‘দুই মন্ত্রণালয়ের রেষারেষিতেই অচল রেলপথ’
সারা দেশে দিনভর ট্রেন চলাচল না করায় রেলযাত্রীদের নজিরবিহীন ভোগান্তি শেষে ২৮ জানুয়ারি (মঙ্গলবার) রাত ২টার দিকে রেলওয়ের রানিং স্টাফদের কর্মবিরতি প্রত্যাহার করা হয়। বাংলাদেশ রেলওয়ে রানিং স্টাফ ও শ্রমিক-কর্মচারী ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মুজিবুর রহমান জানান, চাপের মুখে অনেকটা বাধ্য হয়েই রেল স্টাফরা এ সিদ্ধান্ত নিলেও তাদের দাবি না মানা হলে তারা আবার আন্দোলনে নামবেন।
সরেজমিন আন্দোলনরত স্টাফদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মাইলেজের ভিত্তিতে পেনশন ও আনুতোষিক দেয়া এবং নিয়োগপত্রের দুই শর্ত প্রত্যাহারের দাবির বিষয়ে বেঁধে দেয়া সময়ের মধ্যে সুরাহা না হওয়ায় অনির্দিষ্টকালের জন্য কর্মবিরতিতে যান তারা। তাদের দাবি পূরণে সরকারের দুই মন্ত্রণালয়- রেলপথ মন্ত্রণালয় ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তহীনতাকে দায়ী করছেন আন্দোলনরত স্টাফরা।
তাদের দাবি, আর্থিক বিষয় জড়িত থাকায় রেল মন্ত্রণালয় চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের দায় ঠেলে দিচ্ছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের দিকে। আর অর্থ মন্ত্রণালয়ের পরিষ্কার জবাব, রেলকর্মীদের ‘অযৌক্তিক দাবি’ মানার সুযোগ নেই। মন্ত্রণালয় দুটির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা রেল কর্মীদের সমস্যা সমাধানের ব্যাপারে কয়েক বছর ধরে একে অন্যের ওপরে দায় চাপাচ্ছে, এমনটিই দাবি আন্দোলনকারীদের। দীর্ঘদিন ধরে এ সমস্যা চলতে থাকলেও সমাধান করতে পারিনি রেল মন্ত্রণালয়।
রেল মন্ত্রণালয় ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের ঠেলাঠেলিতে এই অবস্থানে গিয়েছে বিষয়টি। এদিকে রানিং স্টাফরা দৈনিক ৮ ঘণ্টার বেশি কাজ করলে বেসিকের (মূল বেতন) হিসেবে বাড়তি অর্থ পেতেন। যাকে রেলওয়ের ভাষায় বলা হয় মাইলেজ। প্রতি ১০০ কিলোমিটার ট্রেন চালালে রানিং স্টাফরা মূল বেতনের এক দিনের বেসিকের সমপরিমাণ টাকা অতিরিক্ত পেতেন। ৮ ঘণ্টায় এক দিনের কর্মদিবস ধরলে রানিং স্টাফদের প্রতি মাসে কাজ দাঁড়ায় আড়াই বা তিন মাসের সমপরিমাণ।
এ ছাড়া অবসরের পর মূল বেতনের সঙ্গে অতিরিক্ত ৭৫ শতাংশ অর্থ যোগ করে অবসরকালীন অর্থের হিসাব হতো। তবে ২০২১ সালের ৩ নভেম্বর এই সুবিধা সীমিত করে অর্থ মন্ত্রণালয়। ওই সময়ের পর নতুন করে নিয়োগ পাওয়া কর্মীরা পুরোনোদের চেয়ে আরও কম সুবিধা পাবেন বলেও সরকার সিদ্ধান্ত নেয়।
২০২২ সালের পর নিয়োগপত্রে দুটি শর্ত আরোপ করা হয়েছে। নতুন নিয়োগ পাওয়া কর্মীরা চলন্ত ট্রেনে দায়িত্বপালনের জন্য রানিং অ্যালাউন্স ছাড়া অন্য কোনো ভাতা পাবেন না এবং মাসিক রানিং অ্যালাউন্সের পরিমাণ মূল বেতনের চেয়ে বেশি হবে না। এ ছাড়া অবসরে যাওয়ার ক্ষেত্রে সর্বশেষ আহরিত মূল বেতনের ভিত্তিতে পেনশন ও আনুতোষিক পাবেন। এরপর থেকে শুরু হয় জটিলতা।
অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, রেলের কর্মচারীদের যে যৌক্তিক দাবি তা যতটুকু পূরণ করা সম্ভব, তা করেছি। এরপরও তারা কেন আন্দোলন করছে এমন প্রশ্ন করেছেন। রেলের কর্মচারীদের জন্য মানবিক কারণে যতটুকু করা দরকার করেছি। ওভারটাইম ইস্যুর সমাধান করা হয়েছে। এর বাইরের যেসব দাবি, তা পূরণ করা সম্ভব নয়। দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা বিবেচনা করতে হবে।
হুঁশিয়ারি আমলে নেয়া হয়নি
রানিং স্টাফদের দাবির বিষয় ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের পাঠানো মতামতের ভিত্তিতে সোমবার (২৭ জানুয়ারি) একটি সভা ডেকেছিল রেলপথ মন্ত্রণালয়; কিন্তু দাবির বিষয়ে অনড় থাকায় সভায় যোগ দেননি রেলের রানিং স্টাফরা। দাবি মানা না হলে মঙ্গলবার (২৮ জানুয়ারি) থেকে রানিং স্টাফরা টানা কয়েকদিন ট্রেন চালানো বন্ধ করে দেবেন, এমন হুঁশিয়ারি ওই দিন দেয়া হয়েছিল; কিন্তু সংশ্লিষ্টরা এই হুঁশিয়ারি বা ঘোষণা আমলে নেননি। তাই যাত্রীদের সতর্ক করার মতো উদ্যোগ ছিল না রেলের। উল্টো ট্রেনের টিকিট বিক্রি অব্যাহত থাকে।
বাংলাদেশ রেলওয়ে রানিং স্টাফ ও শ্রমিক কর্মচারী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. মজিবুর রহমান বলেন, ‘আমরা রেল মন্ত্রণালয়ের সভা প্রত্যাখ্যান করেছি। আমাদের কোনো কর্মচারী সভায় অংশগ্রহণ করেনি। আমরা জানতে পেরেছি, আমাদের দাবি মানা হবে না। আমাদের কাছে আরও সময় চাওয়া হবে। সেজন্যই আমরা আলোচনা প্রত্যাখ্যান করেছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘গত ডিসেম্বরে আন্দোলন করলে রেলওয়ের কর্মকর্তারা আমাদের ডাকলেন। তারা আমাদের কাছে ১০ দিন সময় চেয়েছিলেন। আমি তাদের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় দিয়েছি; কিন্তু তারা আমদের জন্য কিছু করতে পারলেন না। পরে ১ জানুয়ারি আমরা জানিয়ে দিলাম, আমরা আগামী ২৮ জানুয়ারি থেকে ট্রেন চালাব না।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে