বঙ্গভবন থেকে বঙ্গবন্ধুর ছবি অপসারণে কয়েকটি প্রশ্ন
৫আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের পর বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের ১৫ বছরের শাসনামল নিয়ে সমালোচনা করার সঙ্গে সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুকেও প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলা হচ্ছে, যা কাম্য নয়। মুক্তিযুদ্ধের প্রতি শ্রদ্ধাশীল অনেকে মনে করেন মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু পরস্পর সম্পর্কিত, আওয়ামী লীগ সরকারের বিগত ১৫ বছরের শাসনামল নিয়ে সমালোচনা করতে গিয়ে বঙ্গবন্ধুর সমালোচনা হতে পারে না। বঙ্গবন্ধুকে সমালোচনা করতে গিয়ে অনেকে মুক্তিযুদ্ধকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলছেন, যা দেশের জন্য অপ্রত্যাশিত।
গণঅভ্যুত্থানের পর উপদেষ্টা পরিষদ সংবিধান মেনেই বঙ্গভবনে গিয়ে রাষ্ট্রপতির কাছে শপথ গ্রহণ করেছেন। সংবিধান পরিবর্তন হবে বা সংস্কার হবে, তা নিয়ে আলাপ চললেও কার্যত এখনো বাংলাদেশের সংবিধান বহাল। বাংলাদেশের সংবিধানের প্রথম ভাগে ৪-এর ক-ধারায় স্পষ্টভাবে লেখা আছে, ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতি রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার ও প্রধান বিচারপতির কার্যালয় এবং সব সরকারি ও আধা-সরকারি অফিস, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, সংবিধিবদ্ধ সরকারি কর্তৃপক্ষের প্রধান ও শাখা কার্যালয়, সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশের দূতাবাস ও মিশনগুলো সংরক্ষণ ও প্রদর্শন করিতে হইবে।’
সংবিধান মেনে যেখানে এখনো রাষ্ট্র পরিচালিত হচ্ছে, সেখানে সদ্য নিয়োগপ্রাপ্ত কয়েকজন উপদেষ্টা বঙ্গভবনসহ তাদের কার্যালয় থেকে বঙ্গবন্ধুর ছবি কী করে অপসারণ করেন? হয়তো তাকে সংবিধান ছুড়ে ফেলে বিপ্লবী সরকার গঠন করতে হবে, না হয় সংবিধান মেনেই রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব নিতে হবে। এ নিয়ে এখন অনেকেই সমালোচনা করছেন। এটাকে রাজনৈতিক ইস্যু হিসেবে না দেখে অনেকে মনে করছেন ব্যক্তিগত রোষানল হিসেবেই দেখা হচ্ছে।
গত মঙ্গলবার (১২ নভেম্বর) সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে জানা যায়, বঙ্গভবনের দরবার হল থেকে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি সরানোকে সংবিধানের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন বলে মনে করছেন বিশিষ্টজন। তারা বলেছেন, যে সংবিধানের আলোকে উপদেষ্টা পরিষদ শপথ নিয়েছে, সেই সংবিধানেই বঙ্গবন্ধুকে জাতির পিতা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। আবার তার ছবি বা প্রতিকৃতি সংরক্ষণ বিষয়েও সংবিধানে যথাযথ নির্দেশনা দেয়া আছে। এই অবস্থায় বঙ্গভবন থেকে বঙ্গবন্ধুর ছবি সরিয়ে ফেলা সংবিধান লঙ্ঘনের শামিল।
অন্যদিকে, রাজনীতিবিদরা এটাকে ‘অযৌক্তিক’ ও ‘বাড়াবাড়ি’ হিসেবে আখ্যা দিয়ে বলেছেন, এই ঘটনায় অন্তর্বর্তী সরকারের দৈন্য প্রকাশ পেয়েছে। এটা করে মুক্তিযুদ্ধ ও ইতিহাসে বঙ্গবন্ধুর যে অবস্থান, সেটাকে কখনোই কেড়ে নেয়া যাবে না। আর এর মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু নন, আমরা নিজেরাই ছোট হয়েছি। এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জেড আই খান পান্না সংবাদমাধ্যমকে বলেন, বঙ্গবন্ধুর ছবি অপসারণ সংবিধানের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। এর মধ্য দিয়ে জাতির সঙ্গে বেইমানি করা হয়েছে। এর দায় অন্তর্বর্তী সরকার ও রাষ্ট্রকেই নিতে হবে।
গত রোববার সরকারের নতুন তিন উপদেষ্টা শপথ গ্রহণের সময় বঙ্গভবনের দরবার হলে তাদের পেছনে বঙ্গবন্ধুর ছবি ছিল। এর প্রতিবাদ জানিয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আবদুল্লাহ ফেসবুকে লেখেন, “আমরা সারা দিন লীগ তাড়াব আর বলব, ‘মুজিববাদ, মুর্দাবাদ’। আর তারা মুজিবের ছবি পেছনে টানিয়ে করে শপথ পাঠ।” এর পর সোমবার ফেসবুক পোস্টে দরবার হল থেকে ওই ছবি সরানোর কথা জানিয়ে একটি ছবি পোস্ট করেন উপদেষ্টা মাহফুজ আলম। সেখানে তাকে বঙ্গভবনের শপথমঞ্চের সামনেই দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। তবে পেছনে বঙ্গবন্ধুর ছবিটি ছিল না।
অন্তর্বর্তী সরকারের কার্যক্রম নিয়ে ইতোমধ্যেই নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। তারা আসলে কী চান? কী করতে চান? ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগ সরকাকে তাড়িয়েছে ভালো কথা, জনগণ খুশি; কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এখনো কোনো সদুত্তর অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টারা দিতে পারেননি। তা ছাড়া অন্তর্বর্তী সরকারের অনেক নিয়োগ নিয়েই প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেকে এমনও সমালোচনা করছেন, দেশকে বিরাজনীতিকরণের দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সঙ্গে আমরা একমত; কিন্তু তার পরবর্তী কার্যক্রম নিয়ে যেসব তর্ক-বিতর্ক চলছে তার সমাধান অন্তবর্তী সরকারকেই করতে হবে। তা না হলে জাতির কাছে তারা কঠিন-কঠোর প্রশ্নের মুখোমুখি হবেন।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে