রংপুর-৩
রানী সত্যিই মানুষের হৃদয় জয় করতে পারবেন!
আনোয়ারা ইসলাম রানী, নির্বাচনি প্রচারের কল্যাণে এখন সারা দেশের মানুষ এই নামটির সঙ্গে পরিচিত হয়ে উঠেছেন। সারা দেশের ভোটের মাঠে স্বতন্ত্র যে কজন প্রার্থী নিয়ে আলোচনা চলছে, রানীকে তাদের মধ্যে একজন নয়, বলতে হবে অন্যতম একজন। এই রানী চ্যালেঞ্জ করেছেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদেরকে। ইতোমধ্যে জাতীয় পার্টির নেতাকর্মীদের হামলার শিকার হয়েছেন রানী। এর অর্থ কি জাতীয় পার্টি ভয় পাচ্ছে রানীকে!
রংপুর সদর উপজেলা নিয়ে গঠিত রংপুর-৩ আসন। এই আসনটি জাতীয় পার্টির দুর্গ হিসেবে পরিচিত। ১৯৯১ থেকে সব জাতীয় নির্বাচনে এই আসনটিতে জাতীয় পার্টি বিজয়ী হয়েছে। বিশেষ করে ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১ এবং ২০০৮-এ ভোটের যে চিত্র, তাতেও দেখা যায় এখানে মোটামুটি সব ভোটারই জাতীয় পার্টিকে ভোট দিয়েছে। নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন ২০০৮-এ আসনটিতে জাতীয় পার্টির প্রার্থী ছিলেন এইচ এম এরশাদ।
তিনি ওই নির্বাচনে ২ লাখ ৩৯ হাজার ৪৬ ভোট পেয়েছিলেন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ১৯ হাজার ৬৪০ ভোট পেয়েছিলেন। অর্থাৎ জাতীয় পার্টি এবং বিএনপির মধ্যে ভোটের পার্থক্য ২ লাখ ১৯ হাজার ৪০৬ ভোট। অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচন ২০০১-এ জি এম কাদের এই আসনে জাতীয় পার্টির প্রার্থী ছিলেন, তখন তিনি এক লাখ ৩০ হাজার ৫৬২ ভোট পেয়েছিলেন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগ প্রার্থী ভোট পেয়েছিলেন ৫৩ হাজার ৭৪৮টি। সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচন ১৯৯৬ সালে এইচ এম এরশাদ আসনটিতে ১ লাখ ৫ হাজার ৫৯০ ভোট পেয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগ প্রার্থী সিদ্দিক হোসেন ২৮ হাজার ৫০৩ ভোট পেয়েছিলেন। এমনকি ১৯৯০ সালে স্বৈরাচার এরশাদ পতনের পরও ১৯৯১ এর ৫ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টি থেকে এইচ এম এরশাদ এই আসনে ৮৬ হাজার ১১৪ ভোট পেয়েছিলেন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী মো. আফজাল গণতন্ত্রী পার্টি থেকে ২৭ হাজার ৯৩৮ ভোট পেয়েছিলেন। যখন সারা দেশের এরশাদ বিরোধিতা, তখনো এই আসনটিতে আওয়ামী লীগ জোট করেও ভোটের মাঠে সুবিধা করতে পারেনি।
আপাতদৃষ্টিতে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনগুলোতে রংপুরে জাতীয় পার্টির বিরুদ্ধে কোনো দল কখনোই সুবিধা করতে পারেনি। সেখানে একজন তৃতীয় লিঙ্গের প্রার্থী রানী সারা দেশের মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করছেন এটি কিছুটা অবাক হওয়ার মতোই কথা। ভোটের মাঠে তো নয়, রানী রাজনীতির এই জটিল হিসাবের মাঠেও নতুন। তার একমাত্র ভরসা মানুষের ভালোবাসা। সেই ভালোবাসা পাওয়ার ক্ষেত্রে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ খানিকটা নয়, অনেকটা পিছিয়ে। শুরু হয় পারিবারিক বঞ্চনা দিয়ে। যখন পরিবার বুঝতে পারে সে পরিবারের অন্যদের মতো নয়, কিছুটা আলাদা, তখন থেকেই তাকে আলাদা করে দেয়া হয়। এরপর সমাজ-সংসার ধীরে ধীরে তার জন্য কঠিন হতে শুরু করে।
এমন কি মৃত্যুর পরও একজন রানী পড়ে থাকে একজন মানুষ নয়, হিজড়ার লাশ হয়ে! কেউ তার জন্য কাঁদে না। কোথায় তার কবর হবে? কে তাকে জানাজা করাবেন? সেই অনিশ্চয়তায় মনে হয় তার মৃত্যুটিও তার জন্য একটি পাপ। এই হচ্ছে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের প্রতি বেশিরভাগ মানুষের স্বাভাবিক দৃষ্টিভঙ্গি; কিন্তু গত কয়েক বছরে এর পরিবর্তন ঘটেছে।
দুটি ঘটনার কথাতো নিশ্চয় অনেকের মনে আছে ২০১৯ সালে ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুরে মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান হয়েছেন তৃতীয় লিঙ্গের পিংকি খাতুন। এই ঝিনাইদহের কালীগঞ্জের ছয় নম্বর ত্রিলোচনপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান পদে নির্বাচিত হন তৃতীয় লিঙ্গের নজরুল ইসলাম ঋতু। দেশের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে এই প্রথম কোনো তৃতীয় লিঙ্গের প্রার্থী চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। অর্থাৎ মানুষের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হতে শুরু করেছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে জাতীয় পার্টির দুর্গে সাধারণ মানুষের দৃষ্টিভঙ্গির এই পরিবর্তন হবে কি না?
গেল কয়েক দিনজুড়ে ভোটের মাঠে যে প্রচার-প্রচারণা, সেই চলনে-বলনে রাজনীতিতে রানীকে একেবারেই নতুন মনে হচ্ছে না। রানী কথা বলছেন তিস্তা চুক্তি নিয়ে। রংপুরের কৃষক আর কৃষির জন্য তিস্তা চুক্তি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। রানী বলেছেন ভোটে জিতলে তিনি তিস্তা চুক্তি করার জন্য সাধারণ মানুষকে নিয়ে আন্দোলন গড়ে তুলবেন। এখনো এই দাবিতে স্থানীয়ভাবে কোনো রাজনৈতিক নেতাকে সোচ্চার হতে তো দূরের কথা, কথা বলতেও শোনা যায়নি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে রানীর আরও কিছু বক্তব্য পাওয়া যাচ্ছে, সেখানে রানী একেবারে তৃণমূলে থাকা মানুষের জীবন-মান উন্নয়নে কাজ করে যাওয়ার কথা বলছেন।
রানী নির্বাচিত হবেন কি হবেন না, সেটি ভোটের রায়ই বলে দেবে; কিন্তু নির্বাচিত হলে বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ইতিহাসে এই বিজয়ের গল্প অন্যভাবে লিখতে হবে। নির্বাচিত হওয়ার পর রানী যদি তার কথা রাখেন, তাহলে সংসদে তৃণমূলের মানুষর কণ্ঠস্বর হয়ে উঠতে পারেন তিনি। আপনাদের নিশ্চই মনে আছে বঙ্গবাজারে অগ্নিকাণ্ডের কথা। সেখানে বাংলাদেশ হিজড়া উন্নয়ন সংস্থার সভাপতি কাশ্মীরি দিপালী বলেছিলেন, ঈদের কেনাকাটার ২০ লাখ টাকা আমরা ব্যবসায়ীদের হাতে তুলে দিলাম; কিন্তু আমরা যারা নিজেদের খুব স্বাভাবিক দাবি করি, তারা কজন আমরা সেই সংকটে ব্যবসায়ীদের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম? সেই প্রশ্ন করা যেতেই পারে।
পৃথিবীতে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ অনেক বড় বড় কাজ করে দেখিয়েছেন। আনোয়ারা ইসলাম রানী হয়তো রাতারাতি অনেক বড় কাজ করতে পারবেন না। কিন্তু রাজনীতিতে লেগে থাকা বলে একটি কথা আছে। মানুষের কাছে পৌঁছাতে হলে বা হৃদয়ের গভীরে পৌঁছাতে হলে সব সময় তার কাছেই থাকতে হয়। এই নির্বাচনের ফলাফল যাই হোক, তিনি যদি লেগে থাকেন মানুষের হৃদয় ঠিকই একদিন স্পর্শ করতে পারবেন। মানুষের ভালোবাসার সামনে লিঙ্গ ভেদাভেদ যেমন কিছু নয়, তেমনি তৃতীয় লিঙ্গও কোনো বিষয় হবে না।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে