Views Bangladesh

Views Bangladesh Logo

যে কারণে ফ্রান্সে উগ্র ডানপন্থিদের শক্তি বেড়ে যাচ্ছে

Rayhan Ahmed Tapader

রায়হান আহমেদ তপাদার

বুধবার, ২৪ জুলাই ২০২৪

ক্ষণশীল অনুগত বনাম মধ্যপন্থি বিদ্রোহী পার্লামেন্ট নির্বাচনের আগে-পরে দুই সময়ই নিজ নেতৃত্ব নিয়ে নজিরবিহীন প্রশ্নের মুখে পড়েছেন প্রেসিডেন্ট মাখোঁ। নির্বাচনে দলের জয় নিয়ে শঙ্কায় থাকা প্রার্থীরা প্রকাশ্যেই তাকে এড়িয়ে চলেছেন। অন্যদিকে সরকারে থাকা প্রধানমন্ত্রী আতালের মতো প্রভাবশালী নেতারা মাখোঁর আগাম নির্বাচন আহ্বানের সিদ্ধান্ত থেকে নিজেদের সরিয়ে রাখেন। বামপন্থি দলগুলোর জোট নিউ পপুলার ফ্রন্ট (এনএফপি) ফ্রান্সের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সবচেয়ে বেশি আসনে জয়ী হয়েছে। উগ্র ডানপন্থি দল ন্যাশনাল র‍্যালির (আরএস) ভূমিধস বিজয় তারা ঠেকিয়ে দিতে পেরেছে। সোশ্যালিস্ট, গ্রিনস, কমিউনিস্টস ও জ্যঁ লুক মেলেনচনের ফ্রান্স আনবোড দলের মধ্যে অতীতে গভীর বিভক্তি ছিল। সেই বিভক্তি মিটিয়ে একটি জোট করা খুব একটা সহজ ছিল না। এ পরিপ্রেক্ষিতে বামপন্থি জোটটির বিজয় ছিল যুগান্তকারী ঘটনা।

গত মাসে এনএফপি জোট গঠনের পর থেকে তারা মধ্যপন্থি অভিজাত ও উগ্র ডান এই দুই শিবিরের ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েছিল। দুপক্ষই বামপন্থিদের জোটকে ফ্রান্স প্রজাতন্ত্রের জন্য ভবিষ্যৎ বিপদ বলে আক্রমণ শানিয়েছিল। গণমাধ্যমের পরিবেশও ছিল এনএফপির জন্য চূড়ান্ত রকম বৈরী। ফ্রান্সের সংবাদ মাধ্যমে খুব অসম্মানজনকভাবে বলতে চেয়েছে অতি ডান ও অতি বাম দুই শিবিরই রাজনৈতিকভাবে খুব কাছাকাছি। মেরি লো পেন এবং ন্যাশনাল র‍্যালি পার্টির প্রেসিডেন্ট জরদান বারদেলা গত মাসের নির্বাচনি প্রচারণায় তাদের দলকে নতুন মধ্যডানপন্থি দল হিসেবে উপস্থাপন করার চেষ্টা করেছেন। তারা এনএফপিকে প্রকৃত চরমপন্থি হিসেবে চিত্রিত করতে চেয়েছেন। বামপন্থি জোটকে বিশেষ করে জ্যঁ লুক মেলেনচনকে ফিলিস্তিনের প্রতি সমর্থন জানানোর কারণে তারা অ্যান্টিসেমেটিক তকমা দেন তারা।

অথচ ন্যাশনাল র‍্যালি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, এমন একজন দাগি অপরাধীর হাত ধরে, যিনি ছিলেন হলোকাস্ট অস্বীকারকারী। আরএনের বর্ণবাদী ঐতিহ্যকে চুনকাম করার এবং এনএফপিকে অ্যান্টিসেমেটিক হিসেবে তুলে ধরার কাজ এতটাই জোরালো ভাবে করা হয়েছে যে ৩০ জুন প্রথম দফা নির্বাচনের পর গণমাধ্যম বলতে শুরু করে বামপন্থিদের বিজয় হলে, সেটা ফ্রান্সের জন্য ক্ষতিকর হবে; বামপন্থিরা আসার চেয়ে উগ্র ডানপন্থি কারও আসা ভালো। মধ্যপন্থি প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বেশ কিছু ডানঘেঁষা কর্তৃত্ববাদী নীতি গ্রহণ করার মাধ্যমে মধ্যপন্থা ও ডানপন্থার মধ্যকার ভেদ রেখাটা হাপিশ করে দিয়েছিলেন। ফলে মূলধারার দল হিসেবে পার্লামেন্টে ন্যাশনাল র‍্যালির পুনর্বাসনের শর্ত প্রস্তুত হয়ে গিয়েছিল। মনে হতে শুরু হয়েছিল, ডানপন্থি দলটি অবশেষে ফ্রান্সের পার্লামেন্টের নিয়ন্ত্রণ নিতে চলেছে।

জরিপে আরএনের পরিষ্কার বিজয়ের পূর্বাভাস সত্ত্বেও ফ্রান্সের ভোটাররা গেল নির্বাচনে লো পেনের কট্টর ডানপন্থি আরএনকে প্রত্যাখ্যান করেন। এনএফপি জোট ১৮২টি আসন পেয়ে প্রথম হয়। মাখোঁর মধ্যপন্থি ও নয়া উদারবাদীদের জোট ১৬৩টি পেয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে। লো পেন ও বরদেলার আরএন মাত্র ১৪৩টি আসন পেয়েছে। তাদের সামনে সরকার গঠনের কোনো বাস্তব পথ নেই। মেলেনচন ও তার নতুন মিত্ররা ফ্রান্সজুড়ে যে বিজয় পেয়েছে, সেটা নিঃসন্দেহে স্মরণীয় বিজয়। তারা দেখিয়েছেন যে বামেদের এবং অর্থপূর্ণ সংস্কার ও সামাজিক ন্যায্যতা প্রশ্নে তাদের নাছোড় দাবির বিজয় হয়েছে। তারা দেখিয়েছেন, মধ্যপন্থিদের নীতির কারণে শেষ পর্যন্ত উগ্র ডানপন্থিদের যে উত্থান তৈরি করেছিল, তার প্রতিষেধক হিসেবে কাজ করেছে বামপন্থিদের এজেন্ডা। কেননা আরএন পার্লামেন্টে ১৪৩-টি আসন নিশ্চিত করেছে। বাম জোট যতটা আসন পেয়েছে, তা দিয়ে নিজেরা একা সরকার গঠন করতে পারবে না।

এর মানে হচ্ছে, নিকট ভবিষ্যতে ফ্রান্সে রাজনৈতিক অস্থিরতা শুরু হতে যাচ্ছে। আরএন পার্লামেন্টে নিশ্চিত ভাবে শক্তিশালী কণ্ঠস্বর হিসেবে থাকবে। এটা বিশ্বাস করার সব কটি কারণ আছে যে ভবিষ্যতের নির্বাচনগুলোয় আরএন আরও শক্তি নিয়ে লড়াই করবে। এসব সত্ত্বেও বাম জোট এখন একটি গুরুত্বপূর্ণ ও হারানো সুযোগের সামনে দাঁড়িয়ে। ফ্রান্সের ভোটাররা এটা স্পষ্ট করেছেন যে তারা মাখোঁর মধ্যপন্থা ও মতাদর্শগত অস্পষ্ট শাসনে ক্লান্ত। অর্থনীতিকে ঠিক পথে আনতে মাখোঁও ব্যর্থ হয়েছেন। তার কর্তৃত্ববাদী নীতি উগ্র ডানপন্থাকে স্বাভাবিক একটা বিষয়ে পরিণত করেছে। তার ফলে ফ্রান্সের অনেক ভোটার আরএনের দিকে ঝুঁকে পড়ে। এখন ভোটাররা আরএনকেও প্রত্যাখ্যান করেছে। ফলে বাম জোটের সামনে তাদের এজেন্ডা বাস্তবায়নের বাস্তব একটা সুযোগ এসেছে। সামাজিক ন্যায়বিচারের ওপর ভিত্তি করে নতুন একটা ফ্রান্সের পথ তৈরির সুযোগ তাদের সামনে এসেছে। পরিবেশের যত্ন এবং ফ্রান্সের জনগণের মূল্যবোধ ও দৃষ্টিভঙ্গি লালন করে এমন একটা পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়নের সুযোগ তাদের সামনে এসেছে।

এনএফপি জোট যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, তার মধ্যে ন্যূনতম মজুরি বৃদ্ধি, অবসরের সময় ৬৪ বছর থেকে কমিয়ে ৬০ করা, ৫ বছরের মধ্যে সাশ্রয়ী মূল্যে ১০ লাখ গৃহনির্মাণ এবং খাদ্য, জ্বালানি ও গ্যাসের মতো নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম স্থিতিশীল রাখা। জোটটি প্রতিশ্রুতি দিয়েছে শিশুদের সব শিক্ষাব্যয় রাষ্ট্র নির্বাহ করবে। আর এ ব্যয়ভার নির্বাহ করা হবে ধনীদের ওপর আরও কর বসিয়ে। এসব উচ্চাভিলাষী অ্যাজেন্ডার বাস্তবায়ন ফ্রান্সের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় ভারসাম্য পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে পারে। তারা অতি ডানপন্থিদের বিরুদ্ধে সত্যি সত্যি পাল্টা শক্তি হিসেবে আবিভূর্ত হতে পারে। তারা এমন একটা দেশে বামপন্থি ভবিষ্যৎ নির্মাণের পথ দেখাতে পারে যে দেশটিকে খুব জরুরিভাবে মাখোঁর নয়া উদারপন্থা থেকে বেরিয়ে আসা দরকার।

আতাল এ বছরের শুরুতে নিয়োগ পান এবং দলের প্রচারে হাড়ভাঙা পরিশ্রম করেন। প্রার্থীদের পক্ষে সমর্থন আদায়ে সফর করেন অনেকগুলো। মাখোঁ শিবিরের আত্মপক্ষ সমর্থনে মুখোমুখি হন গণমাধ্যমের। কিন্তু পার্লামেন্ট ভেঙে দেয়া নিয়ে নির্বাচনের রাতে মাখোঁর অপ্রত্যাশিত সিদ্ধান্তের প্রকাশ্য বিরোধিতা করেন আতাল।তিনি বলেন, পার্লামেন্ট ভেঙে দেয়ার সিদ্ধান্ত আমার পছন্দ হয়নি; কিন্তু আমি চুপ থাকতে অস্বীকৃতি জানিয়েছি সরকার প্রধান আতালের এমন লড়াকু মনোভাব তাকে দলের অন্য প্রতিবাদী আইনপ্রণেতাদের মধ্যে জনপ্রিয় করে তোলে। এনএফপি জোটভুক্ত দলের মধ্যে আছে ফ্রেঞ্চ কমিউনিস্ট পার্টি, ফ্রান্স আনবোড, গ্রিনস ও সোশ্যালিস্ট পার্টি। সামনের কাজগুলো কী হবে, তা নিয়ে দলগুলোর নেতারা প্রথম দফার আলোচনা সেরেছেন। ফ্রান্স আনবোড দলের নেতা জ্যঁ-লিখ মিলোশো বলেছেন, এনএফপি জোট থেকেই নতুন প্রধানমন্ত্রী বাছাই করা উচিত। তবে জোটটির কোনো নেতা নেই। যোগ্য প্রধানমন্ত্রী হিসেবে কাকে বেছে নেয়া যেতে পারে, তা নিয়ে জোটের দলগুলোর মধ্যে মতভিন্নতা আছে।

ফ্রান্সের সাবেক প্রধানমন্ত্রী এদুয়ার্দ ফিলিপসহ কয়েকজন মধ্যপন্থি নেতা বলেছেন, স্থিতিশীল সরকার গড়ে তুলতে একটি চুক্তির ব্যাপারে কাজ করার জন্য তারা প্রস্তুত আছেন। ফ্রান্সের বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী গ্যাব্রিয়েল আতাল বলেছেন, তিনি তার পদত্যাগপত্র জমা দেবেন। তবে নতুন সরকার গঠন-সংক্রান্ত বিভিন্ন কাজের কথা মাথায় রেখে প্রেসিডেন্ট মাখোঁ তা এখনই গ্রহণ করবেন কি না, নিশ্চিত নয়। অবশ্য গ্যাব্রিয়েল আতাল বলেছেন যে তিনি তত্ত্বাবধায়কের ভূমিকায় থাকবেন। আতাল আরও বলেন, যতক্ষণ প্রয়োজন, আমি অবশ্যই আমার দায়িত্ব পালন করে যাব। এটি এড়ানোর সুযোগ নেই। কারণ, অলিম্পিক আসরের সময় ঘনিয়ে এসেছে আর তা আমাদের দেশের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ।

নির্বাচন-পরবর্তী জোট গড়ে সরকার গঠনের ব্যাপারে সমঝোতা না হলেও ফ্রান্সের সংবিধান অনুসারে ১২ মাসের মধ্যে মাখোঁ নতুন পার্লামেন্ট নির্বাচনের আয়োজন করতে পারবেন না। সংবিধানে বলা আছে, কাকে সরকার গঠন করতে বলা হবে, সে সিদ্ধান্ত নেবেন প্রেসিডেন্ট তথা মাখোঁ। তবে তিনি যাঁকেই বেছে নেন না কেন, তাকে জাতীয় পরিষদে আস্থা ভোটের মুখোমুখি হতে হবে। ১৮ জুলাই এ ভোটাভুটি হতে পারে। এর মানে হলো, মাখোঁকে এমন কোনো নাম প্রস্তাব করতে হবে, যেটি বেশির ভাগ আইনপ্রণেতার কাছে গ্রহণযোগ্য হবে। মাখোঁ চাইবেন, বামপন্থি জোট থেকে সোশ্যালিস্ট ও গ্রিনসরা ঝরে যাক। এতে একা হয়ে পড়া ফ্রান্স আনবোডের সঙ্গে মিলে মধ্য-বামপন্থি জোট গঠন করবেন। যদিও এখন পর্যন্ত নিউ পপুলার ফ্রন্টের মধ্যে ভাঙনের কোনো লক্ষণ দেখা যায়নি। তবে বামপন্থি সমর্থকদের ব্যাপক বিজয়োল্লাস করতে দেখা গেছে। উদযাপনে শামিল হয়েছিলেন ২৩ বছর বয়সী ডিজাইনার ব্যাপতিস্তে ফোরাস্তি। তিনি বলেন, আমরা এমনটা আশা করিনি। কোনো জনমত জরিপই এমন আভাস দিতে পারেনি। আমরা আনন্দিত যে ফরাসি জনগণ আরও একবার উগ্র ডানপন্থিদের আটকে দিতে সফল হয়েছে। তবে ফোরাস্তির মধ্যে কিছুটা উৎকণ্ঠাও দেখা গেল। তার আশঙ্কা, উগ্র ডানপন্থিদের শক্তি আরও বেড়ে যেতে পারে এবং তারা পরেরবার জিতে যেতে পারে।

ফোরাস্তি বলেন, ঝুলন্ত পার্লামেন্টে কাজ করাটা কঠিন হবে। কিন্তু উগ্র ডানপন্থিদের এগিয়ে থাকার তুলনায় তো অন্তত ভালো কিছু হলো। ফ্রান্সের পার্লামেন্ট নির্বাচনে বামপন্থি জোট নিউ পপুলার ফ্রন্ট (এনএফপি) জয়ী হলেও তারা প্রয়োজনীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। এমন অবস্থায় সরকার গঠনের ক্ষেত্রে এনএফপির সামনে দুটি পথ খোলা আছে। এনএফপিকে হয় কমসংখ্যক আসন নিয়েই সংখ্যালঘু সরকার হিসেবে কাজ করতে হবে। এতে ঝুলন্ত পার্লামেন্ট হবে এবং কোনো আইন পাস করাতে অন্য পক্ষের সমর্থনের ওপর নির্ভর করতে হবে। আর কমসংখ্যক আসন নিয়ে সরকার গঠন করতে না চাইলে অন্য কাউকে নিজেদের জোটের সঙ্গে যুক্ত করতে হবে। তবে ইউরোপের দেশ জার্মানি কিংবা নরওয়ের পার্লামেন্ট নির্বাচনের পর জোট করে সরকার গঠনের ঘটনা পরিচিত হলেও ফ্রান্সের ক্ষেত্রে এমনটা দেখা যায় না। সুতরাং বলাই যায়, ফ্রান্সের নতুন পথ তৈরির সুযোগ হয়তো এসে গেছে।

রায়হান আহমেদ তপাদার: গবেষক ও কলাম লেখক

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ