এসএসসি ও সমমান পরীক্ষার ফল
শিক্ষার মান উন্নয়ন প্রয়োজন
যে কোনো দেশের নাগরিকের জীবনমান উন্নয়নের একটি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হলো শিক্ষা। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের শিক্ষা খাতের বড় অর্জনগুলোর মধ্যে রয়েছে এসএসসি ও সমমান পরীক্ষার পাসের হার বেড়ে যাওয়া। গত রোববার (১২ মে) ২০২৪ সালের এসএসসি ও সমমান পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হয়েছে। শিক্ষা বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, এবার মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট (এসএসসি) ও সমমান পরীক্ষায় ৯টি সাধারণ, মাদ্রাসা ও কারিগরি বোর্ডে গড় পাসের হার ৮৩ দশমিক ০৪ শতাংশ। এ বছর ১১টি শিক্ষা বোর্ডে মোট ২০ লাখ ২৪ হাজার ১৯২ জন পরীক্ষার্থী পরীক্ষায় অংশ নিয়েছে। তুলনামূলক মূল্যায়নে গতবারের তুলনায় এবার পাসের হার বেড়েছে।
কিন্তু শিক্ষার্থীদের অনেকেরই ভালো ফলের প্রতিফলন তাদের কর্মজীবনে সেভাবে দেখা যায় না। সেইসঙ্গে পাসের হার যেভাবে বাড়ছে, তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে শিক্ষার মান কতটা বাড়ছে, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন নিয়োগকর্তা এবং শিক্ষাবিদরা। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষায়ও মানের ঘাটতির বিষয়টি দেখা গেছে উল্লেখযোগ্যভাবে। গত তিন দশক আগেও মাধ্যমিক পরীক্ষায় পাসের হার ৩০ থেকে ৫০ শতাংশের মধ্যে থাকত। আর বর্তমান সময়ে পাসের হার আগের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ। কারণ হিসেবে শিক্ষাবিদরা মনে করেন, বর্তমান শিক্ষার গ্রেডিং পদ্ধতি এবং খাতা মূল্যায়নের শিথিলতা ও শিক্ষা ব্যবস্থার পরিবর্তনের জন্য এমন ফল পাওয়া যাচ্ছে।
এবার কিছু পরিসংখ্যান জানা যাক: এশিয়ার সেরা ৫০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় নেই বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম। দেশের অসংখ্য সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজস্ব ভূমি ও ভবন নেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০২৩-২০২৪ শিক্ষাবর্ষে ‘কলা, আইন ও সামাজিক বিজ্ঞান ইউনিট’, ‘বিজ্ঞান ইউনিট’, ‘ব্যবসায় শিক্ষা ইউনিট’ এবং ‘চারুকলা ইউনিট’-এর প্রথম বর্ষ আন্ডারগ্র্যাজুয়েট প্রোগ্রামের ভর্তি পরীক্ষায় ফলাফলে দেখা গেছে, গড়ে ৪টি ইউনিটে মোট ৮৮ দশমিক ৯৯ শতাংশ ভর্তিচ্ছু পাসই করতে পারেনি। ভর্তিচ্ছুদের অনুধাবন শক্তি কম হওয়ায় এমন পরিস্থিতি বলে মত বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্যের। এই পরিসংখ্যানগুলো অতি সাম্প্রতিক সময়ের।
গত কয়েক বছর ধরে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশের পর একটি বিষয় ব্যাপকভাবে আলোচনায় আসছে। তা হলো কত শতাংশ পাস করল। ‘পাসের হার কম’ হলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এ নিয়ে ব্যাপক আলোচনা সমালোচনার সৃষ্টি হয়। মিডিয়াগুলোও ইদানীং ওই পাসের হারকে শিরোনাম করে সংবাদ প্রচার করছে। এতে অনেকে দেশের শিক্ষাব্যবস্থার সার্বিক অবস্থা নিয়ে প্রশ্ন তুলে দিচ্ছেন, সন্দিহান হয়ে পড়ছেন শিক্ষার্থীদের মেধা ও যোগ্যতা নিয়ে। শিক্ষা হতে হবে কর্মমুখী ও উৎপাদনশীল। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে শিক্ষা খাতে গবেষণার ওপর।
শিক্ষা নিয়ে যত বেশি গবেষণা হবে, তত বেশি তার সমস্যা ও সংকটের জায়গাগুলো বেরিয়ে আসবে। সেগুলো চিহ্নিত ও সমাধান করলেই মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। দেশে মেধা যাচাই ও উত্তীর্ণ করতে প্রতি বছর ২ থেকে ৩ ঘণ্টার যে পরীক্ষা নেয়া হয়, তাতে শিক্ষার্থীরা প্রকৃত মেধার প্রতিফলন ঘটানো সম্ভব নয়। তাই সারা বছর ধরে একজন শিক্ষার্থীর মূল্যায়ন করা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে জাতিসংঘের ১৯৪৮ সালের এক ডিক্লারেশনে পরিষ্কার বলা আছে, প্রাথমিক শিক্ষা হবে সবার জন্য। মাধ্যমিক শিক্ষা হবে কর্মমুখী, যা কর্মপোযোগী জনগোষ্ঠী তৈরি করবে। উচ্চশিক্ষায় নিয়োগ হবে মেধার ভিত্তিতে। যিনি মেধাবী হবেন তিনিই উচ্চশিক্ষা নেবেন। এক্ষেত্রে দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় অনেক সমীবদ্ধতা ও বৈষম্য আছে। আছে ভালো শিক্ষকের আভাব এবং স্বজনপ্রীতি ও দলীয় রাজনৈতিক বিবেচনায় শিক্ষক নিয়োগের অভিযোগ। এসবের প্রভাব পড়েছে শিক্ষার ওপর।
সব শেষে বলতে চাই, এবারের এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় যারা উত্তীর্ণ হয়েছেন, তাদের সবার প্রতি রইল অভিনন্দন। যারা অকৃতকার্য হয়েছেন, তাদেরও হতাশ হওয়ার কিছু নেই। কারণ চেষ্টা থাকলে সাফল্য আসবেই। সেইসঙ্গে দেশের শিক্ষার মান উন্নয়নের জন্য কর্তৃপক্ষকে শিক্ষকদের আধুনিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা, বিভিন্ন সৃজনশীল সহশিক্ষা কার্যক্রমের আয়োজন, নিয়মিত নজরদারি এবং গবেষণার ওপর জোর দিতে হবে। তা না হলে দেশের পাসের হার বড়বে কিন্তু শিক্ষার মান বাড়বে না।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে