Views Bangladesh Logo

রেবতী মোহন বর্মণ: স্কুলজীবন থেকে আজীবনের বিপ্লবী

রেবতী মোহন বর্মণ নামটি উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে একটি অমর বইয়ের কথা মনে পড়বে আমাদের, বইটির নাম ‘সমাজ ও সভ্যতার ক্রমবিকাশ।’ বইটির লেখক কমিউনিস্ট আন্দোলনের অন্যতম নির্মাতা, আজন্ম বিপ্লবী ও সমাজ সংস্কারক। বইটি আর লেখকের নামটি যেন অবিচ্ছেদ্য। যে বইটি ১৯৫২ সাল থেকে এ উপমহাদেশের বামপন্থি রাজনীতিবিদ ও কর্মীদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ও অত্যাবশ্যকীয়। ব্রিটিশ-ভারতের জেলে থাকাকালীন ব্রিটিশ সরকার রেবতী বর্মণের ওপর অমানবিক অত্যাচার-নির্যাতন করে। যে কারণে তিনি ঘাতক ব্যাধি কুষ্ঠ রোগে আক্রান্ত হন। ১৯৪৯ সালে নিজ জন্মভূমি ভৈরবে বসে কুষ্ঠ রোগে আক্রান্ত, পচন ধরা আঙুলে রশি দিয়ে হাতের সঙ্গে কলম বেঁধে রচনা করেন ‘সমাজ ও সভ্যতার ক্রমবিকাশ।’

১৯৫২ সালে প্রকাশিত এই গ্রন্থ মার্কসবাদ চর্চায় যেমন অপরিহার্য হয়ে উঠেছিল তেমনি সমাজ-ইতিহাস অধ্যয়নে নিবিষ্ট ছাত্রদের কাছেও এর চাহিদা কখনো কমেনি। এমন গ্রন্থ রচনা নিছক রাজনৈতিক কর্মীর তাগিদ থেকে সম্পন্ন হতে পারে না, সেইসঙ্গে চাই সমাজ বিশ্লেষকের গভীর দৃষ্টি, ইতিহাসের সমগ্র চেতনা। বলা হয়ে থাকে, রেবতী বর্মণ সেই বিরল গুণের অধিকারী ছিলেন বলে রাজনীতির অমন ক্ল্যাসিক্যাল বই উপহার দিতে পেরেছিলেন এবং একটি বইয়ের সূত্রেই তিনি অমর হয়ে উঠতে পারলেন। ১৯৫২ সালের ৬ মে মারা যান বাংলার রেবতী মোহন বর্মণ। জন্মেছিলেন ১৯০৩ সালে। বেঁচে ছিলেন মাত্র ৪৭ বছর।

মানুষের ইতিহাস মূলত শ্রেণি-সংগ্রাম আর শ্রমের ইতিহাস। শ্রেণি সংগ্রামের তত্ত্বই সমাজ বিবর্তনের মূলসূত্রে তত্ত্বে বিশ্বাসী, শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার আজীবন বিপ্লবী রেবতী মোহন বর্মণ কারাগারে বসে বিএ পরীক্ষা দিয়ে ইংরেজি সাহিত্যে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করেছিলেন। তার বাবা হরনাথ বর্মণ। তিনি ছিলেন একজন নামকরা আইনজীবী। ইংরেজদের প্রতি আনুগত্যের জন্য তিনি রায় উপাধি পেয়েছিলেন। অবিভক্ত বাংলার বৃহত্তর ময়মনসিংহের অন্তর্গত কিশোরগঞ্জের শিমুলকান্দি গ্রামের নামকরা পরিবার ছিল এই বর্মণ পরিবার। শিক্ষা-দীক্ষা আর অর্থ-সম্পদের এক ঐতিহ্যবাহী পরিবার।

রেবতী মোহন বর্মণের পড়াশোনার হাতেখড়ি পরিবারে বাবার কাছে। তারপর প্রাথমিক পড়াশোনা শেষে চুন্টা গ্রামের একটি স্কুলে তাকে ভর্তি করে দেয়া হয়। এখানে তিনি বেশিদিন পড়াশোনা করতে পারেননি। চুন্টা গ্রাম ছিল বর্তমান ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার সরাইল উপজেলায়। রেবতী মোহন ছিলেন পাঁচ ভাইয়ের মাঝে চতুর্থ। শিমুলকান্দি গ্রামে জন্ম নেয়া রেবতী বর্মণ পড়াশোনা করেছিলেন ঢাকার পগোজ স্কুল এবং কুমিল্লার গভর্নমেন্ট হাই স্কুলে। স্কুল ছাত্রাবস্থায় ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে অসহযোগ ও স্বদেশী আন্দোলনে যুক্ত হন।

অসহযোগ ও স্বদেশী আন্দোলনে যুক্ত থাকার কারণে ওই সময় অসংখ্য স্কুল ছাত্রের ওপর হুলিয়া জারি হয়। এই হুলিয়া থেকে রেবতী মোহন বাদ যাননি। হুলিয়ার কারণে তাকে কয়েকটি স্কুল পরিবর্তন করতে হয়েছিল। ১৯২২ সালে তিনি কিশোরগঞ্জ আজিমুদ্দিন হাই স্কুলে ভর্তি হন। তখন আজিমুদ্দিন হাই স্কুল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ছিল। এই স্কুল থেকে (কলকাতার অধীন সব স্কুলের সবাইকে অবাক করে দিয়ে বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা ও আসামের মধ্যে) তিনি প্রবেশিকা পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হন। তারপর রেবতী বর্মণ পড়াশোনার জন্য কলকাতায় যান। এখানে মূলত ছাত্র পড়িয়ে লেখাপড়ার খরচ চালাতেন।

যে মেসবাড়ি ছিল তার ও সতীর্থদের আশ্রয়, তা বিপ্লবীদের একরকম ঘাঁটি হয়ে উঠেছিল। তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে আই এ এবং সেন্ট পলস কলেজ থেকে বিএ পাস করেন। বিএ পরীক্ষায় কৃতিত্বের জন্য পেলেন জগত্তারিণী পদক এবং পদক বিক্রির অর্থ দিয়ে সহপাঠীদের নিয়ে প্রকাশ শুরু করলেন কিশোরদের মাসিক পত্রিকা ‘বেণু’। এই সহপাঠীদের মধ্যে ছিল জোড়াসাঁকো ঠাকুর পরিবারের দুই সদস্য শোভনলাল ও মোহনলাল গঙ্গোপাধ্যায়। তাদের সহযোগে বেণুর প্রথম সংখ্যায় পত্রস্থ হলো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আশীর্বাদের পরিচয়বহ রচনা, ‘মধ্যদিনে যবে গান/বন্ধ করে পাখি/হে রাখাল বেণু তব/বাজাও একাকী।’

রেবতী মোহন সঠিক অনুভব করেছিলেন বাংলাদেশে সাধারণ মানুষের আবেগে ও অন্তরে কমিউনিস্ট পার্টির প্রবেশ ও প্রেরণা সুনিশ্চিত করতে হলে বাংলা ভাষায় সহজ ও প্রাঞ্জলভাবে মার্কসীয় মতাদর্শের বিবরণ এবং প্রয়োগের কথা পৌঁছে দিতে হবে এবং সেই কাজে তিনি পূর্ণ সময়ের জন্য আত্মনিয়োগ করেন। ঢাকার ‘গণসাহিত্য চক্র’, কলকাতার ‘ন্যাশনাল বুক এজেন্সি’ এবং ‘বর্মণ পাবলিশিং হাউস’ তার ও অন্যান্য লেখকদের লেখা পুস্তিকাগুলো প্রকাশ করতে শুরু করে।

তার প্রথম বই ‘তরুণ-রুশ’সহ ১৮টি পুস্তিকার অধিকাংশই মার্কসবাদের তত্ত্ব ও প্রয়োগ সংক্রান্ত। ১১৮ পাতার ছোট বইখানিতে তিনি পর্বে পর্বে রাশিয়ায় বিপ্লব বিকাশের বিবরণ দিয়েছেন। জারতন্ত্রের রাশিয়ার স্বৈরশাসন থেকে শুরু করে বিপ্লবের পূর্বাভাস এবং বিপ্লব বিস্তার ও বিপ্লবোত্তর রাশিয়ার প্রশাসন, অর্থনীতি এবং পররাষ্ট্র নীতির বিশ্লেষণ ও মূল্যায়ন। গ্রন্থটি শতবর্ষ অতিক্রমী রুশ বিপ্লব সময়কালের একটি অতি মূল্যবান দলিল। তরুণ-রুশ বইটির প্রকাশক ছিলেন ‘বর্মণ পাবলিশিং হাউস’-এর ব্রজেন্দ্র বিহারি বর্মণ রায়। এটি ছাপা হয়েছিল ১৯৩ নম্বর কর্নওয়ালিশ স্ট্রিটের মহামায়া প্রেস থেকে, বইয়ের দাম ছিল এক টাকা। ‘তরুণ-রুশ’ ১৯২৯ সালে প্রথম প্রকাশ পায়, প্রায় শতবর্ষী একখানি মূল্যবান পুস্তক; কিন্তু বিষয়ের আকর্ষণে আজও নবীন।

রেবতী বর্মণের রাজনীতি শুরু স্কুলজীবন থেকেই। বিপ্লবী ত্রৈলোক্যনাথ মহারাজের জীবনাদর্শের প্রভাবে তিনি মার্কসীয় তত্ত্বে আকৃষ্ট হন। দেশমাতৃকার স্বাধীনতা ও মানুষের মুক্তির জন্য যুক্ত হন সশস্ত্র বিপ্লববাদী গ্রুপে। এ সময় তিনি ঢাকার শ্রী সংঘের সদস্য হন। এই শ্রী সংঘের সদস্য হিসেবে কলকাতা, বাঁকুড়া ও বীরভূমের বিভিন্ন অঞ্চলে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যান। ১৯৩০ সালের আগস্ট মাসে কলকাতার ডালহৌসি স্কয়ারে পুলিশ কমিশনার চার্লস টেগার্টের ওপর প্রকাশ্যে হামলা হয়েছিল। হামলার দিন বিকেলেই পুলিশ কুখ্যাত বঙ্গীয় ফৌজদারি দণ্ডবিধি (সংশোধিত) আইন, ১৯২৫-এর আওতায় রেবতী মোহন বর্মণ রায়কে আটক করে।

ওই বছরের ১ সেপ্টেম্বর তাকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে কারাগারে পাঠানো হয়। এরপর বিনা বিচারে ভারতের বিভিন্ন কারাগার ও বন্দি শিবিরে কেটে গেছে তার আটটি বছর। অবশেষে ১৯৩৮ সালের ২১ জুলাই তিনি নিঃশর্ত মুক্তি পান। ১৯৩৮ সালে তার পরিবারের পক্ষ থেকে এলাকার শিশুদের শিক্ষিত করে তোলার লক্ষ্যকে সামনে রেখে স্থাপন করা হয় একটি প্রাথমিক স্কুল। যা পরবর্তীতে শিমুলকান্দি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় হিসেবে পরিগণিত হয়। কুষ্ঠ আক্রান্ত রেবতী মোহন ভৈরবে আসার পর শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে ঘরের বেড়ার (পার্টিশনের) আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে রেখে অপর পাশ থেকে ছাত্র পড়াতেন।

তিনি মার্কসবাদের ওপর ব্যাপক পড়াশোনা করেছেন বিভিন্ন জেলখানায়। তবে দেউলী বন্দি শিবিরের দিনগুলোতে তিনি বেশি বই পড়েছেন। মুক্তিলাভের পর সশস্ত্র বিপ্লববাদের পথ বাদ দিয়ে তিনি সাম্যবাদের দর্শন গ্রহণ করেন। এরপর থেকে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছিলেন মার্কসবাদ-লেনিনবাদ প্রচারের কাজে। ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন শ্রমিক-কৃষক আন্দোলনে। কারামুক্তির পর ভারতের চব্বিশ পরগনার বেলঘরিয়ায় বসবাসকালে শ্রমিক আন্দোলন গড়ে তোলার কাজ শুরু করেন।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর পুলিশ তার ওপর হুলিয়া জারি করে। যে কারণে তাকে পশ্চিমবঙ্গ ছাড়তে হয়। চলে আসেন পৈতৃক শিমুলকান্দি গ্রামে। বেলঘরিয়ায় থাকাকালেই তার গায়ে কুষ্ঠরোগের লক্ষণ দেখা দেয়। ফলে তার পক্ষে দলীয় কাজ করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। ১৯৫১ সালে দেশত্যাগের আগ পর্যন্ত তিনি নিজ গ্রামের বাড়িতেই বসবাস করতেন। ১৯৪৭ সালে সাম্প্রদায়িক চেতনায় বিভক্ত ভারতবর্ষের পাকিস্তান অংশের বিপ্লবী রেবতী বর্মণের বিরুদ্ধে ধর্মান্ধ গোষ্ঠী এলাকাবাসীকে খেপিয়ে তোলে।

তার বিরুদ্ধে নেতিবাচক প্রচারণা শুরু হলে ১৯৫১ সালে তিনি তার প্রিয় জন্মভূমি ভৈরব ছেড়ে ভারতের আগরতলায় চলে যেতে বাধ্য হন। সেখানে ১৯৫২ সালের ৬ মে তিনি মারা যান। আজীবনের এ বিপ্লবীর তিরোধান দিবস আজ। তার স্মৃতি প্রতি অবারিত শ্রদ্ধা।

লেখক: সাংবাদিক

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ