Views Bangladesh Logo

রানা প্লাজা ট্রাজেডি

রানা প্লাজা ট্রাজেডি: জীবন বাঁচিয়ে বিনিময়ে পেল অবসাদ, হতাশা আর অবহেলা

০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল, ঢাকার সাভারে ঘটে যায় একটি মারাত্মক দুর্ঘটনা, যা সারাবিশ্বকে স্পর্শ করে। নয় তলা বাণিজ্যিক ভবন 'রানা প্লাজা' চোখের নিমিষেই ধ্বসে পড়ে ফলে প্রায় ১,১৩৮ জন মানুষের প্রাণহানি ঘটে, যাদের বেশিরভাগই ছিলেন তৈরি পোশাক কারখানার শ্রমিক। এই ঘটনায় আহত হন হাজার হাজার মানুষ। বিশ্বের অন্যতম একটি ভয়াবহতম শিল্প দুর্যোগের ঘটনায় স্তম্ভিত হয়ে পড়ে সারাবিশ্বের মানুষ।

পূর্বের অনভিজ্ঞতা এবং আধুনিক ব্যবস্থা না থাকায়, উদ্ধার কাজে নিয়জিত সরকারী কর্মীরা কোনভাবেই যখন সামলে উঠতে পারছিলেন না, তখন কিছু সাহসী স্বেচ্ছাসেবী নিজেদের জীবন বাজি রেখে উদ্ধারকাজে অংশগ্রহণ করেন। দিনের পর দিন ধ্বংসস্তুপের মধ্যে থেকে তারা উদ্ধার করেন পচাগলা মরদেহ। নিজেদের সর্বোচ্চ সক্ষমতা কাজে লাগিয়ে উদ্ধার করে আনেন আহতদের। মানুষের বিকৃত মরদেহ, আহতদের কষ্ট আর আটকে পড়াদের বাঁচার আকুতি দেখতে দেখতে তারা তলিয়ে যান হতাশার অতল সাগরে। সেই দূর্বিষহ স্মৃতি তাদের তাড়া করে ফিরে বহুদিন, স্বাভাবিক জীবন থেকে তারা হয়ে পড়েন বিচ্ছিন্ন। অনেকেই হতাশায় আত্মহত্যার পথ বেছে নেন আর যারা বেঁচে থাকেন, তারাও ডুবে যান বিষাদে। অথচ, রাষ্ট্র, সমাজ এবং জাতি তাদের কথা ভুলে যায় খুব অল্প দিনের মধ্যেই। তাদের মানসিক শান্তি বা সাহসিকতার স্বীকৃতিস্বরূপ কোন পদক্ষেপই কেউ নেয় নি। এরকম দুইজন উদ্ধারকারী ছাত্র ফেডারেশনের নেতা হিমু এবং মসিউর রহমান।

হতাশায় জীবন দিলেন হিমু

হিমু, একজন তরুণ ছাত্র, যখন রানা প্লাজার ধ্বসের খবর শোনেন, তখন তিনি স্থির থাকতে পারেননি। ভয়ানক পরিস্থিতিতে নিজের জীবনকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দ্রুত উদ্ধারকাজে নামেন। মৃত্যুর সীমানায় দাঁড়িয়ে থাকা মানুষদের আর্তনাদ তার মনকে নাড়া দেয়। ব্লেড দিয়ে আহতদের শরীর থেকে হাত-পা কেটে তাদের জীবন রক্ষা করার চেষ্টা তার মনে যে ছাপ ফেলে, তা জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তাকে তাড়িত করে।

তিনি মানুষের জন্য দাঁড়ালেন, কিন্তু শেষপর্যন্ত এই ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা তার মানসিক স্থিতিশীলতা ধ্বংস করে দিল। বারবার চেষ্টা করলেন ফিরে দাঁড়াতে, চাকরি নিলেন স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে। কিন্তু, হতাশায় নিমজ্জিত তরুণটি ফিরতে পারলেন না। রাষ্ট্রীয় বা সামাজিকভাবে কোন ব্যক্তি বা সংগঠন এগিয়ে এল না হিমুর সাহায্যে। এতবড় ঘটনার ট্রমা কিভাবে কাটালেন এই তরুণ সেই খবর রাখলো না কেউ। দীর্ঘদিনের ট্রমার কাছে তিনি হেরে গেলেন এবং আত্মহত্যার পথ বেছে নিলেন। যেখানে মানবতার জন্য জীবন উৎসর্গ করলেন, সেখানেই তার মানসিক স্বাস্থ্যের সুস্থতার প্রয়োজনীয়তা হলো অগ্রাহ্য!

হিমুর ঘনিষ্ঠ বন্ধু রিফাত সালাম।পেশায় সাংবাদিক রিফাত সেসময় আহতদের সেবায় নিয়োজিত থাকলেও সরাসরি উদ্ধারকাজে অংশ নেন নি। তবে, হিমুর সহযোদ্ধা হিসেবে সর্বক্ষণ যোগাযোগের মধ্যে ছিলেন।

স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি বলেন,' হিমুর সঙ্গে প্রায় প্রতিদিন কথা হতো।লাশের সংখ্যা যত বাড়ছিল, ওর হতাশা এবং ট্রমা তত বাড়ছিল। উদ্ধারকাজ শেষে ও যখন ফিরে আসে, তখন সে অনেকটাই চুপচাপ হয়ে যায়। একধরণের হতাশা আর অবসাদের মধ্যে ডুবে যায় হিমু। একসময় নিজের বাড়িতে যাওয়াও বন্ধ করে দেয়। চাকরিতে যোগ দেয়, কিন্তু মনকে স্থির করতে পারে না।একপর্যায়ে ঘুমের ওষুধের ওপরে নির্ভরশীল হয়ে পড়ে, তাতেও কোন লাভ হয় না। অবশেষে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়।'

'এখানে সবচেয়ে জরুরি ছিল যারা ব্যক্তি উদ্যোগে বা বিভিন্ন সংগঠনের ব্যানারে উদ্ধার কাজে অংশ নিয়েছিল, তাদের একটা তালিকা করে মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টা দেখা। এটা রাষ্ট্রীয়, সাংগঠনিক বা ব্যক্তিগত কোনপর্যায়েই হয়নি। শারীরিকভাবে আহত উদ্ধার কর্মীদের চিকিৎসা হয়েছে, কিন্তু মানসিকভাবে ভেঙে পড়া কর্মীদের নিয়ে কেউ আসলে কিছুই ভাবেনি।'

সেই ট্রমা এখনও তাড়া করে মসিউরকে

মসিউর রহমান তখন প্রাইভেট একটি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত। দূর্ঘটনার খবর শুনেই নিজের কাজ ফেলে ছুটে যান। টানা ১৬ দিন ধরে উদ্ধারকাজে অংশ নেন। নিজ হাতে একাধিক মৃতদেহ বের করেন এবং চোখের সামনে আটকেপড়া জীবন্ত মানুষদের চিরতরে হারিয়ে যাওয়া অসহায়ভাবে দেখতে থাকেন। এই ভয়াবহ অভিজ্ঞতা তার মনে স্থায়ী দাগ ফেলে।

ভিউজ বাংলাদেশকে তিনি জানান, 'নিজ হাতে একাধিক মৃতদেহ বের করেছি। চিৎকার দিতে দিতে অনেকেই আমার সামনে মৃত্যুবরণ করেন। এখনও আমি ঘুমের মাঝে তাদের আর্তচিৎকার শুনতে পাই।'

'সে সময় আমি ওষুধ ও ব্লেড সরবারহ করেছি আহতদের। তারা নিজের দেহ নিজেই কেটেছে শুধু বেঁচে থাকার জন্য। এ দৃশ্য ভুলবার নয়।'

উদ্ধার কাজ চলাকালীন সময়েই অসুস্থ হয়ে পড়েন মসিউর। টানা ২৬ দিন ভর্তি ছিলেন হাসপাতালে। এবিষয়ে তিনি বলেন, 'আমি এই ভয়াবহতা দেখে অসুস্থ হয়ে পড়ি৷ হাসপাতালে থেকে বাড়ি ফিরেও টানা তিনমাস ট্রমায় ছিলাম। তবে, সেসময়ও আমার প্রতিষ্ঠান আমাকে বেতন ও ভাতা প্রদান করেছে।'

'কিন্তু রাষ্ট্র আমাদের কোনো খোঁজ নেয়নি৷ আমরা যারা সেসময় জীবন বাজি রেখে উদ্ধার কাজ করেছি, তাদেরকে অন্তত সামাজিকভাবে সম্মানিত করা যেত, কাউন্সিলিং করা যেত৷' রাষ্ট্র থেকে এমন কোনো ব্যবস্থাই নেওয়া হয়নি বলে দাবি তার।

সেসময় উদ্ধারকাজ বা আহতদের চিকিৎসায় যারা এগিয়ে এসেছিলেন, তারা প্রায় সবাই মনে করেন মানবতার সেবায় এগিয়ে আসা ব্যক্তিরা সম্পূর্ণভাবেই উপেক্ষিত হয়েছে। তাদের মানসিক স্বাস্থ্য উন্নয়ন বিষয়ক কোন ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। হিমু ও মসিউরের মত আরও অনেক যুবক এই ভয়াবহ অভিজ্ঞতার শিকার হলেও মানসিকভাবে তাদের পাশেও দাঁড়ানোর কেউ ছিলনা।

জনস্বাস্থ্যবিদ লেলিন চৌধুরী বলেন, সে সময় যারা মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছিল, ফিরে এসে তারা মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে। পরবর্তী পরিস্থিতিতে তাদের দুঃস্বপ্ন দেখতে শুরু করে, তাদের ঘুম কমে যায়। তারা মানুষ থেকে পালিয়ে বেড়াতে থাকে। তাদের মধ্যে অবচেতন ভয় কাজ করতে থাকে। ফলে তাদের স্বাভাবিক জীবনযাপন ব্যাহত হয় এবং ব্যক্তিত্বের অবনমন ঘটে। তাদের সামাজিক দায়বদ্ধতা কমে যায়, দ্বিধায় ভোগে। এর থেকেই হঠাৎ রেগে যাওয়া ও আত্মহত্যার প্রবণতা দেখা দেয়।'

তিনি মনে করেন, রাষ্ট্রের উচিত ছিল ঐ সময়ই সেচ্ছাসেবীদের গ্রুপ কাউন্সিলিং কিংবা ইনডিভিজুয়াল কাউন্সিলিং করা। এ কাউন্সিলিং না হওয়ায় এখনও যে সকল সেচ্ছাসেবীরা বেঁচে আছেন তাদের বেশিরভাগই ট্রমায় আক্রান্ত।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ