Views Bangladesh

Views Bangladesh Logo

উষ্ণতার রেকর্ড কি ভয়াবহ বিপর্যয়ের আগমনী বার্তা?

Hira  Talukder

হিরা তালুকদার

শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪

মানব সৃষ্ট জলবায়ু পরিবর্তন ও এল নিনো আবহাওয়া প্রপঞ্চ বিশ্বের তাপমাত্রাকে ক্রমাগত বাড়িয়ে তুলছে। এল নিনো উষ্ণ করে তুলছে প্রশান্ত মহাসাগরের পূর্বাঞ্চলের উপরিভাগের পানিকে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের কোপার্নিকাস ক্লাইমেট চেঞ্জ সার্ভিস (সিথ্রিএস) জানিয়েছে, ১৮৫০ সালে রেকর্ড রাখা শুরু হওয়ার পর থেকে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাড়তে থাকে উষ্ণতা। এর কারণে ২০২৩ সাল ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে উষ্ণতম বছর। বছরটি শেষ হওয়ার পর ২০২৪ সালের প্রথম মাস জানুয়ারিও ছিল ইতিহাসের উষ্ণতম জানুয়ারি। যদিও বাংলাদেশের আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্যমতে, দেশের শীতলতম মাস জানুয়ারির গড় তাপমাত্রা মোটামুটি স্বাভাবিকই ছিল। তবে গত বছরের জুন থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশের তাপমাত্রা স্বাভাবিকের থেকে ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি ছিল। অন্যদিকে বিবিসি জানিয়েছে, ২০২৩ সালের জুন থেকে প্রত্যেক মাসই বিশ্বের উষ্ণতম মাস হিসেবে রেকর্ড করা হচ্ছে।

সিথ্রিএসের উপপরিচালক সামান্থা বার্জেস বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে বলেন, ‘রেকর্ডের উষ্ণতম জানুয়ারির পাশাপাশি ১২ মাস ধরে আমরা প্রাক-শিল্পযুগের সময়ের তুলনায় ১ দশমিক ৫ ডিগ্রী সেলসিয়াস বেশি তাপমাত্রার অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি থামানোর একমাত্র পথ হচ্ছে গ্রিনহাউজ গ্যাস নির্গমণ দ্রুত হ্রাস করা।’

মার্কিন বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, ২০২৪ সাল পূর্ববর্তী বছর থেকেও উষ্ণ হওয়ার খুব সম্ভাবনা রয়েছে।

সামান্থা বার্জেস আরও জানান, বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির সবচেয়ে বড় কারণ বায়ুমণ্ডলে কার্বন-ডাই অক্সাইড ও মিথেনসহ বিভিন্ন গ্রিনহাউস গ্যাসের উপস্থিতি বেড়ে যাওয়া। এসব গ্যাস মূলত সূর্য থেকে আসা তাপকে পৃথিবীর পরিবেশ ও বায়ুমন্ডলে আটকে রাখে।

সিথ্রিএস জানিয়েছে, ২০২৩ সালে বিশ্বজুড়ে রেকর্ড পরিমাণ কার্বন-ডাই অক্সাইড নিঃসরণ হয়েছে।

ইউরোপের প্রধান এই জলবায়ু গবেষণা কেন্দ্র আরও জানিয়েছে, শিল্প যুগ বা যন্ত্র সভ্যতার আগের বছরগুলোতে প্রতিদিন গড়ে যে তাপমাত্রা ছিল, তার তুলনায় ২০২৩ সালের প্রতিদিনের তাপমাত্রা ছিল ১ ডিগ্রি সেলসিয়াসেরও বেশি এবং গত নভেম্বর মাসে প্রথমবারের মতো তা ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসে পৌঁছায়। এ ছাড়াও ২০১৫ সালে প্যারিস চুক্তি স্বাক্ষরের পর ২০২৩ সালেই প্রথমবারের মতো গড় তাপমাত্রা বেড়েছে দশমিক ১৭ সেলসিয়াস। তবে ২০২৩ সালের তাপমাত্রা কেবলই একটি ব্যাতিক্রমী উষ্ণ বছর না কি বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে বড় কোনো বিপর্যয়ের আগমনী বার্তা-সে সম্পর্কে নিশ্চিত হতে আরও বিস্তৃত গবেষণা প্রয়োজন বলে জানিয়েছে সিথ্রিএস।

২০১৫ সালে প্যারিসে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল জাতিসংঘের বিভিন্ন সদস্যরাষ্ট্র। বৈশ্বিক তাপমাত্রা কোনোভাবেই ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি যেন না বাড়ে, সেজন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে ঐকমত্যে পৌঁছেছিল ‘প্যারিস চুক্তি’ নামে পরিচিত সেই চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী দেশগুলো। সেই লক্ষ্য থেকে বিশ্ব এখনও বিচ্যুত হয়নি। তবে সিথ্রিএসের মতে, ২০২৩ সাল যে পরিমাণ উষ্ণ ছিল, তাতে সামনের বছরগুলোতে এই লক্ষ্য ধরে লাখা খুবই চ্যালেঞ্জিং হবে। বৈশ্বিক উষ্ণতার লাগামহীন বৃদ্ধি বন্ধ করতে কার্বন-ডাই অক্সাইড নিঃসরণ কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণের বিকল্প নেই।

সংস্থাটির মনে করে, কার্বন-ডাই অক্সাইড নিঃসরণ নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন দেশ উদ্যোগ নিয়েছে এবং কাজও করছে। তবে বর্তমানে যে গতিতে এই কাজটি হচ্ছে, তাতে বৈশ্বিক উষ্ণতার লাগামহীন বৃদ্ধি কোনোভাবেই থামানো সম্ভব নয়। বিশ্বের জলবায়ুর ভারসাম্য যদি বজায় রাখতে হয়, সেক্ষেত্রে প্রতিটি দেশকে এ ব্যাপারে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে এবং কাজের ব্যাপ্তি বাড়াতে হবে। এক্ষেত্রে রাজনীতি ও আমাদের মানসিকতা উভয়েরই পরিবর্তন প্রয়োজন।

এদিকে বাংলাদেশের আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, এই দেশ নাতিশীতোষ্ণ তাপমাত্রার দেশ হিসেবে পরিচিত হলেও বিগত কয়েক বছরে তাপমাত্রার অস্বাভাবিক আচরণ সেই পরিচিতিকে ম্লান করে দিয়েছে। ১৯৬০ সালে বঙ্গীয় এলাকায় সর্বোচ্চ ৪২ দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা নথিভুক্ত করা হয়। স্বাধীনতার পরে বাংলাদেশে ১৯৭২ সালের ৩০ মে রাজশাহীতে তাপমাত্রা নথিভুক্ত করা হয় ৪৬ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ১৯৯৫ সালে এসে নথিভুক্ত করা হয় ৪৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ২০০৯ সালের ২৬ এপ্রিল যশোরে রেকর্ড করা হয় বিগত ১৪ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪২ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এই পরিসংখ্যানে আপাত দৃষ্টিতে যদিও মনে হচ্ছে তাপমাত্রা কমছে, তবে অতীতের সর্বোচ্চ গড় তাপমাত্রা ছিল কম। অথচ বর্তমানে সর্বোচ্চ গড় তাপমাত্রা অত্যধিক বেশি।

ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ডলাইফ ফান্ডের গবেষণায় দেখা যায়, শুধু ঢাকা শহরেই গড় তাপমাত্রা ১৯৭২ সাল থেকে ২০২৪ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত বেড়েছে ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস। গত ৫০ বছরে দেশের তাপমাত্রা বৃদ্ধির হার ০ দশমিক ৫ শতাংশ। আর ২০৫০ সাল নাগাদ বাংলাদেশের তাপমাত্রা গড়ে ১ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং ২১০০ খ্রিষ্টাব্দ নাগাদ ২ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়তে পারে। তাপমাত্রা বাড়ার ঘটনাটি অনেকটা সম্পূরক হারে ঘটবে। কেননা বাড়তি তাপমাত্রার কারণে পানির বাষ্পীভবন বেড়ে যাবে এবং বাতাসে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ বাড়িয়ে দেবে। বাতাসে জলীয় বাষ্প বেড়ে যাওয়া মানে বাতাসে আর্দ্রতার পরিমাণ বাড়া। আর্দ্রতার প্রভাবে প্রকৃত তাপমাত্রা না বাড়ালেও অনুভূত তাপমাত্রা বেড়ে যাবে। ফলে তাপমাত্রার তুলনায়ও বেশি গরম অনুভূত হবে।

ইতোমধ্যে একটি জরিপে দেখা গেছে, বাংলাদেশের আর্দ্রতার মাত্রা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাছাড়া ২০৩০ সাল নাগাদ বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাত ১০-১৫ ভাগ এবং ২০৭৫ সাল নাগাদ তা প্রায় ২৭ ভাগ বেড়ে যাবে। ফলে বাতাসে আর্দ্রতার মাত্রা বেড়ে যাবে চরম হারে। এই আর্দ্রতা গরম বাড়িয়ে দেবে।

জাতিসংঘের আন্তঃসরকারি জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত প্যানেলের পানি সম্পদের ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব নিয়ে তৈরি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশসহ সমুদ্রতীরের বেশ কয়েকটি দেশে আগামী বছরগুলোতে মিঠা পানির তীব্র সংকট দেখা দেবে। জলবায়ুর পরিবর্তনের প্রভাবে এরইমধ্যে বাংলাদেশে বৃদ্ধি পেয়েছে নানা রকম প্রাকৃতিক দুর্যোগ। এর মধ্যে ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, বন্যা, নদীভাঙন এবং ভূমিধসের মাত্রা বৃদ্ধি উল্লেখযোগ্য। আগে ১৫ কিংবা ২০ বছর পরপর বড় ধরনের কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ হলেও বর্তমানে দু-তিন বছর পরপরই বড় ধরনের দুর্যোগ হানা দিচ্ছে। ব্রিটিশ গবেষণা সংস্থা ম্যাপলক্র্যাফটের তালিকায় প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ঝুঁকিপূর্ণ ১৫ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান সবার আগে।

বিশ্বের সব মোড়ল রাষ্ট্র, যারা কার্বণ নিঃসরণে প্রতিযোগীতায় নেমেছে তারা যদি এই ধারা অব্যাহত রাখেন তাহলে শুধু বাংলাদেশই নয়, আমাদের এই বসুন্ধরাই ভয়াবহ প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে পড়বে তা নিয়ে কোনো সংশয় রাখেননি বিশেষজ্ঞরা।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ