মেলায় বই বিক্রিতে ‘চরম হতাশ’ প্রকাশকরা
একদিকে ছুটির দিন শুক্রবার ও অন্যদিকে বইমেলার শেষ দিন হিসেবে প্রকাশকদের আশা ছিল অন্তত ক্রেতা-দশনার্থীদের পদচারণায় মুখর হয়ে উঠবে বইমেলা। বিক্রি হবে প্রচুর বই; কিন্তু প্রত্যাশা অনুয়ায়ী বইমেলায় ক্রেতা-দর্শনার্থী ছিল অনেকটা ফাঁকা। অধিকাংশ প্রকাশকরাই বই বিক্রিতে ‘চরম হতাশা’প্রকাশ করেছেন। যদিও সন্ধ্যার দিকে কিছুটা দর্শনার্থী এসেছিল; কিন্তু বিক্রির পরিমাণ ছিল খুবই কম।
অধিকাংশ প্রকাশক বলছেন, গত বছরের তুলনায় বিক্রি এবার প্রায় অর্ধেক। করোনার সময়ও এর চেয়ে বেশি বই বিক্রি হয়েছে। মেলার শেষ দিন শুক্রবার (২৮ ফেব্রুয়ারি) প্রকাশক-লেখকরা বই বিক্রিতে হতাশার কথা জানিয়েছেন।
প্রথমা প্রকাশনীর স্টলকর্মীরা জানান, আমাদের প্রকাশনী থেকে রাজনৈতিক বইগুলো বেশি প্রকাশিত হয়; কিন্তু এবার রাজনৈতিক পরিবর্তন ও নানা কারণে পাঠক কমেছে, বিক্রিও কমেছে। এবারের বইমেলার বেচা-বিক্রিতে প্রকাশকরা হতাশ। ‘অন্যধারা’ ‘আগামী প্রকাশনী, ‘মাওলা ব্রাদার্স’, ‘কথাপ্রকাশ’সহ আরও কয়েকটি প্রকাশনীর স্টলকর্মীরাও বিক্রিতে হতাশা প্রকাশ করেছেন।
বই বিক্রিতে চরম হতাশার কথা জানিয়ে বিদ্যাপ্রকাশনীর প্রকাশক মজিবুর রহমান খোকা ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, সবসময় যেটা হয়, রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর বই বিক্রি বাড়ে, এবারে সেটা হয়নি। মেলার ২৮ দিনে বিক্রির অবস্থা খুবই হতাশাজনক। বলা যায়, আমার জীবনে দেখা এরকম এক সুন্দর পরিবেশ যেখানে রাজনৈতিক অস্থিরতা নেই, কিচ্ছু নেই- স্বাভাবিক আছে দেশ তারপরও ক্রেতা নেই।
ক্রেতা না থাকার কারণ হিসেবে খোকা বলেন, অনেক লেখক অনেক প্রকাশক অনেক পাঠক এবারের বইমেলায় আসেনি। না আসার কী কারণ সেটা ভিন্ন ধরনের; কিন্তু তাদের আনার জন্য সেরকম কোনো উদ্যোগ-পরিবেশও তৈরি করা হয়নি। এই পরিবেশটি যদি থাকত, এবারের বইমেলা খুব চমৎকার হতো, সেটি হয়নি। বিভিন্ন কারণের সঙ্গে এ কারণগুলো যুক্ত আছে।
তিনি আরও বলেন, একদিকে শেষ, অন্যদিকে শুক্রবার সকাল থেকে প্রচণ্ড ভীড় থাকার কথা অথচ পুরো মাঠে হাতে গোনা যাবে কতজন পাঠক ক্রেতা আছে। আমরা খুবই হতাশ। করোনার সময় যে অবস্থা ছিল ঠিক ও রকমের চেয়েও খারাপ বলা যায় এবারের বইমেলাটি।
বই কম বিক্রির বিষয়টি স্বীকার করে দুটি কারণ উল্লেখ করে লেখক গবেষক তপন বাগচী বলেন, বই যে কম বিক্রি হয়েছে, সেটি অমূলক নয়। ১৯৮৫ সাল থেকে প্রায় ৪০ বছর কোনোদিন মেলা মিস করিনি। প্রতিদিনের অবজারভেশনে যেটা দেখলাম বইমেলার বিক্রি সত্যিকার অর্থে কম। দুটি বড় কারণ। একটি হলো, পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে অনেকে আশঙ্কার কারণে পর্যাপ্ত বই বের করেনি।
আরেকটি কারণ হলো, অনেকে আসেনি মেলায়। নানারকম মানসিক ভীতি ছোটখাটো দুর্ঘটনা, দুর্ঘটনার আশঙ্কায় অনেকে মেলায় শারীরিকভাবে আসেনি। কেউ কেউ ঘোষণা দিয়ে আসেননি। জনপ্রিয় লেখক যাদের দেখলে অটোগ্রাফের জন্য ছুটে যায়, সেই লেখকদের এবারের মেলায় দেখা যায়নি। জাফর ইকবাল, নির্মলেন্দু গুণ, আনিসুল হক, সেলিনা হোসেন, মইনুল আহসান সাবের, তাদের একদিনও মেলায় দেখা যায়নি। তারা এলে মেলায় অনেকে ভীড় করে অটোগ্রাফ নেয় উৎসবে পরিণত হয়। সেই উৎসবের কিছুটা ঘাটতি ছিল।
তিনি আরও বলেন, শেষ দিকে দেখা গেছে বৃষ্টি, রোজা শুরু হবে মানসিক প্রস্তুতি এরকম নানান কারণে বই বিক্রির পরিমাণ সত্যিকারার্থে কমে গেছে কিন্তু অনলাইনে কিনছে।
কথাসাহিত্যিক মোহিত কামাল বলেন, গত ৩৫ বছর ধরে আমি কোনো বইমেলা মিস করিনি। অনেক প্রকাশনা ঘুরে দেখেছি বিক্রি অনেক কম এবার। আমার অবজারবেশন হলো, প্রতি বছর পরিবারভিত্তিক মানুষ মেলায় আসে। বই দেখে। এই জিনিসটার ঘাটতি দেখা গেছে এবার। ঘুরতে আসে কিন্তু বই কেনার যে স্রোত সেটা একটু ঘাটতি লক্ষ্য করছি।
বাবুই প্রকাশনীর প্রকাশক কাদের বাবু ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, অন্যান্য দিন শুক্রবার যেভাবে জমে উঠে এবার জমে ওঠেনি। এবারের বইমেলায় বিক্রির পরিমাণ কম হয়েছে। হিসাবে করে দেখেছি, যত বিক্রি হওয়াটা উচিত তার এক-তৃতীয়াংশ হয়তো হয়েছে।
এবার বাংলা একাডেমি ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ৭০৮টি প্রতিষ্ঠানকে ১০৮৪ ইউনিটের স্টল বরাদ্দ দেয়া হয়। বাংলা একাডেমিসহ ৩৭টি প্রতিষ্ঠান উভয় প্রান্তে প্যাভিলিয়ন বরাদ্দ পায়। এক ইউনিটের ৩৮৪টি, দুই ইউনিটের ২১৯টি, তিন ইউনিটের ৬১টি এবং চার ইউনিটের ২৩টি স্টল বরাদ্দ দেয়া হয়। শিশুদের জন্য ৭৪টি প্রতিষ্ঠানকে ১২০টি ইউনিটের স্টল বরাদ্দ দেয়া হয়। লিটল ম্যাগাজিন চত্বরের অবস্থান রয়েছে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের উন্মুক্ত মঞ্চের কাছে। এ চত্বরে ১৩০টি লিটলম্যাগ স্টল বরাদ্দ দেওয়া হয়।
এদিকে, তথ্যকেন্দ্রের দেয়া তথ্য অনুযায়ী এবার ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ৩২৯৯টি নতুন বই প্রকাশিত হয়েছে। একাডেমি জানিয়েছে বইমেলায় বাংলা একাডেমিসহ সব প্রতিষ্ঠানের বই ২৫ শতাংশ কমিশনে বিক্রি হয়েছে। বাংলা একাডেমি ২৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ২৭ দিনে ৬১ লাখ ৬৫ হাজার ৫৯৩ টাকার বই বিক্রি করেছে।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে