আবাদি জমিতে রাসায়নিক সার কমান, ভবিষ্যৎ-প্রজন্ম বাঁচান
যে-আবাদি জমিতে শতবর্ষ ধরে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ফসল ফলিয়েছে সেই একই আবাদি জমি এখন অনুর্বর। পুষ্টি উপাদান কমে যাচ্ছে সেই মাটিতে। এর একমাত্র কারণ জমিতে জৈব সার ব্যবহার কমে যাচ্ছে, একই সঙ্গে বাড়ছে রাসায়নিক সারের ব্যবহার। মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক সার ব্যবহারের কারণে ভবিষ্যৎ-প্রজন্মের সামনে এগিয়ে আসছে এক ভয়ানক অনিশ্চয়তা। বাংলাদেশে চালানো এক সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে যে, দেশটির প্রায় ৮০ শতাংশ কৃষি জমির জৈব উপাদান কমে গেছে, যার ফলে ফসল উৎপাদনে মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক সার ব্যবহার করতে হচ্ছে।
সম্প্রতি ‘সয়েল ফার্টিলিটি ট্রেন্ডস ইন বাংলাদেশ ২০১০ টু ২০২০’ শীর্ষক গবেষণায় মাটিতে ফসফরাস, সালফার, পটাশিয়াম, বোরন ও জিংকের পরিমাণ দেখা হয়। এক্ষেত্রে ২০১০ সালের সঙ্গে ২০২০ সালের তুলনামূলক বিশ্লেষণ করেন গবেষকরা। তাতে দেখা যায়, গত ১০ বছরে মাটিতে বিভিন্ন পুষ্টি উপাদানের ঘাটতিযুক্ত এলাকা অস্বাভাবিক বেড়েছে। গতকাল (৬ এপ্রিল) সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন এসব থেকে জানা গেছে। এই গবেষণায় বলা হয়েছে, ফসলি জমিতে যেখানে ৫ শতাংশ জৈব উপাদান থাকা দরকার সেখানে দেশের বেশিরভাগ কৃষি জমিতে জৈব উপাদান দুই শতাংশেরও নিচে নেমে এসেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মাটির পুষ্টি উপাদানের ঘাটতি পূরণে প্রয়োজনের অতিরিক্ত সার প্রয়োগ করা হয়। ফলে চাষের খরচ যেমন বাড়ছে, আবার পরিবেশ ও মানুষের স্বাস্থ্যে মারাত্মক প্রভাব পড়ছে। নাইট্রোজেন যদি ভূগর্ভস্থ পানিতে মিশে যায়, তাহলে তা মানুষের স্বাস্থ্যের ঝুঁকির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। শিশুদের মৃত্যুঝুঁকিও থাকে। আবার ফসফরাস বেশি দেয়া হলে তা বৃষ্টির পানিতে বা বন্যায় খালের পানিতে মিশে যায়। ফলে প্রায়ই মাছ মারা যেতে দেখা যায়। বোরন শিশুদের জন্য ঝুঁকি তৈরি করে। ফলে কৃষককে পরিমিত সার ব্যবহারে সচেতন করতে হবে।
গেল তিন-চার দশক থেকেই কৃষি জমির অবক্ষয় নিয়ে এ-ধরণের গবেষণা চালানো হচ্ছে। প্রতি দশকেই দেখা যায় জমির পুষ্টি উপাদান আগের চেয়ে কমে যাচ্ছে। ২০১০-২০২০ এই দশ বছরে জমির সালফার, পটাশিয়াম, ফসফরাস, জিংক, বোরন সমস্ত উপাদানই উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে। এসবের ঘাটতির পূরণের জন্য প্রচুর পরিমাণ রাসায়নিক সার ব্যবহার করছেন। এসব সার পানিতে মিশে গিয়ে নদী, সমুদ্রে মিশছে। ফলে অন্যান্য জীববৈচিত্র্যও জীবনসংশয়ে পড়ছে।
রাসায়নিক সার ব্যবহার কমিয়ে জমির উর্বরাশক্তি বাড়ানোর একমাত্র উপায় জৈব সারের ব্যবহার বাড়ানো। কিন্তু, নানা কারণে জমিতে জৈব উপাদান কমে যাচ্ছে। ফলে কমে যাচ্ছে মাটির নানা ধরনের অনুজীব। যা সমস্ত জীবনচক্রেই মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। আরেকটা কারণ হচ্ছে, নদীতে বাঁধ দেয়ার কারণে আগের আর বন্য হয় না। নদীর পানি এখন আর ফসলি জমিতে প্রবাহিত হতে পারে না। ফলে ফসলি জমিতে এখন আর পলি পড়ে না, নতুন মাটি তৈরি হয় না। অন্যদিকে, একই জমিতে বারবার চাষের কারণে জমির উপরিভাগের মাটি ক্ষয়ে যাচ্ছে। এসব বাস্তবতা মেনে নিয়েই বিপুল জনসংখ্যার খাদ্য চাহিদা মেটাতে কৃষককে বাধ্য হয়ে রাসায়নিক সারের ওপর অধিক মাত্রায় নির্ভর করতে হচ্ছে।
এখন কথা হচ্ছে, রাসায়নিক সারের ব্যবহার যত বাড়বে জমির উর্বরাশক্তি ততই কমবে। এভাবে কত দিন চলবে? ভবিষ্যৎ-প্রজন্ম এতে হুমকির মধ্যে পড়বে। এ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য সরকারসহ সংশ্লিষ্ট সবার সচেতনতা ছাড়া উপায় নেই।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে