Views Bangladesh Logo

সচিবালয়ে আগুন

কেপিআই এলাকার নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন

Manik Miazee

মানিক মিয়াজী

রাজধানীর সচিবালয়ে বুধবারের আগুনের ঘটনার পর গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় স্থাপনা বা কেপিআইয়ের নিরাপত্তা নিয়ে উঠেছে প্রশ্ন। সুনির্দিষ্ট কারণ জানা না গেলেও ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, শর্টসার্কিট থেকে এই অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত হতে পারে। তবে এই আগুনের ঘটনাকে নিছক দুর্ঘটনা হিসেবে মানতে নারাজ খোদ রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা। তারা এটিকে নাশকতার ঘটনা বলেই দাবি করছেন। এ রকম অবস্থায় প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র সচিবালয়ে এই অগ্নিকাণ্ডের পরে প্রশ্ন উঠেছে রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলোর সুরক্ষা ব্যবস্থাপনা এবং অবকাঠামোগত নিরাপত্তা নিয়ে।

নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের মতে, সচিবালয়ের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থানে এমন ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা খুবই কম, যদি না এটি উদ্দেশ্যমূলকভাবে ঘটানো হয়। তারা ধারণা করছেন, এ ধরনের ঘটনার পেছনে সাধারণত দুধরনের কারণ থাকতে পারে- চরম অবহেলা বা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত কর্মকাণ্ড। সচিবালয়ে এর আগে এমন অনেক ঘটনার নজির রয়েছে, যেখানে ঘটনাগুলো প্রাথমিকভাবে পরিকল্পিত ছিল বলে জানান তারা।

সুরক্ষা ব্যবস্থাপনা নিয়ে প্রশ্ন
ঘটনাটি দেশের প্রশাসনিক অবকাঠামোর দুর্বলতাকে আবারও সামনে নিয়ে এসেছে। গুরুত্বপূর্ণ নথি সংরক্ষণে আরও আধুনিক ও নিরাপদ ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানাচ্ছেন সংশ্লিষ্টরা।

আগুনের ঘটনা নিছক দুর্ঘটনা না হলে নাশকতার উদ্দেশ্যে অবশ্যই কাউকে ভবনটিতে প্রবেশ করতে হবে বলে জানিয়েছেন নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা। সেক্ষেত্রে ভবনটির সুরক্ষা ব্যবস্থাপনায় যথেষ্ট অবহেলা থাকতে পারে বা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়েই কেউ নিরাপত্তার দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করেনি, বলছেন বিশ্লেষকরা।

ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের সাবেক মহাপরিচালক অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবু নাঈম মো. শাহিদউল্লাহ বলেন, কেপিআই এলাকায় পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকার কথা থাকলেও এমন আগুনের ঘটনায় নিরাপত্তা ও ভবন ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকা সবাইকে জবাবদিহির আওতায় আনা উচিত।

সচিবালয়ের নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করেন পুলিশসহ অন্য আইনশৃঙ্খলা ও গোয়েন্দা বাহিনীর সদস্যরা। আর ভবনগুলোর দেখভালের দায়িত্ব পালন করে গণপূর্ত অধিদপ্তর।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, সচিবালয়ের নিরাপত্তার জন্য একজন করে এসপি ও এএসপি থাকে; এ ছাড়া প্রায় ৫৬০ জনের মতো নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য আছে। প্রশ্ন উঠেছে এ রকম নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা বলয় থাকার পরে নিরাপত্তা তল্লাশি ছাড়া আদৌ কি এরকম স্থাপনায় বহিরাগত কারও প্রবেশ করা সম্ভব কি না।

সচিবালয়ের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন খোদ মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের জ্যেষ্ঠ সহকারী সচিব ইমরুল হাসান। তিনি তার ফেসবুক টাইমলাইনে লিখেছেন, ‘সচিবালয়ের সমস্ত বিল্ডিং, ইন্টেরিয়র, স্থাবর সমস্ত কিছুর দায়িত্ব গণপূর্ত অধিদপ্তরের ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্টের আর এর নিরাপত্তার দায়িত্ব পুলিশের।’

‘আমি ও আমরা যে রুমগুলোতে বসি তার চাবিও আমার বা আমাদের স্টাফের কাছে থাকে না। গণপূর্ত যদি রুম খুলে না দেয় তো আমার অফিস করাও সম্ভব না!’ তিনি লিখেছেন, ‘কখনো জরুরি প্রয়োজনে রাতে কোনো রুম খুলতে হলে গণপূর্ত অধিদপ্তরের স্টাফ যাদের কাছে চাবি থাকে, তাদের বললে তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকা রেজিস্টার খাতায় নাম, পরিচয় লিখে- স্বাক্ষর দিয়ে রুমে ঢুকতে হয়। চাবি কিন্তু তাদের কাছেই থাকে, রুম খোলা-বন্ধ তারাই করেন।’

গভীর রাতে এরকম স্থাপনায় আগুন লাগার বিষয়ে তিনি সুষ্ঠু তদন্তের দাবিও করেছেন। আগুনের ঘটনা নিয়ে বিশেজ্ঞরা বলছেন, এখানে তো লোকাল গার্ড ছিল, নিজস্ব নিরাপত্তা ব্যবস্থা তো তাদের বিজনেসের অংশ। ভবনটিতে ঘটনার দিন কে কে ছিল, কে ঢুকেছিল সেটা বের করতে হবে।


অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন
কেপিআইভুক্ত প্রতিষ্ঠান হিসেবে সচিবালয়ে আগুন লাগাকে কোনোভাবেই ভালোভাবে দেখছেন না বিশেষজ্ঞরা। তারা প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র হিসেবে সচিবালয়ে পূর্ণাঙ্গ ফায়ার স্টেশন থাকার কথা বলছেন। সেইসঙ্গে থাকবে আগুন নেভানোর আধুনিক সরঞ্জাম। তারা প্রশ্ন তুলেছেন সচিবালয়ের ভেতরে থাকা ফায়ার সার্ভিসের ব্যর্থতা নিয়ে।

আবু নাঈম মো. শাহিদউল্লাহ বলেন, সেখানে তো ফায়ার প্লান্ট থাকার কথা। যে ভবনে আগুন লাগছে সেখানে কারা নিয়োজিত ছিল? ফায়ার সার্ভিসে কারা ছিল। ফায়ারের ইক্যুইপমেন্ট কাজ করেছে কি না? এসব বিবেচনায় নিয়ে তদন্ত করতে হবে।

তিনি বলেন, ‘কেপিআইভুক্ত প্রতিষ্ঠান হিসেবে সেখানে তো পূর্ণাঙ্গ ফায়ার স্টেশনই থাকার কথা। সেখানে টার্নটেবল লেডার ব্যবহার করার কথা। সেখানে আদৌ সেটা ছিল কি না? পাম্প ছিল কি না? এখানে লেডার কেন ঢুকতে পারলো না? আমরা শুনছি, খবর পাচ্ছি, গণপূর্ত সেখানে গেটের ওপরে ছাউনি দিয়েছে। সেটা সরানোর জন্য ফায়ার সার্ভিস চিঠিও দিয়েছে। অথচ সেই চিঠিকে কেন আমলে নেয়নি গণপূর্ত সেটাও বিবেচনায় আনতে হবে।'

সিসিটিভি ফুটেজের অপ্রাপ্তি
আগুনের ঘটনার সবচেয়ে চাঞ্চল্যকর দিকটি হলো- যেখানে সচিবালয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় সর্বোচ্চ নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকার কথা, সেখানে সিসিটিভি ডিভাইসের অনুপস্থিতি নজর কেড়েছে। নিরাপত্তা বিভাগ জানিয়েছে, প্রতিটি ফ্লোরে যে ডিভাইসগুলো থাকে আগুনে সেগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় কোনোপ্রকার ফুটেজ সংগ্রহ করা প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাছাড়া, সেন্ট্রাল ডিভাইসে কেবলমাত্র ভবনের বাইরের ফুটেজ সংরক্ষিত থাকে। এক্ষেত্রে, সেখান থেকেও তেমন কোনো তথ্য পাওয়া সম্ভব নয়।

তদন্ত কমিটি
আগুনের ঘটনা নিছক দুর্ঘটনা না নাশকতা সেটি বের করতে গঠন করা হয়েছে তদন্ত কমিটি। প্রথমে সাত সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হলেও সেটি বাতিল করে নতুন করে কমিটি গঠন করেছে সরকার। আট সদস্যের নতুন কমিটিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব নাসিমুল গনিকে প্রধান করা হয়েছে।

নতুন কমিটিতে আরও রয়েছেন পুলিশের মহাপরিদর্শক বাহারুল আলম, গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. হামিদুর রহমান খান, বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক তানভীর মঞ্জুর, ঢাকা সেনানিবাসের কমান্ড্যান্ট সিএমটিডি ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মাহবুবুর রহমান রাসেল, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের কেমিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মো. ইয়াসির আরাফাত খান, ইলেক্ট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেক্ট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ইয়াসির আরাফাত এবং ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের মহাপরিচালক।

এ কমিটি অগ্নিকাণ্ডের উৎস ও কারণ অনুসন্ধান, অগ্নি দুর্ঘটনার পেছনে কেউ জড়িত কি না এবং ভবিষ্যতে এ ধরনের দুর্ঘটনা এড়াতে করণীয় সুপারিশ করবে। কমিটি প্রয়োজনে এক বা একাধিক সদস্য কো-অপ্ট করতে পারবে বলেও মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের এক নির্দেশনায় বলা হয়েছে।


কমিটিকে আগামী ১০ কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে। কমিটি আগামী ৩০ ডিসেম্বরের মধ্যে প্রাথমিক তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেবে বলেও আশা করা হচ্ছে। এদিকে সম্পদের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণের জন্য ৫ সদস্যের আরেকটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।

তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক করা হয়েছে প্রশাসন অধিশাখার যুগ্মসচিব মো. আবদুছ সামাদ আল আজাদ। এ কমিটির সদস্য-সচিব করা হয়েছে উপসচিব মো. কামাল হোসেনকে। সদস্য হিসেবে আছেন– উপসচিব মোহাম্মদ সাইদুর রহমান,  সিস্টেম এনালিস্ট সুকান্ত বসাক, সহকারী মেইনটেন্যান্স ইঞ্জিনিয়ার এ এস এম মেহরাব হোসেন। 

তদন্ত কমিটির কার্যপরিধিতে বলা হয়, অগ্নিকাণ্ডে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সম্পদের (আসবাবপত্র, ইলেকট্রনিক্স সামগ্রী ও অন্যান্য) ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণ। কমিটি প্রয়োজনে যে কোনো সদস্য কো-অপ্ট করতে পারবে। ভবিষ্যতের যেকোনো দুর্ঘটনার ফলে উদ্ধৃত ক্ষয়ক্ষতি রোধকল্পে করণীয় সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট সুপারিশ প্রদান। যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদনক্রমে জারিকৃত এ আদেশ অবিলম্বে কার্যকর হবে।

গঠিত কমিটিকে আগামী ৭ কর্মদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন মন্ত্রণালয় জমা দিতে বলা হয়েছে।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ