রমজানের বাজার: স্বস্তি-অস্বস্তির দোলাচলে ক্রেতারা
এবারের রমজান মাসে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দামে ঊর্ধ্বগতি সীমিত। কিছু পণ্যের দাম স্থিতিশীল। বেড়েছে কিছু পণ্যের দাম। শাক-সবজির দাম অনেকটা কম। চিনি, ডাল, ছোলা, বেসনের দাম স্থিতিশীল। ক্ষেত্রবিশেষে কমেছে কেজিতে ৫ থেকে ১০ টাকা। তবে চালের দাম বেড়েছে। তেলের দামেও ঊর্ধ্বগতি। খেজুরের দাম অনেক উঁচুতে স্থির রয়েছে। ফলের দাম বেশি। লেবু, শসা ও বেগুনের দাম আকাশচুম্বি। বিভিন্ন পণ্যের বাজার দরে অনেকটা স্বস্তি এবং অস্বস্তির দোলাচলে ঘোরপাক খাচ্ছেন সাধারণ মানুষ।
এবারের রমজান শুরু হয়েছে শীতের শেষে। বাজারে শীতকালীন সবজির বিপুল সমারোহ ছিল। গত বন্যার পর মূল্য বৃদ্ধির কারণে দেশের কৃষকগণ সবজির চাষ বাড়িয়েছেন। উৎপাদন ভালো হয়েছে। ফলে শাক-সবজির দাম দ্রুত হ্রাস পেয়েছে। তার সঙ্গে দ্রুত কমেছে আলু এবং পেঁয়াজের দামও। এ দুটো পণ্য আমদানি হয়েছে। উৎপাদনও ভালো হয়েছে। এখন উৎপাদন মৌসুম। তাই দাম কমেছে। এতে উৎপাদনকারী কৃষকদেরই সাফল্য বেশি। তবে উৎপাদন খরচেরও অনেক কম দামে এখন কৃষকদের শাক-সবজি, আলু, পেঁয়াজ বিক্রি করতে হচ্ছে। এটা তাদের জন্য অস্বস্তির বিষয়; কিন্তু বাজারে দাম কম থাকায় অনেকটা স্বস্তিতে আছেন ভোক্তারা।
রোজার আগে বিভিন্ন নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানির ওপর কর ও শুল্ক হ্রাস করেছে সরকার। এর মধ্যে অন্যতম পণ্য হলো চিনি, ডাল, খেজুর, ছোলা ইত্যাদি। ফলে এসব পণ্যের আমদানি বেড়েছে। বাজারে এসব পণ্যের সরবরাহ বেড়েছে। রোজায় এসবের চাহিদা বাড়লেও মূল্য বৃদ্ধি হয়নি। ক্ষেত্রবিশেষে দাম কিছুটা কমেছে। তবে খেজুরের দাম আগের মতোই অনেক উঁচুতে স্থির রয়েছে। ভালোমানের খেজুর ৪৫০ টাকা থেকে ১,২০০ টাকা কেজি। নিম্নমানের নরম খেজুর বিক্রি হচ্ছে ২০০ টাকায়। শুল্ক ছাড়ের প্রভাব এক্ষেত্রে খুবই কম। তবে রমজানের শুরুতে এসব পণ্যের দাম কিছুটা বেশি ছিল, চাহিদা বৃদ্ধির কারণে। ক্রমেই তা শিথিল হয়ে আসছে। সামনে এসব পণ্যের চাহিদা কমবে, দামও কমবে।
রমজানে অনেক বেশি ব্যবহৃত কৃষি পণ্যের মধ্যে রয়েছে লেবু, শসা ও বেগুন। শুরুতে এগুলোর দাম ছিল আকাশচুম্বি। লেবুর হালি বিক্রি হয়েছে আকারভেদে ৮০ টাকা থেকে ২০০ টাকায়। আগে ছিল ২০ টাকা থেকে ৪০ টাকা। বেগুন বিক্রি হয়েছে ৮০ থেকে ১০০ টাকা কেজি। রমজানের আগে ছিল ৪০ থেকে ৫০ টাকা কেজি। শসা বিক্রি হয়েছে ৬০ টাকা থেকে ৮০ টাকা কেজি। আগে ছিল ৪০ থেকে ৫০ টাকা। এসব পণ্যের ভরা উৎপাদন মৌসুম এখন নয়। শুকনো মৌসুমে এসব পণ্যের উৎপাদন থাকে কম। এপ্রিল-মে মাসে যখন তায়ে তায়ে বৃষ্টি হবে তখন এসব পণ্যের উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে। সে সময় দামও কমে আসবে। রোজার সময় এ পণ্যগুলোর চাহিদা বেড়ে যায়। উৎপাদন সীমিত থাকায় মূল্য বৃদ্ধি পায়। তবে এ রমজানে এগুলোর মূল্য অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। কৃষকরা তাতে প্রতি কেজি ১০ থেকে ১৫ টাকা বেশি দামে বিক্রি করেছে; কিন্তু তাতে প্রকৃত লাভবান হয়েছে বাজারের মধ্যস্বত্বভোগীরা। এ ক্ষেত্রে মনিটরিং কাজে নিয়োজিত সংশ্লিষ্ট সরকারি বিভাগগুলোর নিষ্ক্রিয় প্রয়াস লক্ষণীয়।
ভোক্তাদের সবচেয়ে বেশি অস্বস্তির কারণ হলো চাল ও তেলের মূল্য বৃদ্ধি। গত সপ্তাহেও চালের দাম বেড়েছে প্রতি কেজিতে ৩ থেকে ৫ টাকা। তেলের সরবরাহ সংকটে খুচরা পর্যায়ে ভোগান্তিতে ফেলেছে গরিব ভোক্তাদের। চাল ও তেলের খরচ নিম্নআয়ের মানুষের খাদ্য ঝুড়িতে অনেক বেশি ভার বহন করে। ফলে এসবের মূল্য বৃদ্ধি গরিব মানুষের জন্য বড় ভোগান্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এবার বন্যার কারণে আউশ ও আমন ধানের উৎপাদন অপেক্ষাকৃত কম হয়েছে। কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় আমদানি হয়নি চাল। সরকারের অভ্যন্তরীণ সংগ্রহের পরিমাণও তেমন ভালো ছিল না। এসব কারণে চালের বাজারজাত উদ্বৃত্ত কম। সরকারের হস্তক্ষেপও অপর্যাপ্ত। চালের বাজার নিয়ন্ত্রণ করছেন মূলত অসাধু ব্যবসায়ীরা। তারা অযাচিত মুনাফা লুটে নিচ্ছেন। এখন মার্চ মাসের শেষ। বোরো ধান কাটা এবং নতুন চাল বাজারে আসতে আরও প্রায় দুই মাস সময় লেগে যাবে। এ সময় চালের দাম কমার সম্ভাবনা খুবই কম। তেলের দামও নিয়ন্ত্রণ করছে গুটিকতক আমদানিকারক ব্যক্তি প্রতিষ্ঠান। গত কয়েকদিন ধরে বাজারে তেলের সরবরাহ বাড়বে বলে প্রচার করে আসছিল অনেকে; কিন্তু বাস্তবে সেই অবস্থার যথেষ্ট উন্নতি হয়নি। আধা ও এক লিটার বোতলজাত তেলের ক্ষেত্রে এখনো খুচরা পর্যায়ে বেশি দাম দিতে হচ্ছে ক্রেতাদের। তবে সুপারশপগুলোতে বোতলের গায়ে লেখা নির্ধারিত মূল্যে পাওয়া যাচ্ছে সয়াবিন তেলসহ অন্যান্য জাতের তেল।
তাছাড়া বিভিন্ন মসলার দাম বাজারে অনেক চড়া। এলাচ, দারুচিনি, জিরা বাজারে বিক্রি হচ্ছে আগের চেয়ে অনেক বেশি দামে। এক্ষেত্রে নজরদারির অভাব। বাজারে এখন শাক-সবজির দাম কম থাকায় মুরগির ডিমের দাম হ্রাস পেয়েছে। ১০০ টাকা থেকে ১১০ টাকায় পাওয়া যাচ্ছে এক ডজন ডিম। ব্রয়লার মুরগির দামও অপেক্ষাকৃত কম। প্রতি কেজি ২০০ টাকা। তবে গরুর মাংসের দাম বেশি, ৭৫০ থেকে ৮০০ টাকা কেজি। রোজার শুরু থেকে দাম বেড়ে সাড়ে ১১০০ টাকা থেকে ১২০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি খাসির মাংস। তবে দাম বাড়ায় এসব পণ্যের বিক্রি অনেক কমে গেছে। মুরগির ডিম ও মুরগির মাংসের দাম কমায় ভোক্তারা খুশি; কিন্তু দুধের দাম কিছুটা বৃদ্ধিতে তাদের অস্বস্তি।
রমজানে বিভিন্ন তাজা ফলের কদর বেড়ে যায়। তাতে মূল্য বৃদ্ধি পায়। এবারও তার ব্যতিক্রম নয়। সব ধরনের বিদেশি তাজা ফলের দাম বাড়তি। দেশি ফলের মধ্যে বেড়েছে তরমুজের দাম। রোজার শুরুতে তরমুজের কেজি ছিল ৭০ থেকে ৮০ টাকা। তখন ক্রেতা ছিল কম। এখন দাম কিছুটা কমেছে। কেজি হিসেবে তরমুজ বিক্রি হচ্ছে ৫০ থেকে ৬০ টাকায়। প্রতিটি তরমুজের দাম গড়ে এখন প্রকারভেদে প্রায় ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা। সুপারশপগুলোতে কাটা তরমুজ বিক্রি হয় যা অনেক ক্রেতার দৃষ্টি আকর্ষণ করে; কিন্তু খোলাবাজারে তরমুজ কেটে অর্ধেক বা এক-চতুর্থাংশ করে বিক্রি হয় না। ফলে অনেক ক্রেতার পক্ষে একটি বড় তরমুজ বেশি দাম দিয়ে কেনা সম্ভব হয় না।
অভ্যন্তরীণ বাজারে চাল ও তেলের দাম বৃদ্ধি পেলেও বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাজারে তা হ্রাস পাচ্ছে। আগামী দিনগুলোতে আমদানি বৃদ্ধি পেলে এসব পণ্যের দাম খুচরা পর্যায়ে হ্রাস পাবে। তাতে সাধারণ ক্রেতাদের মনে স্বস্তি ফিরে আসবে। তবে শীতকাল চলে যাওয়ায় অধিকাংশ শাক-সবজির উৎপাদন ও সরবরাহ হ্রাস পাবে। তাতে মূল্য বেড়ে যাবে। সামনের এপ্রিল ও মে মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতি কিছুটা বেড়ে যেতে পারে। তবে ব্যবস্থাপনা ভালো হলে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম স্থিতিশীল রাখা সম্ভব হবে।
বর্তমানে মানুষের আয় কম। কর্মসংস্থান কম। বিনিয়োগে পড়েছে ভাটা। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অনেক ক্ষেত্রে নাজুক। এরই সঙ্গে উচ্চ মূল্যস্ফীতি মানুষের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলছে। গরিব মানুষের ক্রয়ক্ষমতা অনেক কমে গেছে। প্রয়োজন মতো হাত খুলে খরচ করতে পারছে না। তাকে আর্থিক অনটনের কথা ভাবতে হচ্ছে। এমতাবস্থায় সামনের দিনগুলোতে মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরা হবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এর জন্য উৎপাদন বৃদ্ধির কোনো বিকল্প নেই। বর্তমানে মাঠে আছে বোরো ধান। বিভিন্ন কারণে তা ঝুঁকির সম্মুখীন। রাসায়নিক সারের উপরি প্রয়োগ, কীটনাশক ব্যবহার ও পানি সেচ নিয়মিত চালিয়ে যাওয়া কৃষকদের জন্য বড় উদ্বেগের বিষয়। তার ওপর সম্ভাব্য প্রাকৃতিক দুর্যোগ হাওড়ে ও সমতলে দুশ্চিন্তার ভাঁজ ফেলেছে কৃষকদের চোখে মুখে। সবকিছু ভালোভাবে গুছিয়ে নিয়ে বোরো ধান কাটা সম্ভব হলে দুই মাস পরে সুদিন আসবে কৃষকদের। ইতোমধ্যেই তারা ঋণগ্রস্ত। কৃষি উপকরণের চড়া দামে বেড়ে গেছে উৎপাদন খরচ। এ সময় উপকরণের ওপর আচ্ছাদিত ভর্তুকি কৃষকদের তেমন অনুপ্রাণিত করে না। সাময়িক আর্থিক অনটন ও মূল্যস্ফীতির দুর্ভোগ লাঘবে তাদের জন্য দরকার নগদ ভর্তুকি ও প্রণোদনা। সামনের ঈদে সরকারি কর্মচারী ও বেসরকারি কর্মীদের বোনাস দেয়া হবে। ক্ষেত্রবিশেষে অনেকে মহার্ঘ ভাতা পাবেন; কিন্তু গরিব কৃষকদের জন্য কোনো সুখবর থাকে না। এই বৈষম্যের অবসান হওয়া উচিত। যারা দিবানিশি অক্লান্ত পরিশ্রম করে দেশের মানুষের আহার জোগায়, তাদের জন্য রমজানে ও ঈদে নগদ সহায়তা প্রদানের ব্যবস্থা থাকা উচিত।
রমজান মাস মূলত সিয়াম সাধনার মাস। রহমত, বরকত ও মাগফিরাতের মাস। এ মাসে অনেকে তাদের জাকাত আদায় করেন, গরিব আত্মীয়স্বজনকে অর্থ দান করেন এবং ফিতরা আদায় করেন। তাতে অসহায় দরিদ্র মানুষের আয় বাড়ে। তাদের দারিদ্র্যের ভার লাঘব হয়। মানুষে মানুষে কিছুটা বৈষম্য হ্রাস পায়। পৃথিবীর অনেক মুসলিম দেশে রমজান মাস এলে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম কমানো হয়। নিম্নআয়ের মানুষের জন্য সহায়তা বাড়িয়ে দেয়া হয়। উন্নত অমুসলিম দেশগুলোতেও তাদের ধর্মীয় অনুষ্ঠানের আগে কম দামে পণ্য বিক্রি করা হয়। বড় ধরনের ছাড় দিয়ে পণ্যের দাম নির্ধারণ করা হয় ক্রিস্টমাসের আগে। বাংলাদেশে রমজানে বা ঈদের আগে পণ্য মূল্যে ছাড় দেয়ার দৃষ্টান্ত বিরল। অনেক ক্ষেত্রে পণ্যের দাম বাড়িয়ে বরং অতিরিক্ত মুনাফা নেয়ার চেষ্টা করা হয়। তাতে বাজারে নিম্নআয়ের মানুষের প্রবেশাধিকার খর্ব হয়। এই মানসিকতার পরিবর্তন দরকার। দেশের বিত্তবান ও ব্যবসায়ী শ্রেণির লোকেরা মানবিক গুণাবলীর চর্চা করবেন, তারা বিত্তহীনদের প্রতি সহানুভূতিশীল হবেন এমনটি আমরা আশা করতে পারি। আগামী ঈদে মানুষ বাজারে গিয়ে স্বস্তি পাবেন, সুলভ মূল্যে তারা কেনাকাটা করতে পারবেন এটা সবার প্রত্যাশা।
ড. জাহাঙ্গীর আলম: কৃষি অর্থনীতিবিদ। সাবেক মহাপরিচালক, বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউট; সাবেক উপাচার্য, ইউনিভার্সিটি অব গ্লোবাল ভিলেজ।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে