৯৯ শতাংশ ভবনে অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা নেই, বলছে ফায়ার সার্ভিস
ভয়াবহ অগ্নি দুর্ঘটনার ঝুঁকিতে রাজশাহী নগরী, পর্ব-২
সাম্প্রতিক সময়ে রাজধানীর বেইলি রোডের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে প্রায় অর্ধশত মানুষের প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। এর পরপরই দেশের বিভিন্ন শহরের অগ্নি নিরাপত্তার বিষয়টি একের পর এক সামনে আসছে। এবার ভিউজ বাংলাদেশের অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে বিভাগীয় শহর রাজশাহীর অগ্নি ঝুঁকির বিষয়টি ওঠে এসেছে। যেখানে দেখা যাচ্ছে, যেকোনো সময় শহরটিতে ভয়াবহ আগুনের ঘটনা ঘটতে পারে।
বিষয়টি নিয়ে ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স রাজশাহী বিভাগের উপপরিচালক মো. ওহিদুল ইসলামের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, 'যে-সব বহুতল ভবন নতুন তৈরি হচ্ছে বা বিদ্যমান আছে এগুলো আমাদের ডিজি একটা ফায়ার সেফটি প্ল্যান অনুমোদন করে দেয়। আমরা পরিদর্শন করে দেই। রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (আরডিএ) থেকে একটা অনুমোদন করে। অনুমোদন করার পরে এটা আর কেউ দেখে না। তখন বাড়ির মালিকরা নিজের খেয়াল খুশিমতো বিল্ডিং তৈরি করে। একটা বিল্ডিংয়ে একটা করে সিঁড়ি, অগ্নি নির্বাপণের কোন ব্যবস্থা নেই। মোটামুটি রাজশাহীতে ৯৯ শতাংশ ভবনই অনিরাপদ।'
তিনি আরও বলেন, 'জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে নানা কাজ করছি। আমরা প্রশিক্ষণ দিচ্ছি, মহড়া, গণসংযোগ করছি। কিন্তু মানুষ যদি এখন না মানে তাহলে কি করার আছে? আইন প্রয়োগের যে ক্ষমতা সেটা আমাদের হাতে নাই। এটা তো বিচারিক ক্ষমতা। আইনে আছে জরিমানা করা হবে না হয় জেল দিতে হবে। এ জন্য ম্যাজিস্ট্রেট লাগে। তিনিই আমাদের নিয়ে মোবাইল কোর্ট করতে চায় না।'
রাজশাহীর অগ্নি নিরাপত্তা বিষয়ে মহানগর পুলিশের (আরএমপি) অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ক্রাইম এন্ড অপারেশন) মোহাম্মদ হেমায়েতুল ইসলামের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, "এটা মূলত জেলা প্রশাসনের কাজ। ঝুঁকিপূর্ণ মার্কেট যেগুলো আছে, ফায়ার সার্ভিসের সাথে মিলে জেলা প্রশাসন এগুলোর বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়। পাশাপাশি পুলিশের পক্ষ থেকে জনসাধারণের সর্তকীকরনের জন্য আমরা সাইনবোর্ড দিচ্ছি। যেখানে, ‘এটা ফায়ার সার্ভিস কর্তৃক ঘোষিত এটি অগ্নিঝুঁকিতে আছে। আপনি এখানে যাবেন কি যাবেন না ভেবে চিন্তে সিদ্ধান্ত নিবেন।’ বলে উল্লেখ আছে"
অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকিতে রয়েছে রাজশাহীর পাঁচটি মার্কেট। মার্কেট পাঁচটি হলো নগরীর সাহেব বাজার এলাকার আরডিএ মার্কেট, সমবায় মার্কেট ও কাপড়পট্টি এবং নগরীর ষষ্ঠ তলা এলাকার নিউমার্কেট, হড়গ্রাম নিউমার্কেট। এর মধ্যে আরডিএ মার্কেট হলো রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (আরডিএ) মালিকানাধীন। সমবায় মার্কেটটি সমবায় বিভাগের। আর কাপড়পট্টি গড়ে উঠেছে সাধারণ ব্যবসায়ীদের দোকানপাট নিয়ে। এছাড়া রাজশাহী নিউমার্কেট ও হড়গ্রাম নিউমার্কেট রাজশাহী সিটি করপোরেশনের।
ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে মার্কেটগুলোর সামনে সতর্কতামূলক ব্যানার টানানো হলেও রাতারাতি তা উধাও হয়ে যায়। এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে মোহাম্মদ হেমায়েতুল ইসলাম আরও বলেন, 'যারা ওখানে ব্যবসা করেন এটা হয়তো তাদের স্বার্থের পরিপন্থি। আমাদের পুলিশের পক্ষ থেকে আমরা সতর্কতামূলক সাইনবোর্ড দিচ্ছি। হয়তো দেখা যাবে এটাও অনেকে তুলে ফেলবে। কারণ এটা তাদের স্বার্থের পরিপন্থি। ফায়ার সার্ভিসের যারা এটা টাঙ্গিয়েছেন তারা যদি এটা সংক্রান্ত একটা জিডি করেন আমরা আইনগত ব্যবস্থা নিব।'
রাজশাহীর অগ্নি ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলোর বিষয়ে এবং অগ্নিনিরাপত্তা নিশ্চিতে কি ব্যবস্থা নিচ্ছে রাজশাহী জেলা প্রশাসন, জানতে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) কল্যাণ চৌধুরীর সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি সাড়া দেননি।
রাজশাহীতে অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকিতে থাকা পাঁচ মার্কেটে অগ্নিকাণ্ড ঘটলে তা নিয়ন্ত্রণে বেগ পেতে হবে বলে জানিয়েছে রাজশাহী ফায়ার সার্ভিস। আশপাশে পানির উৎস না থাকার কারণে মার্কেটগুলো ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। মার্কেটগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে আরডিএ মার্কেট।
তিনতলা এই মার্কেটে রয়েছে ১ হাজার ৯৫২টি দোকান। এই মার্কেটের তিন পাশেই সরু রাস্তা। ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি ঢোকার কোন উপায় নেই। সামনে প্রশস্ত রাস্তা থাকলেও প্রধান ফটকের কারণে মার্কেটের ভেতরে গাড়ি ঢুকতে পারবে না।
গত ৮ জানুয়ারি রাতে মার্কেটের প্রধান ফটক সংলগ্ন বাইরের অংশে একটি মুদি দোকানের দোতলার গুদামে আগুন লাগে। পরে ফায়ার সার্ভিসের ১০টি ইউনিট প্রধান সড়ক থেকে প্রায় দুই ঘণ্টা চেষ্টার পর আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। এই আগুন মূল মার্কেটে ছড়িয়ে পড়লে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি এবং বহু মানুষের হতাহতের আশঙ্কা ছিল।
অগ্নিকাণ্ডের চরম ঝুঁকি থাকায় গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি কয়েক বছর আগেই আরডিএ মার্কেট ভেঙে ফেলতে সুপারিশ করে। তবে মার্কেটটি এখনও ভাঙা হয়নি। এই মার্কেটে প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ কেনাকাটা করেন। ঈদের সময় মার্কেটের ভেতরে পা ফেলার জায়গা থাকে না।
সর্বশেষ গত বছরের ১৭ এপ্রিল আরডিএ মার্কেট, সমবায় মার্কেট ও সাহেববাজার কাপড়পট্টি, রাজশাহী নিউমার্কেট, হড়গ্রাম নিউমার্কেটকে অগ্নিনিরাপত্তায় ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করে ব্যানার টানিয়ে দেয় ফায়ার সার্ভিস। ব্যানারে লেখা ছিল, ‘অগ্নিনিরাপত্তার দিক থেকে এই মার্কেট খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। সংশ্লিষ্ট সকলকে সতর্ক হওয়ার জন্য অনুরোধ জানানো হলো।’ এছাড়া সবাইকে সতর্ক থাকার অনুরোধ জানিয়ে মাইকিং করার পাশাপাশি প্রচারপত্রও বিতরণ করা হয়।
আরডিএ মার্কেট ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক ফরহাদ মামুদ হাসানের মতামত জানতে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি মন্তব্য জানাতে অস্বীকৃতি জানান। একই ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি ফরিদ মাহমুদ হাসানের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তা বন্ধ পাওয়া যায়। ফলে এ বিষয়ে তাদের কোনও বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি।
এদিকে, কাপড় পট্টির অগ্নি নিরাপত্তা নিয়ে কথা বলতে বস্ত্র ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক শামীম আহাম্মেদের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, 'আমাদের মার্কেট কোনও ঝুঁকিপূর্ণ না, ওদের (ফায়ার সার্ভিস) ইচ্ছা হয়েছিল ওরা লিখে দিয়েছে । আমাদের মার্কেট তো চলছে। কিছু হয় নি এ পর্যন্ত।'
এক বছর হলো কিছু হয়নি দাবি করে তিনি আরও বলেন, 'আমাদের দোকানে পানির ব্যবস্থা আছে। সব ব্যবস্থা আছে আমাদের।'
অন্যদিকে, রাজশাহী নিউমার্কেটের অগ্নি নিরাপত্তা নিয়ে কথা বলতে রাজশাহী নিউ মার্কেট ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. মুনজুর হোসেনের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বাইরে আছেন জানিয়ে ফোন কেটে দেন। ফলে তার বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি।
এদিকে নগরের স্যান্ডেল পট্টির অগ্নি নিরাপত্তা নিয়ে কথা হলে রাজশাহী সিটি পাদুকা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী মালিক সমবায় সমিতি লি. এর সভাপতি শফিকুর রহমান রিপন তাদের মার্কেটে অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকি নেই দাবি করে বলেন, 'আমাদের মার্কেট একদম খোলামেলা। ছোট মার্কেট ও রাস্তার ধারে। এখানে কোনও ঝুঁকি নাই।'
অগ্নিনিরাপত্তা বিষয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব (পিআরএল) ও রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের (রাসিক) সাবেক প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ড. এবিএম শরীফ উদ্দিন বলেন, 'এ বিষয়গুলো ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের বা জেলা প্রশাসনের। মেয়র চাইলে সকল সংস্থা বা দপ্তরকে বলে দিতে পারেন সমন্বয় করে কাজ করতে।'
রাজশাহীতে মার্কেট অগ্নি ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করা এবং অগ্নিনিরাপত্তা নিশ্চিতে কী পদক্ষেপ নিচ্ছে রাজশাহী সিটি কর্পোরেশন (রাসিক)? এর উত্তরে রাসিকের প্রধান প্রকৌশলী মো. নূর ইসলাম বলেন, 'আমি এ বিষয়ে কিছু জানি না। ভবনের কোন অনুমতি আমরা দেই না। আরডিএ প্ল্যান পাশ করে, তারা দেখবে।'
একই বিষয়ে রাসিকের নগর পরিকল্পনাবিদ বনি আহসান বলেন, 'অগ্নি নির্বাপণ ব্যবস্থা নিয়ে আমাদের কথা বার্তা চলছে। তবে এখনও আমরা কোনও বাস্তবায়নে যেতে পারিনি।'
তবে রাজশাহীর অগ্নি ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলোর বিষয়ে এবং অগ্নিনিরাপত্তা নিশ্চিতে রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (আরডিএ) কী পদক্ষেপ নিচ্ছে তা জানতে আরডিএর চেয়ারম্যান (যুগ্ম সচিব) জিয়াউল হকের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা চেষ্টা করেও তা সম্ভব হয়নি।
( দুই পর্বের সিরিজের শেষ অংশ)
প্রথম পর্বের লিংক: https://viewsbangladesh.com/bn/rajshahi-at-risk-of-terrible-fire-anytime-part-1/
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে