রাখাইনের সার্বভৌমত্বের পথ এবং বাংলাদেশে এর প্রভাব
দিন যত যাচ্ছে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে আরাকান আর্মি (এএ) ততই প্রবল শক্তিতে আবির্ভূত হচ্ছে। আরাকান আর্মি ধীরে ধীরে রাখাইন রাজ্য দখল করে নিচ্ছে। শেষ পর্যন্ত তারা রাখাইনে ‘স্বাধীন’ রাষ্ট্রের সম্ভাবনা বাড়িয়ে দিয়েছে। আরাকান আর্মি যদি সত্যিই একটি সার্বভৌম সত্ত্বা হিসেবে আবির্ভূত হয়, তাহলে এই অঞ্চলের ভূরাজনীতিও অনেক বদলে যাবে। আর তার ফলে প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশেও এর বড় প্রভাব পড়বে। এই ভূরাজনীতি মোকাবিলার জন্য বাংলাদেশকেও অনেক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে। বঙ্গোপসাগরের সঙ্গে রয়েছে রাখাইনের কৌশলগত অবস্থান, যা মিয়ানমারের সামুদ্রিক প্রবেশদ্বার হিসেবে ব্যবহৃত হয়, ফলে এটা বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা, অর্থনীতি এবং স্থিতিশীলতার জন্য অত্যন্ত চিন্তার বিষয়।
স্বাধীন রাখাইন স্টেটের সীমান্ত বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের সঙ্গে বঙ্গোপসাগরে সরাসরি প্রবেশাধিকার পাবে, ফলে আঞ্চলিক বাণিজ্য ও ভূরাজনীতিতে রাখাইনের অবস্থান হবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই সার্বভৌমত্ব নিঃসন্দেহে আরাকান আর্মি দ্বারাই পরিচালিত হবে, যারা রাখাইন জনগণের জন্য স্বায়ত্তশাসন চায়। তবে, জাতিগত এই স্বায়ত্তশাসন মিয়ানমার সহজে মেনে নেবে না তা বলাই বাহুল্য। ঐতিহাসিকভাবেই তারা এর বিরোধী। তাদের এই বিরোধিতা যে দীর্ঘস্থায়ী সংঘর্ষের জন্ম দেবে তাও সহজেই অনুমান করা যায়। এই সংঘর্ষ শুধু মিয়ানমার বা রাখাইন স্টেটকেই ভোগাবে না, তা পুরো অঞ্চলটিকেই অস্থিতিশীল করে তুলবে। সামরিক বাহিনী কর্তৃক অধিকৃত রাখাইন অঞ্চল, যারা সবসময় মিয়ানমারের কেন্দ্রীয় সামরিক বাহিনীর সঙ্গে লড়াইয়ে জড়িয়ে থাকবে, তা স্বাভাবিকভাবেই বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব সীমান্ত অঞ্চলের অস্থিরতাকে ক্রমশ বাড়িয়েই তুলবে।
বাংলাদেশে এরই মধ্যে মানবিক বিপর্যয় ঘটতে শুরু করেছে। আরাকান আর্মির আক্রমণের জেরে রোহিঙ্গারা ঘরবাড়ি ছেড়ে বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নিয়েছেন। আরাকান আর্মির সঙ্গে রোহিঙ্গাদের বিরোধ রয়েছে, ফলে আরাকান আর্মির প্রভাব রোহিঙ্গাদের বাস্তুচ্যুতি আরও বাড়াবে। এটা বাংলাদেশকে আরও চাপে ফেলবে। আগে থেকে অবস্থানরত ১০ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীর সঙ্গে আরও রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নেবে। এই কয়েক মাসে আরও কয়েক হাজার রোহিঙ্গা এসে আশ্রয় নিয়েছেন। ইতোমধ্যেই এটা এক স্থায়ী বোঝা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। আরাকান আর্মি কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত স্বাধীন বা স্বায়ত্তশাসিত রাখাইন স্টেট এই সংকটকে আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে। আরও অধিকসংখ্যক শরণার্থীকে বাংলাদেশে ঠেলে দিতে পারে। স্থানীয় সম্প্রদায়গুলোর মধ্যে এ নিয়ে যে অসন্তোষ চলমান এই পরিস্থিতি এ অসন্তোষকে আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে বলে আশাঙ্কা করা যাচ্ছে।
মানবিক বিপর্যয় ছাড়াও বাংলাদেশের নিরাপত্তার বিষয় আছে। এ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ সরাসরি নিরাপত্তা ঝুঁকিতে পড়বে। স্বাধীন রাখাইনে যেসব সশস্ত্র রোহিঙ্গা গোষ্ঠীকে প্রান্তঃসীমার দিকে ঠেলে দেয়া হবে তারা এসে বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে পারে, তাদের সামরিক তৎপরতার ঘাঁটি গাড়তে পারে বাংলাদেশে। আন্তঃসীমান্তের বিদ্রোহের ঝুঁকিও এতে বাড়বে। এর ফলে বাংলাদেশ-মিয়ানমারের সম্পর্ক নিয়ে টেনশন শুরু হবে। ঢাকাকে অনিবার্য এক সংঘাতের দিকে টেনে আনবে। তা ছাড়া, বঙ্গোপসাগর বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এক অর্থনৈতিক লাইফলাইন। ক্ষমতার লড়াই, মাছ ধরা, পেট্রোলিয়াম অনুসন্ধান এবং সামদ্রিক বাণিজ্যের জন্য এই গুরুত্বপূর্ণ সাগর হয়ে উঠতে পারে লড়াইয়ের রঙ্গমঞ্চ।
রাখাইনের রাজনৈতিক পরিবর্তনে শুধু যে বাংলাদেশই বিপাকে পড়বে তা না, ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে রাখাইনের কৌশলগত গুরুত্ব নিকটবর্তী প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যেও পড়বে। বেল্ট অ্যান্ড রোড প্রতিষ্ঠার জন্যও রাখাইন স্টেট চীনের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থি, যেখানে শক্তি আমদানি এবং বাণিজ্যের জন্য কিয়াউকফিউ গভীর-সমুদ্র বন্দর একটি গুরুত্বপূর্ণ লিঙ্ক হিসাবে কাজ করে। জানা গেছে, বেইজিং তার বিনিয়োগ রক্ষার জন্য আরাকান আর্মির সঙ্গে কূটনৈতিকভাবে জড়িত । এতে এটাই বোঝা যায় যে, এই অঞ্চলে ক্ষমতা পরিবর্তনের গতিশীলতার সঙ্গে চীন খাপ খাইয়ে নিতে প্রস্তুত।
রাখাইনের সঙ্গে ভারতেরও গুরুত্বপূর্ণ স্বার্থ জড়িত। কালাদান মাল্টি-মোডাল ট্রানজিট ট্রান্সপোর্ট প্রজেক্ট ভারতের উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলোকে বঙ্গোপসাগরের সঙ্গে সংযুক্ত করেছে, নয়াদিল্লির পূর্বাঞ্চলীয় নীতির জন্য স্থানটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। রাখাইনের অস্থিতিশীলতা ভারতকেও চিন্তায় ফেলবে। এই অঞ্চল নিয়ে ভারতের যে আঞ্চলিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা- রাখাইনের ক্ষমতার পটপরিবর্তন- সেই আগুনে পানি ঢেলে দেবে। এর মধ্যে ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চীনকে ঠেকাতে যুক্তরাষ্ট্র রাখাইনকে প্রধান খেলোয়াড় হিসেবে ব্যবহার করতে চাচ্ছে। এটা এই অঞ্চলের ভূরাজনীতিকে আরও জটিল করে তুলছে।
বৈশ্বিক শক্তির এই লড়াই বাংলাদেশের জন্য বিপজ্জনক। ভবিষ্যতের জরুরি পদক্ষেপ নিতে বাংলাদেশকে এখনই সতর্ক ও সক্রিয় হতে হবে। রাখাইনে ক্রমবর্ধমান সংকট মোকাবিলায় ঢাকাকে অবশ্যই তার কূটনৈতিক প্রচেষ্টা জোরদার করতে হবে। নিশ্চিত করতে হবে যে ভূরাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতায় তারা পিছিয়ে যাবে না। নিজের স্বার্থকে কোনোভাবে এড়িয়ে যাবে না। রোহিঙ্গা সংকট সমাধানের জন্য অন্যান্য দেশের সহযোগিতা নিতে হবে। আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্মের সুবিধা নিয়ে বাংলাদেশের উচিত চীন ও ভারতের মতো প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করা।
যদিও রাখাইন সত্যিই একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আবির্ভূত হবে কি না তা এখনো অনিশ্চিত। যদি হওয়ার সম্ভাবনাও থাকে তাও বাংলাদেশের ওপর অনিবার্য প্রভাব ফেলবে। এর মধ্যেই যে মানবিক বিপর্যয় দেখা গেছে, সীমান্ত অঞ্চল নানা ঝুঁকির মধ্যে পড়ছে, যার কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতির ওপরও চাপ বাড়ছে- এ থেকে উত্তরণের উপায় একটি সমন্বিত ও কৌশলগত উদ্যোগ। পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর সঙ্গে কূটনৈতিকভাবে সম্পৃক্ত হয়ে, নিরাপত্তা জোরদার করে এবং অর্থনৈতিক স্বার্থ রক্ষা করে বাংলাদেশ এই ক্রমবর্ধমান চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে পারে। ভূরাজনৈতিক কারণে বাংলাদেশ এই অঞ্চলে গুরুত্বপূর্ণ- সঠিক উদ্যোগ ও নীতিমালা প্রণয়ন করে বাংলাদেশ এই এই অঞ্চলে একটি স্থিতিশীল শক্তি হিসেবে অবস্থান করতে পারে। পুরো বিষয়টিই নির্ভর করে এই পরিস্থিতি ঢাকা কীভাবে মোকাবিলা করবে তার ওপর। যে দ্রুতগতিতে এই অঞ্চলের ভূরাজনীতি পরিবর্তিত হচ্ছে, বাংলাদেশ সরকার তা কীভাবে মোকাবিলা করবে তার ওপর কেবল বাংলাদেশেরই ভবিষ্যৎ নির্ভর করে না, এই অঞ্চলের সামগ্রিক ভূরাজনীতিই নির্ভর করে।
আবু নাজম ম তানভীর হোসেন: পাবলিক পলিসি অ্যাডভোকেট।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে