বইমেলা নিয়ে মন্তব্য করতে চান না অধিকাংশ প্রকাশক
দিনটি ছিল মঙ্গলবার, মেলার ১৮তম দিন। শুক্র-শনিবার যতটা ভিড় হয় সাধারণত অন্য কোনোদিন ততটা ভিড় হয় না। তাও মেলায় প্রচুর লোক সমাগম ছিল। যদিও বই ছিল না অধিকাংশ পাঠকের হাতেই। দর্শনার্থীরা মেলায় ঘুরছিলেন, গল্প করছিলেন। ঢাকায় তো বেড়ানোর জায়গা তেমন নেই, বইমেলা বা যে কোনো মেলা উপলক্ষেই তাই প্রচণ্ড ভিড় চোখে পড়ে। বাতাসে ছিল শীতের পরশ। ফেব্রুয়ারি চলে যাচ্ছে, ওই দিন ছিল ফাল্গুন মাসের ৫ তারিখ। গত কয়েকদিন ধরেই গরম পড়ছে; কিন্তু কাল তত গরম ছিল না। এর কারণটা বোঝা গেল একটু পরেই। হঠাৎ আকাশ ডেকে উঠল গুড়ুম গুড়ুম করে। তারপরই এক পশলা সুন্দর বৃষ্টি। কবি শহীদ কাদরীর ভাষায়- ‘সহসা সন্ত্রাস ছুঁলো’। সবাই দিগ্বিদিক ছুটতে লাগল। মেলার মাঠজুড়ে ঘুরতে থাকা দর্শনার্থীরা দৌড়ে গিয়ে আশ্রয় নিল বিভিন্ন বইয়ের দোকানের সামনে, খাবার দোকানগুলোর ভেতরে।
বৃষ্টি কমতেই দর্শনার্থীদেরও ভিড় কমতে লাগল। তখন মাত্র সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা বাজে। ৮টার মধ্যেই মেলা মোটামুটি ফাঁকা। যদিও বইমেলা চলে রাত ৯টা পর্যন্ত। কেমন চলছে এবারের বইমেলা? একটু খোঁজ-খবর নেয়ার জন্য নানা স্টলে উঁকিঝুঁকি মারতে লাগলাম। প্রকাশক-বিক্রয়কর্মীদের জিজ্ঞেস করতে লাগলাম, কেমন চলছে বেচাবিক্রি? অধিকাংশ বিক্রয়কর্মী, প্রকাশক হতাশার কথাই জানালেন। সংস্কৃতি বাংলার ব্যবস্থাপনা পরিচালক সুমন আহমেদ জানালেন, বেচাবিক্রি মোটেই ভালো নয়। প্রতিদিন অন্তত ১ হাজার টাকা বিক্রি হলে মনকে বুঝ দেয়া যায়। তাও হয় না। সংস্কৃতি বাংলা ছোট প্রকাশক, মেলায় তাদের একটি মাত্র স্টল। যারা প্যাভিলিয়ন নিয়েছেন তাদের খবর কী? একটি বিখ্যাত প্রকাশনীর প্রকাশকের সঙ্গে কথা বলতে গেলাম। সেই প্রকাশক জানালেন, বই নিয়ে কথা বলতে পারি, মেলা নিয়ে কোনো মন্তব্য করব না। এরকম আরো অনেক প্রকাশকই মেলা নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হলেন না। এতে একটু অবাক হলাম। কেন প্রকাশকরা মেলা নিয়ে কথা বলতে চান না!
আতঙ্কের কারণটা স্বাভাবিক। এবার শুরু থেকেই বইমেলায় একটা আতঙ্কজনক ও অস্বস্তিকর পরিবেশ বিরাজ করছে। তার শেষ পরিণতি কবি সোহেল হাসান গালিবকে গ্রেপ্তার। গতকাল মেলায় সমমনা কবি-সাহিত্যিক ও গালিবের বন্ধুরা একত্রিত হয়েছিলেন গালিবের মুক্তির দাবিতে। তা নিয়ে কথা হলো কবি চঞ্চল আশরাফের সঙ্গে। তিনি জানালেন, ‘আমরা একটু মানসিক চাপের মধ্যে আছি। কবি সোহেল হাসান গালিবের গ্রেপ্তারের ঘটনাটি আমাদের মন খারাপ করে দিয়েছে। আমরা ভেবেছিলাম তাকে আটক করার পর ছেড়ে দিবে; কিন্তু তাকে রিমান্ডে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সোহেল হাসান গালিব তো কোনো চিহ্নিত অপরাধী নন, একজন সাধারণ কবি, যা তিনি লিখেছেন তার জন্য ক্ষমাও চেয়েছেন; যদিও তার কবিতাটি ভুলভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে, তিনি ইসলামের শত্রু নন, বরং তিনি ইসলামপন্থি হিসেবেই পরিচিত, শুক্রবার তিনি বাচ্চাকে নিয়ে জুমার নামাজ পড়তে যান; তাহলে তাকে কেন গ্রেপ্তার করা হলো? গ্রেপ্তারের পর তাকে কেন রিমান্ডে নিয়ে যাওয়া হলো?’
বইমেলার সামগ্রিক পরিস্থিতি নিয়ে দুকথায় মন্তব্য জানতে চাইলে স্বরে ‘অ’-এর প্রকাশক আবু বকর সিদ্দিকী জানালেন, ‘অস্থিরতার আড়ালে বইমেলার লেখক, পাঠক, প্রকাশক, আয়োজক সবাই অদ্ভুতরকম রক্ষণশীল আচরণ করছে। লেখা, প্রকাশ, বিক্রয় সব মিলিয়েই এই রক্ষণশীলতা ধরা পড়ছে। ভবিষ্যতে রাজনৈতিক স্থিতাবস্থা আসার আগ পর্যন্ত অন্য অনেক সেক্টরের মতো প্রকাশনা শিল্পও সম্ভবত সুস্থির হবে না।’ প্রকাশক আবু বকর সিদ্দিকীর মন্তব্যটি ছোট হলেও গুরুত্বপূর্ণ। অল্প কথায় এবারের বইমেলার পুরো চিত্রটিই ধরা পড়েছে। একটু এগিয়ে গিয়ে দেখি পরিচিত বেশ কজন কবি-সাহিত্যিকের জটলা। দাঁড়িয়ে আছেন কবি ফরিদ কবির, প্রবন্ধকার আহমাদ মাযহার, মননশীল বইয়ের লেখক মোরশেদ শফিউল হাসানসহ আরও বেশ কজন তরুণ-প্রবীণ কবি- লেখক-প্রকাশক একটু পর এলেন কথাসাহিত্যিক পারমিতা হিম। তিনি আমেরিকায় থাকেন। আজই প্রথম মেলায় এলেন।
মেলা নিয়ে আর তার মন্তব্য জানতে চাইলাম না। জানতে চাইলাম আহমাদ মাযহারের কাছে। তিনিও আমেরিকা-প্রবাসী। প্রতি বছর বইমেলার সময় বাংলাদেশে আসেন। এবার এসেছেন ৩ তারিখে, মাঝখানে কলকাতা গিয়েছিলেন, ১৩ ফেব্রুয়ারি থেকে প্রতিদিনই মেলায় আসেন। কেমন দেখছেন এবারের বইমেলা জানতে চাইলে তিনি বললেন, কেমন যেন নিষ্প্রাণ লাগছে সবকিছু। কোথায় যেন প্রাণটা নেই। কেন নিষ্প্রাণ লাগছে? ‘ঠিক জানি না। লোকসংখ্যা কম আছে বলব না। লোকসংখ্যা যথেষ্টই আছে; কিন্তু বইয়ের ক্রেতার সংখ্যা কম। আরেকটা বিষয়, অন্যবার মেরায় যেমন স্বতঃস্ফূর্ত আড্ডা হয় সেরকম আড্ডার অভাব দেখছি। আরেকটা বিষয়, আমরা যে নতুন এক বাস্তবতায় প্রবেশ করেছি এই বাস্তবতার সঙ্গে মিলিয়ে নিতে একটু সময় লাগবে। এই বাস্তবতার নতুন টেক্সটা আসতেও সময় লাগবে।’
মোরশেদ শফিউল হাসান বললেন, ‘আমি সেই ১৯৭৩ সাল থেকে বইমেলা দেখছি। তখন আমরা ছাত্র ছিলাম, তখন মেলার এক ধরনের পরিবেশ ছিল। এখন মেলার পরিধি অনেক বেড়েছে; কিন্তু সেইভাবে ক্রেতার সংখ্যা বাড়েনি। নানা কারণে বইয়ের পাঠক কমে গেছে এটাও ঠিক। আমাদের সমাজের সমস্যা হলো এই, যে আমরা আমাদের সমাজকে পাঠসংস্কৃতির সমাজ বানাতে পারিনি। পাঠকের সংখ্যা বাড়াতে পারিনি। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বই পড়ে না। পাঠাগার নেই, তাহলে বইয়ের পাঠকের সংখ্যা বাড়বে কোত্থেকে? তারই নেতিবাচক প্রভাব ধীরে ধীরে বইমেলায় পড়ছে। আরেকটা বাস্তবতা হলো, যে হারে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিশপত্রের দাম বাড়ছে, দৈনন্দিন জীবনের প্রয়োজন মিটিয়ে মানুষ বই কিনতে পারে না। আরো বিষয় আছে, অনেক পাঠকই জানেন না কোন বইটা কিনতে হবে। আমি সব সময়ই বইমেলার আগে আগে বলি, কোনো পাঠক যে ভালো একটা বই বেছে নিবে তাকে তো বইটা সম্পর্কে জানতে হবে। জানার তো উপায় নেই। বই নিয়ে আমাদের কোনো প্রচারমাধ্যম, গণমাধ্যম সেভাবে খবর প্রচার করে না। তাই হঠাৎ করে একজন সাধারণ পাঠক কোনো ভালো বই খুঁজে পান না।’
তার কাছে জানতে চাইলাম, এবার তো বড় ধরনের একটা ঘটনা ঘটল, বিরাট এক গণঅভ্যুত্থান হলো, আমরা আশা করেছিলাম বইমেলায় একটা ইতিবাচক প্রভাব পড়বে, বরং দেখা গেল কিছু নেতিবাচক প্রভাবই পড়ল, এর কারণ কী? তিনি বললেন, ‘যে কোনো বড় ধরনের পরিবর্তনের পর অনেক ধরনের ঘটনাই ঘটতে পারে। আরও ঘটতে পারে; কিন্তু দুঃখজনক হচ্ছে, বইমেলাকে কেন্দ্র করে এমন কিছু ঘটনা ঘটেছে, যেগুলোর সঙ্গে বইয়ের বা বইয়ের সংস্কৃতির কোনো সম্পর্ক নেই।’ বইমেলা নিয়ে অনেক প্রকাশক কোনো মন্তব্য করতে চাচ্ছেন না, এর কারণ কী? ‘সেটা হতে পারে কোনো কারণে তারা ভয় পাচ্ছেন। ভয়ের কারণও আছে। তাদের এমন অনেক বই আছে যেগুলো তারা লুকিয়ে রাখতে চাচ্ছেন। তা ছাড়া বইমেলার শুরু থেকেই এমন কিছু ঘটনা ঘটেছে যার কারণে অনেকেই এখন খোলাখুলি কোনো মন্তব্য করতে ভয় পান। অনেকের স্টল পেতেও সমস্যা হয়েছে। কী বলতে কী বলে ফেলেন, কোত্থেকে কী হয়, এই ভয়!’
তরুণ লেখক মাহমুদুর রহমান জানালেন এবারের বইমেলা তার জন্য ভালোই যাচ্ছে। এবার তার তিনটা বই প্রকাশিত হয়েছে। তিনটাতেই ভালো সাড়া পাচ্ছেন। এবারের মেলায় স্টল বেশি দেয়ার কারণে কিছুটা ভিড় বেশি লাগছে। বিন্যাসে আরেকটু মনোযোগ দেয়া উচিত ছিল বলে তিনি মনে করেন। তা ছাড়া মেলার মাঠে নিরাপত্ত ব্যবস্থা তত জোরদার নয় বলেও তিনি জানালেন। মাঠে হকারদের দেখা যাচ্ছে বেশি।
মেলার মাঠে হকারের সংখ্যা চোখে পড়ার মতো, এ বিষয়ে মন্তব্য করলেন লেখক ও প্রকাশক হুমায়ূন কবীর ঢালীও। তিনি বললেন, এত হকার মেলার মাঠে কী করে প্রবেশ করে? পুলিশ কোথায়? নিরাপত্তা বাহিনী কী করে? তা ছাড়া মেলার সামনের রাস্তায় প্রচুর দোকান, রিপ্রিন্ট বই বিক্রি করে কম দামে। অনেকে সেখানেই অর্ধেক টাকা খরচ করে আসে। আর বাইরে যদি রিপ্রিন্ট বই বিক্রি করতে দেয়া হয় তাহলে মেলার যারা স্টল নিয়েছেন তারা কী বই বিক্রি করবেন? অনেকে ক্ল্যাসিক বইগুলো রিপ্রিন্ট করে বিক্রি করে। রাস্তায় সেগুলো হয়তো অর্ধেক দামে পাওয়া যায়। তাই অনেকে ওখান থেকেই কিনে ফেলে। তাহলে মেলায় যারা এত টাকা খরচ করে স্টল নিলেন তাদের কী হবে? এই প্যাভিলিয়নটা নিতে আট-দশ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। তারপর আরো খরচ আছে। মেলা কর্তৃপক্ষের এসব দিকে মনোযোগ দেয়া উচিত।
যাই হোক, পরিস্থিতি কিছুটা হতাশাজনকই মনে হলো। বেচাবিক্রি নিয়ে প্রায় কোনো প্রকাশক ও বিক্রয়কর্মীই খুশি নন। অথচ মেলার ১৮দিন চলে গেল, এখনো যদি পুরো দমে বেচাবিক্রি শুরু না হয় তাহলে কবে হবে? অন্যবার খাবার বিক্রেতরা অন্তত খুশি থাকে। এবার তাদেরও মন খারাপ। দুটো খাবার দোকানের মালিকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, যা বিক্রিবাট্টা হচ্ছে খরচই উঠবে না। ক্রেতার সংখ্যা কম দেখে অনেকে খাবারের দামও কমিয়ে দিয়েছেন। কোনোরকম খরচটা উঠিয়ে যেতে পারলে তারা বাঁচেন বলে জানালেন।
মেলা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পথে দেখা হলো কবি ও ছোট কাগজ ‘মগ্নপাঠ’ সম্পাদক আহমেদ শিপলুর সঙ্গে। তিনি প্রায় প্রতিদিনই বইমেলায় আসেন, এবং বইমেলা নিয়ে তার নিজস্ব কিছু পর্যবেক্ষণও আছে। তিনি জানালেন, আসলে এবার কয়েকটি ঘটনায় বইমেলার ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। প্রথমে ওই বাংলা একাডেমি পুরস্কার নিয়ে একটা বাজে ঘটনা ঘটল। তারপর মেলায় শেখ হাসিনার ছবিসহ ডাস্টবিন ব্যবহারে অনেকে ক্ষুণ্ন হয়েছে। অনেকে ঘোষণা দিয়ে মেলা বর্জন করেছেন। লিটলম্যাগও এবার বেশি জমেনি। অনেকে স্টল নিয়েও খোলেনি। শেষে এই কবি গালিবের ঘটনাটি ঘটল। যার ফলে যারা প্রকৃত পাঠক তারা অনেকেই আর এবার বইমেলায় আসেননি। অনেকে বইমেলার সময় বিভিন্ন জেলা থেকে, এমন কি বিদেশ থেকেও দলবেঁধে আসেন, আড্ডায়-গল্পে মেলাটি জমিয়ে তোলেন; এবার তারা অনেকে আসেননি। যার ফলে মেলাটি কিছুটা ম্লান।
আরেকটা ব্যাপার আছে বইমেলা না জমার পেছনে। সেটা হচ্ছে বইমেলায় সব সময় কিছু তারকা লেখকের প্রয়োজন হয়। আমাদের তেমন তারকা লেখক নেই। প্রবীণ লেখকরা যারা বেঁচে আছেন তারা মেলায় আসেন না। নব্বই দশকের পাঠকপ্রিয় গুরুত্বপূর্ণ লেখকরাও এবার তেমন মেলায় আসেননি। রাত ৯টার দিকে যখন মেলা ছেড়ে বেরিয়ে আসছিলাম তখন বিক্রয়কর্মীরা দোকান বন্ধ করছিলেন। বাতাসে তখনো বৃষ্টির আমেজ, আলো-আঁধারি পরিবেশে বইমেলাটিকে কেমন মন খারাপ মনে হলো।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে