োগ পাওয়া সব কর্মকর্তাই অপরাধী- এমনটা ভাবা ঠিক হবে না। তাদের অনেকেই সততার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করছেন। এভাবে কর্মীরা কর্মক্ষেত্রে এসে লাঞ্ছিত হলে অচলাবস্থা কাটবে না।’
‘স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সারা দেশে স্বাস্থ্য পরিষেবাগুলোকে সচল রাখতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এক অর্থে, বর্তমান পরিস্থিতি স্বাস্থ্য খাতকে একটি অচলাবস্থায় ফেলেছে। তাই আমরা আশা করি, সরকার এ বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ নেবে’, যোগ করেন এই কর্মকর্তা।
সার্বিক পরিস্থিতি সম্পর্কে স্বাস্থ্য অধিকার আন্দোলনের সভাপতি অধ্যাপক ডা. রশিদ-ই-মাহবুব ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, এগুলো স্বাস্থ্য খাতে দীর্ঘদিনের সমস্যা। ‘এসব থেকে বেরিয়ে আসতে হলে দলীয় লোকদের শীর্ষ পদে বসানোর অভ্যাস থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। বর্তমান সংকটকে অল্প সময়ের মধ্যে সমাধান করতে হবে।’ তিনি আরও বলেন, স্থায়ীভাবে সমস্যার সমাধান না হলে সংকট অব্যাহত থাকবে।
বিস্তারিত জানতে ভিউজ বাংলাদেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক রোবেদ আমিনসহ একাধিক শীর্ষ কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছে। তবে তাদের কারও বক্তব্য পাওয়া সম্ভব হয়নি।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে