সিন্ডিকেট, দুর্নীতি ও অপরিকল্পিত ব্যয়ে বছরে রেলের লোকসান দেড় হাজার কোটি টাকা
গত ১৫ বছর ধরে বছরপ্রতি গড়ে দেড় হাজার কোটি টাকা লোকসান দিয়ে চলেছে রেলওয়ে। আয়-ব্যয়ের হিসাবে ওই ১৫ বছরে ২১ হাজার কোটি টাকা লোকসান দিয়েছে জন্মলগ্ন থেকে দুই যুগ আগ পর্যন্ত লাভে থাকা খাতটি। বিদায়ী আওয়ামী লীগ সরকারের রেলপথ মন্ত্রণালয়ে মোট বিনিয়োগ ছিল ৮৮ হাজার কোটি টাকা। বিপুল পরিমাণ এ বিনিয়োগ থেকে আত্মসাতই লোকসানের পেছনে দায়ী বলে অভিযোগ রয়েছে। রাষ্ট্রীয় পরিবহনের সব সেক্টর লাভজনক হলেও রেলপথে এ লোকসানের পেছনে গডফাদার নিয়ন্ত্রিত সিন্ডিকেট, দুর্নীতি ও অপরিকল্পিত ব্যয়কেও দায়ী করছেন সংশ্লিষ্টরা।
রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সব কাযর্ক্রম পরিচালনায় ১৩টি বিভাগে ভাগ করা হয়েছে। সেগুলোর মধ্যে ইঞ্জিনিয়ারিং, কমার্শিয়াল, স্টোর এবং মেকানিক্যাল বিভাগ বেশি গুরুত্বপূর্ণ। রেলের বরাদ্দের সিংহভাগ ব্যয় হয় এই বিভাগগুলোতে। রেলপথ মন্ত্রণালয়ে অনুসন্ধানে দেখা যায়, রেলের ১৩টি বিভাগে রয়েছেন এক ডজন ঠিকাদার, যারা গত দুই যুগ ধরে যে সরকারই ক্ষমতায় এসেছে, তাদের নিয়ন্ত্রণ করে হাতিয়ে নিয়েছেন হাজার হাজার কোটি টাকার কাজ। অভিযোগ রয়েছে, তাদের মাধ্যমে দেশের বাইরে টাকা পাচারও করেছেন রাজনৈতিক দলের সুবিধাভোগীরা।
গত এক মাসে রেলওয়েতে শতাধিক টেন্ডার আহ্বান এবং নতুন কয়েকটি ট্রেন লিজ দেয়া হয়েছে। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, রেলওয়ে চিফ ইঞ্জিনিয়ার পূর্বের অধীনে ৩০টি, পশ্চিমের অধীনে ২৫টি, ঢাকা বিভাগ ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্টের ডিএন-১ এর ১৫টি এবং ডিএন-২ এর ২০টি টেন্ডার ছাড় হয়। এ ছাড়াও সম্প্রতি বাতিল হওয়া রেলওয়ের ২৪টি ট্রেনের মধ্যে পাঁচটির লিজ দেয়া হয়েছে।
অভিযোগ রয়েছে, রেলের টাকা পাচার এবং এ খাতের নিয়ন্ত্রণ ১৯৯১-৯৬ এবং ২০০১-০৬ মেয়াদে বিএনপি সরকারের আমলে মির্জা আব্বাসের ভাই মির্জা খোকন নিয়ন্ত্রণ করলেও ক্ষমতার পরিবর্তনে তা চলে যায় আওয়ামী লীগের প্রভাবশালীদের কাছে। গত ১৫ বছর যার একছত্র নিয়ন্ত্রণ ছিল চট্টগ্রামের শীর্ষ সন্ত্রাসী ও বহিষ্কৃত যুবলীগ নেতা হেলাল আকবর চৌধুরী বাবর আলীর।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, রেলের সবচেয়ে ব্যয়বহুল খাত ইঞ্জিনিয়ারিং খাত। আওয়ামী লীগ আমলে বাজেটে সবচেয়ে বেশি বরাদ্দ পেত পরিবহন ও যোগাযোগ অবকাঠামো খাত। নতুন রেলপথ, সড়ক, সেতু নির্মাণ, সংস্কার ও উন্নয়নে ব্যয় হয়েছে বিপুল পরিমাণ অর্থ। আর এসব অবকাঠামোগত কাজগুলো করানো হতো তৎকালীন সরকারের পছন্দের কিছু ঠিকাদারদের দিয়ে। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য তমা কনস্ট্রাকশন, ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেড, এস এ করপোরেশন। গত দুই যুগ ধরে এই প্রতিষ্ঠানগুলোই রেলের সব মেগা প্রজেক্টগুলোর কাজ করছে।
কমার্শিয়াল ডিপার্টমেন্টের গডফাদাররা হচ্ছে, জান্নাত ট্রেডার্স, এস এ করপোরেশন। অন্যদিকে স্টোর এবং মেকানিক্যাল ডিপার্টমেন্টের নিয়ন্ত্রণকারী ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলোর হচ্ছে নূর-এ-এলাহী সিসিএস, মেসার্স এসআর ট্রেডিং, এলআর ট্রেডিং ও এনএল ট্রেডিং।
গত ৫ আগস্ট সরকার পরিবর্তনের পর কাজ রেখে পালিয়ে যায় রেলের রাঘববোয়াল কিছু প্রতিষ্ঠান। কিছুদিন পরেই অন্তর্বর্তী সরকারের সহযোগী বিএনপির ঠিকাদার এবং তাদের প্রত্যক্ষ সহায়তায় ফিরে এসেছে আওয়ামী লীগের আশীর্বাদপুষ্ট ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো। যদিও ভারতের সঙ্গে যৌথ কাজের ঠিকাদাররা না থাকায় সেসব কাজ এখনো বন্ধ রয়েছে। এ কারণে নির্দিষ্ট সময়ে কাজ শেষ হওয়া নিয়েও রয়েছে সংশয়।
সূত্রের অভিযোগ, রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলের ‘টেন্ডার সম্রাট’ হিসেবে পরিচিত বাবর আলীর বছরে প্রায় ১ হাজার কোটি টাকার টেন্ডার-বাণিজ্যে ছিল একক আধিপত্য। তার অনুমতি ছাড়া টেন্ডার দিতে পারতো না খোদ রেলওয়েও। চট্টগ্রাম কিংবা রেলওয়ে পশ্চিমাঞ্চলে কোনো কাজ করতে হলে তমা-ম্যাক্স-এর মতো প্রতিষ্ঠানগুলোকেও টেন্ডার নিতে হতো এই বাবর আলীর কাছ থেকে। টেন্ডারে স্বচ্ছতা নিশ্চিতে সরকার অনলাইন সিস্টেম চালু করলেও এই কোম্পানিগুলোর আত্মীয়-স্বজনদের নামের প্রতিষ্ঠান থেকে একাধিক টেন্ডার জমা দেয়াতো।
রেলের সব প্রতিষ্ঠান এবং ঠিকাদারদের নিয়ন্ত্রণ, এমনকি ডিজি, জিএমসহ রেলের নিয়োগ বদলি থেকে শুরু করে সব কিছুর নিয়ন্ত্রক সিন্ডিকেটের নেতা তমা কনস্ট্রাকশনের মালিক আতাউর রহমান ভূঁইয়া মানিক, ম্যাক্সের মালিক গোলাম মোহাম্মদ আলমগীর, শাহ আমানত ট্রেডার্স ও জান্নাত ট্রেডার্সের মালিক শহিদুল আলম এবং এস এ করপোরেশনের মালিক শাহ আলম। অনুসন্ধানে দেখা যায়, রেলওয়ের ২৮টি ব্যয়বহুল প্রকল্পের মধ্যে বেশিরভাগ প্রকল্প একক কিংবা যৌথভাবে ভারতীয় এবং চায়না কোম্পানির সঙ্গে কাজ করছে তমা কনস্ট্রাকশন এবং ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেড।
এর মধ্যে দোহাজারী-রামু, খুলনা-মোংলা (২য় সংশোধিত) লাকসাম-চিনকি আস্তানা, কাশিয়ানি-গোপালগঞ্জ, ঢাকা-টঙ্গী তৃতীয় চতুর্থ ডুয়েলগেজ রেলপথসহ রেলওয়ের একাধিক অবকাঠামো নির্মাণ ও উন্নয়নের কাজ করছে প্রতিষ্ঠান দুটি।
তিন হাজার ৫০২ কোটি টাকা ব্যয়ে দোহাজারী-কক্সবাজার রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পে চীনের একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যৌথভাবে এবং ৩ হাজার ৪৭৩ কোটি টাকা ব্যয়ে আখাউড়া-লাকসাম রেলপথ প্রকল্পে চীন ও বাংলাদেশের দুই প্রতিষ্ঠানকে সঙ্গে নিয়ে কাজ করছে ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেড। ৬ হাজার ১৬১ কোটি টাকা ব্যয়ে দোহাজারী-কক্সবাজার ও আখাউড়া-লাকসাম রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পে একাধিক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করছে তমা।
গত সাড়ে ১৫ বছরে শেখ হাসিনার শাসনামলে রাজনৈতিক প্রভাবকে কাজে লাগিয়ে রেল ভবনের উচ্চ পদে নিজস্ব কর্মকর্তা বসিয়ে তারা গড়ে তুলেছিলেন শক্তিশালী সিন্ডিকেট। এর মাধ্যমে অন্তত ৩০ হাজার কোটি টাকার কাজ বাগিয়ে নেয়েছে প্রতিষ্ঠানগুলো। যার নেতৃত্ব দিয়েছেন হেলাল আকবর চৌধুরী বাবর আলী, তমা কনস্ট্রাকশনের মালিক আওয়ামী লীগ নেতা আতাউর রহমান ভূঁইয়া মানিক ও ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেডের মালিক গোলাম মোহাম্মদ আলমগীর। কাজ পাওয়ার পর দফায় দফায় প্রকল্পের মেয়াদ ও খরচ বাড়িয়েও লোপাট করেছেন হাজার হাজার কোটি টাকা। লুটের টাকার বড় অংশ ঠিকাদারি কাজে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি আমদানির নামে ভুয়া এলসি খুলে বিদেশে পাচারের অভিযোগও আছে প্রতিষ্ঠান দুটির বিরুদ্ধে।
বিশাল এই অনিয়ম-দুর্নীতি ও অর্থ পাচার উদ্ঘাটনে দুই দফা অনুসন্ধান টিম গঠন করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। প্রতিবারই প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে তথ্য-উপাত্ত চেয়ে চিঠি পাঠানোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকেছে দুদক। তদন্ত প্রতিবেদন এখনো আলোর মুখ দেখেনি। এসব প্রতিষ্ঠানগুলোর অনিয়ম-দুর্নীতি প্রকাশের সাধ্য কারোরই ছিল না। এমনকি এখনো প্রকল্প সংশ্লিষ্টরাও মুখ খুলতে পারেননি। যারা কাজের সমালোচনা করেছেন, তাদের অনেক প্রকল্প পরিচালককে অসম্মান করে বদলি, ওএসডি করা হয়েছে। অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলা কর্মকর্তারাও প্রকল্পের দায়িত্বে থাকতে পারেননি।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. এম সামছুল হক বলেন, ‘ম্যাক্স-তমা গ্রুপের আখাউড়া-লাকসাম রেলপথ নির্মাণ কাজে অনিয়ম-দুর্নীতি আমি নিজেই দেখেছি। মাটি ভরাটের কাজে নজিরবিহীন দুর্নীতি করা হয়েছে। এ প্রকল্পে প্রায় ১০ জন প্রকল্প পরিচালক ছিলেন। চাপে ঠিকমতো কাজও করতে পারেননি তারা। ড. এম সামছুল হক বলেন, দোহাজারী-কক্সবাজার প্রকল্প গ্রহণের সময় ১ হাজার ৮০০ কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়েছিল। পরে সেই প্রকল্প ১৮ হাজার কোটি টাকায় গিয়ে ঠেকেছে; কিন্তু এখনো শেষ হয়নি প্রকল্পের পুরো কাজ। রেলের দুর্নীতিবাজ সব ঠিকাদার ও তাদের দুর্নীতির ভাগিদার মন্ত্রী, সচিব ও রেল কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার এখনই সময়।
কোনো ধরনের সম্ভাব্যতা যাচাই ছাড়া রাজবাড়ী থেকে গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় রেললাইন স্থাপন কাজে ২০১০ সালে প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছিল ১ হাজার ১০১ কোটি টাকা। ২০১৩ সালের মধ্যে এ প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও পাঁচ বছর পর ২০১৮ সালে প্রকল্পের কাজ শেষ হয়। ওই সময়ের মধ্যে তিনবার মেয়াদের সঙ্গে নির্মাণ ব্যয় বাড়ানো হয় ৯৩৪ কোটি টাকা। ১ হাজার ১০১ কোটি টাকার প্রকল্প ব্যয় গিয়ে দাঁড়ায় ২ হাজার ৩৫ কোটি টাকায়।
সূত্রমতে, দুদকের অনুসন্ধানে দেখা যায়, টুঙ্গিপাড়ায় রেলপথ থেকে লোপাট করা হয়েছে ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকার বেশি। অন্যদিকে চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার পর্যন্ত ১০১ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণে ২০১৬ সালে ব্যয় ধরা হয়েছিল ১ হাজার ৮৩৪ কোটি টাকা। যা পরে ১৫ হাজার ৪৭৬ কোটি ৩৬ লাখ টাকায় গিয়ে দাঁড়ায়। কিলোমিটারপ্রতি ব্যয় পড়ছে ১৫৩ কোটি ৪৯ লাখ টাকা। এ ছাড়া প্রকল্পটির রামু-ঘুমধুম অংশের সম্ভাব্য নির্মাণ ব্যয় ধরা আছে ২ হাজার ৫৫৮ কোটি টাকা।
তথ্য অনুসারে আমেরিকা, জাপান, চীনসহ উন্নত দেশেও সর্বোচ্চ গতির রেলপথ নির্মাণে কিলোমিটারপ্রতি খরচ সর্বোচ্চ ৫০ থেকে ৮০ কোটি টাকা। বিভিন্ন যন্ত্রপাতি আমদানির নামে ভুয়া এলসি খুলে বিদেশে টাকা পাচার, বিভিন্ন অনিয়ম-দুর্নীতি, প্রকল্পের কাজে নিম্নমানের নির্মাণসামগ্রী ব্যবহারের অভিযোগ রেলের কয়েকটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের পরিচালকদের বিরুদ্ধে শত শত কোটি টাকা ঋণ নিয়ে আত্মসাতের অভিযোগেরও অনুসন্ধান করেছে দুদক।
রেলওয়ের পরিকল্পনা দপ্তরের এক কর্মকর্তা বলেন, ম্যাক্স, তমা, শাহ আমানত ট্রেডার্স ও জান্নাত ট্রেডার্স যে মন্ত্রী-সচিব রেলের দায়িত্ব নেন, তাদের সবার ঘরের অন্দরমহলে ঢুকে বিভিন্ন কৌশলে নিজেদের হাতিয়ে নেয়। যোগ্যতা বাড়িয়ে দেখাতে চীন কিংবা অন্য দেশের প্রতিষ্ঠানগুলোকে সামনে রেখে ‘জয়েন্ট ভেঞ্চার’ গড়ে তারা। এসব অভিযোগের বিষয়ে বক্তব্য জানতে তমা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আতাউর রহমান ভূঁইয়া মানিকের মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তা বন্ধ পাওয়া গেছে। অভিযোগ অস্বীকার করে ম্যাক্স গ্রুপের চেয়ারম্যান প্রকৌশলী গোলাম মোহাম্মদ আলমগীর বলেন, ‘আমাদের প্রতিষ্ঠান সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে প্রতিটি কাজ করছে। রেলে বিদেশি কোম্পানিগুলোর কাজ আর আমাদের ম্যাক্সের কাজে পার্থক্য রয়েছে।’
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে