আর কতদিন অনিরাপদ থাকবে সড়ক, আর কত দীর্ঘ হবে লাশের মিছিল?
বাংলাদেশের সড়ক দিন দিন ভয়ংকর হয়ে উঠছে। আর সড়ককে ভয়ংকর করে তুলেছে বেপরোয়া চালক, ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন এবং অদক্ষ পরিবহন প্রশাসন। নিয়ন্ত্রণহীন সড়কে বেপরোয়া ট্রাক উঠে যাচ্ছে টোল প্লাজায় থেমে থাকা ছোট যানবাহনের ওপর। দুই বাসের ওভারটেকিং প্রতিযোগিতায় খোদ রাজধানীতে বাস ঢুকে যাচ্ছে সদ্য নির্মিত বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনালের ভেতর। মহাসড়কে বড় বড় চোরা গর্ত, আর সেই গর্তে পড়ে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে মুহূর্তেই দুমড়ে-মুচড়ে যাচ্ছে যাত্রীবাহী বাস। খোদ পরিবহন কর্তৃপক্ষ জানায়, দেশে প্রায় প্রায় ৬ লাখ ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন সড়ক-মহাসড়কে চলাচল করছে। হাল্কা যানবাহনের প্রশিক্ষণ নেয়া কিশোর বয়সী চালকের হাতে তুলে দেয়া হচ্ছে ৫ টনের ট্রাক, ৬০ আসনের যাত্রীবাহী ভারী বাস। দেশের পুরো পরিবহন খাতে বছরের পর বছর ধরে চলছে চরম অরাজকতা ও বিশৃঙ্খলা। ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন পূরণ করে আমরা স্মার্ট বাংলাদেশের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি; কিন্তু সেই লক্কড়-ঝক্কড় বাসের যুগের তিমিরেই থেকে যাচ্ছে শুধু দেশের পরিবহন খাত।
এমনকি ক্যাশলেস ডিজিটাল রাইড শেয়ারিং সার্ভিসও ঢাকার রাস্তায় এসে সেই নগদ টাকার বিনিময়ে চুক্তির সার্ভিসে পরিণত হয়েছে! একমাত্র শহর ঢাকা, যেখানে রাইড শেয়ারিং অ্যাপের মাধ্যমে না হয়ে চুক্তিতে চলে এবং চালকরা নগদ টাকায় ভাড়া পরিশোধ ছাড়া সেবা দিতে রাজি হন না। পরিবহন খাতে সার্বিক অরাজকতার অনিবার্য ফল আমরা দেখেছি কীভাবে ঝালকাঠি, ফরিদপুরে মুহূর্তেই দুই পরিবারের সব সদস্য সড়কে লাশ হয়ে পড়ে থাকলেন! কীভাবে খোদ রাজধানীতে সিভিল অ্যাভিয়েশন কর্তৃপক্ষের একজন প্রকৌশলী বেপরোয়া বাসের চাকায় পিষ্ট হলেন।
একবারও কি আমরা ভেবে দেখেছি, টোল প্লাজায় প্রাইভেটকারে যে পরিবারটির সদস্যরা ঈদের ছুটি শেষে কর্মস্থলে ফিরছিলেন, তাদের অপরাধ কী? তাদের চালক তো রাস্তায় কোনো বেপরোয়া আচরণ করেনি। রাষ্ট্রের দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে টোল প্লাজায় টোল দেয়ার জন্য দাঁড়িয়েছিল। সেখানে অদক্ষ, অনভিজ্ঞ চালকের হাতে থাকা ত্রুটিপূর্ণ ট্রাক এসে প্রাইভেটকারের ওপর উঠে গেল। এটা কি সুস্পষ্ট হত্যাকাণ্ড নয়? আর এই হত্যাকাণ্ডের জন্য কি ট্রাকের মালিক দায়ী নয়? তাহলে কেন মালিককে এখনো গ্রেপ্তার করা হলো না? কেন তার বিরুদ্ধে হত্যা মামলা হবে না? ফরিদপুরের সড়ক সংঘর্ষের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। এখানেও পিকআপ ভ্যান ও বাস মালিক সমানভাবে দায়ী; কিন্তু তাদের বিরুদ্ধেও কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।
ঢাকায় এক্সপ্রেসওয়েতেও রাইদা পরিবহনের দুটি বাস প্রতিযোগিতায় লিপ্ত ছিল। বিমানবন্দরের কাছে এক্সপ্রেসওয়ে থেকে নামার সময় বেপরেপায়া গতিতে ওভারটেকিং করতে গেলে বাসটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নব নির্মিত টার্মিনালের দেয়ালে আঘাত করে এবং সেখানে কর্মস্থলে যাওয়ার জন্য মোটরবাইকে থাকা বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের একজন প্রকৌশলীকে মুহূর্তেই পিষ্ট করে বাসটি। ঢাকায় এই রাইদা পরিবহনে এর আগে ছিনতাই, ধর্ষণ, বাস থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়ে যাত্রী হত্যার ঘটনা ঘটেছে। শুধু রাইদা পরিবহন নয়, ঢাকার রাস্তায় চলাচল করা সব সিটি সার্ভিস বাসের চিত্রও একই ধরনের। বিশেষ করে বেপরোয়া ওভারটেকিং এবং রাস্তার মাঝখানে যাত্রীদের নামতে বাধ্য করার কারণে একের পর এক দুর্ঘটনা এবং নিরীহ মানুষের মৃত্যু প্রতিদিনের ঘটনা। মহাখালী টার্মিনাল থেকে চলাচল করা দূরপাল্লার বাসগুলোও একইভাবে রাজধানীর রাস্তায় ভয়ংকর বেপরোয়াভাবে চলছে, রাস্তার মাঝখানে যাত্রীদের নামতে বাধ্য করছে। কোনো যাত্রী প্রতিবাদ করলে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিচ্ছে। বিশেষ করে এনা পরিবহন, আলম এশিয়া, অন্যান্য পরিবহন এবং একতা ট্রান্সপোর্টের বিরুদ্ধে যাত্রীদের ধাক্কা দিয়ে রাস্তায় ফেলে দেয়ার অভিযোগ সবচেয়ে বেশি; কিন্তু প্রভাবশালী পরিবহন নেতারা এসব সার্ভিসের মালিক হওয়ার কারণে দেখার কেউ নেই, কোনো ব্যবস্থাও নেয়া হয় না কখনো।
উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, সড়কে চালকদের বেপরোয়া আচরণ বন্ধ কিংবা ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন চলাচল নিষিদ্ধ করতে সংশ্লিষ্ট সরকারি প্রশাসন দৃশ্যত, ব্যর্থ। সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকেও এ বিষয়টিতে যথাযথ গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে না। ঝালকাঠির এবং ফরিদপুরের ঘটনায় দেখা যাচ্ছে, ত্রুটিপূর্ণ ভারী ট্রাক এবং পিকআপ ভ্যান সড়কে চলাচল করছিল। এসব ভারী যানবাহনের চালকদেরও যথাযথ লাইসেন্স ছিল না। স্বল্প অভিজ্ঞ তরুণ এই চালকদের হাল্কা যানবাহনের লাইসেন্স ছিল; কিন্তু ট্রাকের মালিক তাদের হাতে তুলে দিয়েছে ভারী যানবাহন। এর অর্থ এ দুটি দুর্ঘটনার জন্য সরাসরি ট্রাক ও পিকআপ ভ্যান মালিকরা অবশ্যই দায়ী। অথচ দুটি ঘটনায় ২৮ জন নিরীহ মানুষ প্রাণ দেয়ার পরও প্রশাসনের পক্ষ থেকে মালিকদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার কোনো তৎপরতাই দেখা যায়নি। শুধু চালক ও চালকের সহকারীকে আটক করেই প্রশাসনের দায়িত্ব শেষ! সড়কে অপরাধের জন্য যদি অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিত না করা হয়, তাহলে সড়কে প্রতিদিন ভয়ংকর মৃত্যুর দৃশ্য আমাদের দেখতেই হবে। আমাদের একটি প্রজন্ম হয়তো সড়কেই বেপরোয়া বাস-ট্রাকের চাকার নিচে পিষ্ট হয়ে শেষ হয়ে যাবে!
কোনো সড়ক দুর্ঘটনা ঘটলেই, প্রশাসনের কেউ কেউ পথচারীদের দৌড়ে সড়ক পার হওয়ার বিষয়টি উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে সামনে এনে বাকি সবকিছু আড়াল করার চেষ্টা করেন। অথচ খোদ রাজধানীতেই রাস্তা পারের জন্য যে কয়েকটি জেব্রা ক্রসিং আছে, তার আগে কোনো সাইনবোর্ড নেই। একজন গাড়িচালকের আগে থেকে জানারই উপায় নেই, যে সামনে একটা জেব্রা ক্রসিং আছে! রাজধানীর ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ সদর দপ্তরের একটু সামনে রমনা থানার ঠিক উল্টো দিকে একটা জেব্রা ক্রসিং আছে। এখানে কয়েক মিনিট দাঁড়ালে যে কোনো সচেতন মানুষ আঁতকে উঠবেন। এখানে খুব ছোট একটি জেব্রা ক্রসিং সাইনবোর্ড আছে, যেটা চট করে কারও চোখে পড়ার কথা নয়। আর যেখানে জেব্রা ক্রসিং টানা হয়েছে, সেটা অত্যন্ত ব্যস্ত এলাকা। এখান থেকেই মগবাজার ফ্লাইওভারে ওঠার জন্য গাড়ি এগিয়ে যায়, পেছনে পরীবাগের সংযোগ সড়ক, সামনে হলি ফ্যামিলি হাসপাতালের রাস্তা। এখানে যেভাবে জেব্রা ক্রসিং দেয়া হয়েছে, তা একটি মরণ ফাঁদ ছাড়া আর কিছুই নয়! ঢাকার বাকি জেব্রা ক্রসিংগুলোর অবস্থা এর চেয়েও ভয়াবহ। সম্ভবত, এতটা ঝুঁকিপূর্ণ জেব্রা ক্রসিং দুনিয়ার আর কোথাও নেই। যখন দুই বাস ওভারটেকিং প্রতিযোগিতা করে ফুটপাতে গাড়ি উঠিয়ে পথচারীকে হত্যা করে, তখন প্রশাসনের এই কর্তাব্যক্তিরা নিশ্চুপ থাকেন।
ইউটার্নের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। বনানী ১১ নম্বর সড়কে একাধিক ক্রসিং আছে। এর কোনটিতে ইউটার্ন নেয়া যায়, কোনটিতে যায় না। যেটাতে ইউটার্ন নেয়া যায় না, তার সাইনবোর্ড রাখা হয়েছে গাছের পাতার নিচে। কেউ না দেখে ইউটার্ন নিলেই গাছের আড়াল থেকে একজন ট্রাফিক পুলিশ সদস্য লাফ দিয়ে গাড়ির সামনে হাজির হন। তারপর কি ঘটে, সেটা আমরা সবাই জানি। প্রশ্ন হচ্ছে, ইউটার্নের সাইনবোর্ড এভাবে গাছের আড়ালে লুকিয়ে রাখা হবে কেন? সাইনবোর্ড চোখে না পড়ার কারণে কোনো গাড়ি ভুল করে ইউটার্ন নিতে গিয়ে দুর্ঘটনা ঘটালে তার দায় কে নেবে? সম্ভবত, ঢাকা শহরই একমাত্র শহর যেখানে ইউটার্ন-সংক্রান্ত সাইনবোর্ড গাছের আড়ালে লুকিয়ে রাখা হয়!
সরকার আন্তরিকভাবে চাইলে সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন কিছু নয়। এর জন্য প্রথমেই পরিবহন খাতে দীর্ঘদিন ধরে চেপে বসা সিন্ডিকেট ভাঙতে হবে। অচলায়তনে পরিণত হওয়া পরিবহন কর্তৃপক্ষকে স্মার্ট প্রযুক্তি দর্শনের আলোকে ঢেলে সাজাতে হবে। ডেপুটেশনের আমলাদের পরিবর্তে সড়ক ব্যবস্থাপনায় যথাযথ অভিজ্ঞ ও প্রশিক্ষিত ব্যক্তিদের দিয়ে একটি স্বতন্ত্র পরিবহন ব্যবস্থাপনা বোর্ড গড়ে তুলতে হবে। সড়ক ব্যবস্থাপনায় ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। আমরা অন্যসব ক্ষেত্রে ডিজিটাল ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে সক্ষম হলেও সড়ক পরিবহন ব্যবস্থায় সেটা সম্ভব হয়নি। বেপরোয়া চালকের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে, ত্রুটিপূর্ণ গাড়ি রাস্তায় নামানো এবং অদক্ষ চালকের হাতে ভারী যানবাহন তুলে দেয়া মালিকদের বিরুদ্ধে আরও কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। ডিজিটাল রাইড শেয়ারিং সার্ভিস পুরোপুরি ক্যাশলেস করতে হবে। গণপরিবহন খাতে অরাজকতা বন্ধ না হলে যে কোনো দিন, যে কোনো মুহূর্তে আপনি-আমি, যে কেউই ঝালকাঠি, ফরিদপুর কিংবা বিমানবন্দর সড়কে নিহতদের মতো পরিণতির শিকার হতে পারি। এভাবে আর কতদিন অনিরাপদ থাকবে সড়ক? আর কত দীর্ঘ হবে লাশের মিছিল?
লেখক: সাংবাদিক
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে