রানা প্লাজা ট্র্যাজেডি
অভাবে ‘আত্মহত্যা’ করতে চান রানা প্লাজার আহতরা
নিলুফা বেগম, একটা সময় সচল পায়ের বিচরণ ছিল সবখানে। সিঁড়ি বেয়ে ভবনের পঞ্চম তলায় নিজ কর্মস্থল যেতেন তিনি। হাতের স্পর্শে মেশিনের চাকা ঘুরিয়ে এনেছেন বৈদেশিক মুদ্রা। স্বচ্ছল করেছেন পরিবারকে।সংসারের প্রতিটি ব্যয় বহন করেছেন তিনি। খরচ করেছেন পরিবারের জন্য। এক যুগ আগের রানা প্লাজা ধসে পোশাক শ্রমিক নিলুফা বেগমের জীবনের সব হিসেব পাল্টে যায়। হারিয়েছেন চলার শক্তি, খুঁইয়েছেন কর্মও। এতে কমেছে সংসারে তার ভূমিকা। স্থায়ীভাবে পঙ্গু ও কর্মহীন হওয়ায় তাকে ছেড়ে চলে গেছেন স্বামী-সন্তানও।
তারপরও প্রায়ই নিলুফাকে দেখা যায় পরিত্যক্ত রানা প্লাজার জায়গাটির আশেপাশে। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে একবার হলেও পরখ করে যান সাবেক কর্মস্থল ও জীবন পাল্টে দেয়ার সেই স্থানটিকে। চোখের নোনা জলে আক্ষেপ করে বলেন, কেন বেচে ফিরেছেন তিনি?
এক যুগ পার হতে চলেছে ইতিহাসের ভয়াবহ রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির। নিহত এক হাজার ১৩৬ জনকে হারানোর বেদনা আজও বয়ে বেড়াচ্ছেন কারো বাবা-মা, কারো ভাই-বোন, কারো স্ত্রী-সন্তান অথবা কারো স্বামী। আহত এক হাজার ৫২৪ জনের অধিকাংশই চিরতরে নিঃস্ব হয়ে দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। অনেকেই শারীরিক প্রতিবন্ধিতাকে সঙ্গী করে চালাচ্ছেন জীবনযুদ্ধ। সেদিন বেচে ফিরলেও কর্মহীন হয়ে বয়ে নিয়ে চলছেন অভাব-অনটনের বোঝা। ভেঙে পড়েছে সংসার আর জীবনচক্র।
শ্রমিক ও বিভিন্ন সংগঠনের তথ্য অনুসারে, ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের পাশে সাভারের নয়তলা ভবন রানা প্লাজার তিনতলা থেকে নয়তলা পর্যন্ত ছিল পাঁচটি পোশাক কারখানা। ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল ভবনটি ধসের সময়ও কর্মরত ছিলেন চার হাজারেরও বেশি পোশাকশ্রমিক। তাদের মধ্যে দুই হাজার ৪৩৮ জন উদ্ধার হলেও এখনও নিখোঁজ ১৮২ জন, যাদের ১৪৬ জনেরই ডিএনএ ও কবর খুঁজে পাওয়া যায়নি৷ বাকি ৩৬ জনের ডিএনএ শনাক্ত হলেও তাদের যোগাযোগের ঠিকানা ও ফোন নম্বরে গরমিল থাকায় পরিচয় জানা যায়নি।
নিগত ও নিখোঁজদের পরিবার ও আহত শ্রমিকদের অভিযোগ, দীর্ঘ একযুগেও সরকার বা মালিকপক্ষ থেকে মেলেনি যথাযথ ক্ষতিপূরণ, হয়নি পুনর্বাসন। ক্ষতিপূরণের দাবিতে দ্বারে দ্বারে ঘুরে এখন তারা নিঃস্ব। আহত ও পঙ্গু অনেক নারী পোশাক শ্রমিককে ছেড়ে গেছেন স্বামী-সন্তান। অনেকে আবার কর্মহীন হয়ে অভাব সইতে না পেরে দাবি জানাচ্ছেন, ‘আত্মহত্যার অনুমতি’।
এই নৃশংস মৃত্যুর ঘটনায় করা হত্যা মামলার বিচার এখনও শেষ হয়নি।
সিনিয়র সুইং অপারেটর নীলুফা বেগম কাজ করতেন পঞ্চম তলার ফ্যানটম ট্যাক লিমিটেডে। ধসে পড়া ভবনের চাপায় হারিয়েছেন একটি পা। অন্য পায়েও পোকা ধরেছে, অর্থাভাবে অপারেশন করতে পারছেন না।
ভিউজ বাংলাদেশকে নিলুফা বলেন, ‘একটা পা নিয়ে চলতেই পারছি না। নিজের শেষ সম্বল ছোট টং দোকানের মালামাল না কিনে ডাক্তার দেখাইছি। দোকানটাও বন্ধ। এখন যে অপারেশন করতে বলছেন, কেমনে করবো?’
তিনি আরও বলেন, ‘স্বামী আরেকজনকে বিয়ে করে চলে গেছেন। একমাত্র ছেলেও অভাব সইতে না পেরে চলে গেছে। এখন আমি একা’।
নিলুফার অভিযোগ, ‘অপারেশনের টাকা নাই। অনুদান পাইছি মাত্র তিন লাখ ৩০ হাজার টাকা। কিন্তু ক্ষতিপূরণ পাইনি। কবে পাবো, সেও জানি না। আজ পর্যন্ত বায়ার, মালিক কোনো খোঁজ নেননি’।
একই কারখানায় কাজ করতেন সুইং অপারেটর পারুল আক্তার। তিনি বলেন, ‘অনুদান পেয়েছি এক লাখেরও কম টাকা। সে টাকা তো, সেই তখনই শেষ হয়ে গেছে। এখনও কোনো কাজ করতে পারি না। স্বামীও অসুস্থ তার দশ হাজার টাকার বেতনে কী হয়? ছেলে-মেয়ের লেখাপড়া, সংসার চালাতে খুব কষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এখনও মানুষের কাছে টাকা নিয়ে চলতে হয়’।
কান্নাজড়িত কণ্ঠে পারুল আক্তার বলেন, ‘মাঝে মাঝে মনে হয়, মারা গেলে ভালো হতো। ছেলে-মেয়েকে কিছুই দিতে পারি না। আমি কোথাও চাকরি নিলেও সকালে গেলে দুপুরে বের করে দেয়। কাজ করতে না পারলে তারা রাখবে কেন? সরকারের কাছে দাবি, পাওনা ক্ষতিপূরণ চাই। আমাদের যেন দ্রুত পুনর্বাসন করা হয়’।
গত একযুগ ধরেই চার দফা দাবি জানিয়ে আসছে বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনগুলো। দাবিগুলো হলো, শ্রমিকের এক জীবনের আয়ের সমান ক্ষতিপূরণ, স্থায়ী পুনর্বাসন, বিনামূল্যে আজীবন চিকিৎসা ও রানা প্লাজার মালিকের দ্রুত বিচার।
বাংলাদেশ গার্মেন্টস ও সোয়েটার্স শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের আইন সম্পাদক খায়রুল মামুন মিন্টু বলেন, ‘আহতদের অবস্থা একযুগে আরও খারাপ হয়েছে। এমনও শ্রমিক আছেন, যারা দিনে একবেলা খেয়ে কোনোমতে বেচে আছেন। এমনকি রানা প্লাজার শ্রমিক ছিলেন, শুনলে কোনো কারখানাই তাদের কাজে নিতে চায় না। বের করে দেয়’।
তিনি আরও বলেন, ‘যে পরিমাণ অর্থ এসেছে, তার সবটাই ছিল অনুদান। কিন্তু মালিকপক্ষ ও রাষ্ট্রের কাছে যে ক্ষতিপূরণ চাওয়া হয়েছে, সেগুলো এখনো আলোর মুখ দেখেনি। সরকারের ফান্ডে এখনও একশত কোটি টাকা আছে। সব শ্রমিকদের টাকা। তারা এখন পর্যন্ত সেটি পায়নি’।
খায়রুল মামুন মিন্টু বলেন, ‘আমরা বলেছিলাম, আইএলও কনভেনশন অনুসারে রানা প্লাজার শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ দিতে। তারা সারা জীবনে যে আয় করবেন, সেটা আইএলও। এছাড়া ২০২২ সালে পোশাক কারখানার জন্য পেনশন চালু হয়েছে, যেটি ইআইএস প্রকল্প নামে পরিচিত। এই প্রকল্পের কাজ হচ্ছে, কোনো কারখানায় শ্রমিকরা আহত হলে তারা যতোদিন অসুস্থ থাকবেন, তাদের জন্য এই পেনশন চালু থাকবে। রানা প্লাজার এই শ্রমিকদের সেই প্রকল্পের আওতায় আনা হয়নি। যা খুবই দুঃখজনক’।
অ্যাকশনএইড বাংলাদেশের জরিপে বলা হয়, দুর্ঘটনার শিকার শ্রমিকদের ৫১ শতাংশই ২০১৯ সালেও বেকার ছিলেন। ২০২০ সালে করোনাকালে সেটি বেড়ে দাঁড়ায় ৫৭ শতাংশ, যা আগের ছয় বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। আহত পোশাক শ্রমিকদের সাড়ে নয় শতাংশেরই কোনো আয় নেই। আর সাড়ে ১০ শতাংশের আয় পাঁচ হাজার ৩০০ টাকার নিচে।
জরিপের ফলাফলে আরও বলা হয়, রানা প্লাজা ধসে আহত শ্রমিকদের ৯২ শতাংশই করোনাকালে সরকারি কোনো সহায়তা পাননি। মাত্র আট শতাংশ শ্রমিক অল্প কিছু সহায়তা পান। এছাড়া ১৪ শতাংশ শ্রমিকের স্বাস্থ্যের অবনতি হয়েছে। সাড়ে ১২ শতাংশ শ্রমিক মানসিক ট্রমার মধ্যে আছেন। ২০১৯ সালেও এই হার ছিল সাড়ে ১০ শতাংশ। অর্থাৎ, দুই শতাংশ শ্রমিকের মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি হয়েছে।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে