Views Bangladesh Logo

কৃষি খাতের পুনর্মূল্যায়ন ও কৃষি কমিশন গঠন প্রসঙ্গে

বাংলাদেশের কৃষি খাতে উৎপাদন বৃদ্ধির বড় সমস্যা কৃষি জমির সীমাবদ্ধতা। বর্তমানে জনপ্রতি কৃষি জমির প্রাপ্যতা ০.১১ একর। মোট কৃষি খামারের সংখ্যা ১,৬৮,৮১,৭৫৭। নিচের ৯১.৭০ শতাংশ কৃষক প্রান্তিক ও ছোট। তাদের দখলে আছে ৬৯ শতাংশ কৃষি জমি। উপরের ৮.৩ শতাংশ কৃষক মাঝারি ও বড়। তারা ৩১ শতাংশ জমি চাষাবাদ করছেন। সম্প্রতি মাঝারি ও বড় কৃষকের সংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে। বৃদ্ধি পাচ্ছে ছোট কৃষকদের সংখ্যা। তাতে ফসল উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। সর্বশেষ কৃষি শুমারির (২০১৮-১৯) প্রতিবেদন থেকে দেখা যায় মোট কৃষি খামারের সংখ্যা ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত কৃষি শুমারির তুলনায় ২০১৯ সালে ১১.১৯ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। বড় খামারগুলোর নিয়ন্ত্রণে জমি কমেছে ৪৬.১৮ শতাংশ। মাঝারি খামারগুলোর নিয়ন্ত্রণে থাকা জমির পরিমাণও হ্রাস পেয়েছে ৩৬.০৬ শতাংশ। এ ক্ষেত্রে ৩২.২৪ শতাংশ জমি বেশি দখলে নিয়েছে ছোট খামারগুলো। এরা সাধারণত খোরপোষ পর্যায়ে চাষাবাদ করে। বাজারজাত উদ্বৃত্ত এদের তেমন থাকে না।


উৎপাদনে আধুনিক উপকরণ ব্যবহার ও ভূমি উন্নয়নে এদের আগ্রহ থাকে কম। প্রাতিষ্ঠানিক ঋণ প্রাপ্তি ও কৃষি যন্ত্র সংগ্রহে এদের প্রবেশাধিকার কম। ফলে তাদের প্রতি ইউনিট জমির উৎপানে প্রবৃদ্ধির হার কম। অপরদিকে বড় ও মাঝারি কৃষকগণ ক্রমাগতভাবে উৎপাদন খরচ বৃদ্ধির কারণে আগ্রহ হারাচ্ছেন চাষাবাদে। তারা ক্ষয়িষ্ণু কৃষক। চাষাবাদে তাদের বিনিয়োগ হ্রাস পাচ্ছে। ফলে তাদের উৎপাদন অনেকটা স্থবির হয়ে পড়েছে।

কৃষিপণ্যের বাজার ব্যবস্থা এখন কৃষকদের অনুকূলে নয়। এর নিয়ন্ত্রণ চলে গেছে বড় ব্যবসায়ী, মিলার ও তাদের দ্বারা সংগঠিত সিন্ডিকেটের হাতে। বাজারে কৃষি পণ্যের মূল্য এরাই নির্ধারণ করেন। তাতে উৎপাদনকারী কৃষক ও অপরদিকে ভোক্তারা ক্ষতিগ্রস্ত হন। বাজারে খামার প্রান্তের ক্রয় মূল্য ও ভোক্তা পর্যায়ে পণ্যের বিক্রয় মূল্যের পার্থক্য বেশি। এর পুরো সুবিধা নিচ্ছেন মধ্যস্বত্বভোগী ব্যবসায়ীরা। তারা শস্যের প্রক্রিয়াজাত করেন, মূল্য সংযোজন করেন এবং বাজারে পণ্যমূল্য বাড়িয়ে মুনাফা হাতিয়ে নেন। উদাহরণ স্বরূপ চালের উচ্চ মূল্যের কথা বলা যায়। উৎপাদন মৌসুমে ব্যবসায়ীরা অনেক কম দামে কৃষকের খামার থেকে ধান কিনে নেন। পরে তা চালে রূপান্তর করে এবং গুদামে মজুত রেখে অনেক বেশি দামে বাজারে বিক্রি করেন। এক সমীক্ষায় দেখা যায়, বাংলাদেশের কৃষকরা পার্শ্ববর্তী দেশাগুলোর তুলনায় ফসলের দাম সবচেয়ে কম পেয়ে থাকেন। মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্যের কারণে তারা চালের ভোক্তা-মূল্যের ৭১ শতাংশ থেকে বঞ্চিত হন। তাতে লাভবান হোন মিলাররা। তারা অত্যন্ত শক্তিশালী ও সংগঠিত গোষ্ঠী। এ ক্ষেত্রে সরকারের হস্তক্ষেপ তেমন প্রভাব বিস্তার করতে পারে না। কারণ খাদ্যশস্য মজুতের ক্ষেত্রে সরকারের সক্ষমতা কম। ব্যবসায়ী ও মিলারদের সক্ষমতা বেশি। ফলে বাজারে মিলারদেই নিয়ন্ত্রণ বেশি।

বর্তমানে সরকারের খাদ্যশস্য মজুতের সক্ষমতা মাত্র ২২ লাখ টন। অপরদিকে ব্যবসায়ী ও ছোট-বড় মিলারদের মজুত সক্ষমতা প্রায় ১ কোটি টন। তাছাড়া সরকারের ধান-চাল সংগ্রহের ক্ষেত্রেও মিলারদেরই আধিপত্য বেশি। সরকারকে চাল সরবরাহ করে তারাই লাভবান হন। কৃষকদের নিকট থেকে সরাসরিভাবে ধান ক্রয়ের ওপর তেমন গুরুত্ব নেই সরকারের। গত কয়েক বছর ধরে উৎপাদন মৌসুমে কৃষকদের নিকট থেকে সরকারিভাবে ধান ক্রয়ের যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হচ্ছে তার সিকি ভাগও পূরণ করা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে সরকারের নির্ধারিত মূল্যে ধান বিক্রির সুবিধা থেকেও বঞ্চিত হচ্ছেন কৃষকগণ। নিরুপায় হয়ে তারা মিলারদের নিকট অপেক্ষাকৃত কম দামে ধান বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন। তাতে অনেক সময় তাদের উৎপাদন খরচও ওঠে না। শুধু ধান-চালের ক্ষেত্রে নয়, অন্যান্য ফসলের ক্ষেত্রেও কৃষকরা পণ্যের ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এবার আলু ও সবজির মূল্য ধসে খুবই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন উৎপাদনকারী কৃষকগণ। জমিচাষ, শ্রমিকের মজুরি, বীজ, সার, কীটনাশক ও সেচের খরচ উচ্চ হারে পরিশোধ করে তারা অনেকটা নিঃস্ব হয়ে পড়েছেন। কৃষিকাজে বড় দাগে লোকসান দিয়ে তাদের অনেকেই এবার পথে বসেছেন।

বাংলাদেশকে আমরা প্রায়ই খাদ্যে স্বনির্ভর বলে দাবি করি। কথাটা তেমন অর্থবহ নয়। কারণ প্রতি বছরই আমরা বিপুল পরিমাণ খাদ্যসশ্যসহ অন্যান্য কৃষিপণ্য আমদানি করছি। খাদ্যশস্যের ক্ষেত্রে এর পরিমাণ প্রায় ৭০ থেকে ৮০ লাখ টন। তেল, ডাল, পেঁয়াজ ও অন্যান্য মসলার ক্ষেত্রেও আমাদের বড় নির্ভরতা আমদানির ওপর। প্রতি বছর গড়ে প্রায় ৫ বিলিয়ন ডলারের কৃষিপণ্য আমাদের আমদানি করতে হয়। বাংলাদেশে উৎপাদিত কৃষিপণ্যের বাজারের আকার প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলার। আমদানি যোগ করা হলে অভ্যন্তরীণ কৃষিপণ্যের বাজারের আকার দাঁড়ায় ১৫ বিলিয়ন ডলার। তার এক-তৃতীয়াংশই আমদানিনির্ভর। এ পরনির্ভরতা কাটাতে হলে কৃষিপণ্যের অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বাড়াতে হবে। গবেষণার মাধ্যমে আধুনিক প্রযুক্তি করায়ত্ত করতে হবে এবং তা দ্রুত সম্প্রসারণ করতে হবে। এর জন্য কৃষিতে বিনিয়োগ বাড়ানো দরকার। ক্ষেত্র বিশেষে ভর্তুকি বাড়িয়ে কৃষকের উৎপাদন খরচ কমানো দরকার। কৃষিকর্মে তাদের প্রতিষ্ঠানিক ঋণ নিশ্চিত করা দরকার।

বর্তমান বিশ্বে কৃষি খাত খুবই ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। তার প্রধান কারণ হচ্ছে গত কয়েক বছর ধরে যুদ্ধ-বিগ্রহ, প্রথমে ইউক্রেন-রাশিয়া, পরবর্তীতে গাজায় ইসরায়েলের আগ্রাসন। এসব কারণে সরবরাহে বিঘ্ন সৃষ্টি হয়েছে, উৎপাদন কমে গেছে। তেলের দাম বেড়েছে। মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। এর আগে আবার করোনাকালে খাদ্যশস্যের উৎপাদন হ্রাস পেয়েছিল। ওই সময় সরবরাহে বিঘ্ন ঘটেছে, পরবর্তীতে যুদ্ধের কারণেও খাদ্য পরিবহন ও বিতরণ বিঘ্নিত হয়েছে। এসব কারণে আন্তর্জাতিকভাবে খাদ্যশস্যের দাম বেড়েছে। গত দুই বছরে বৈশ্বিক উষ্ণতা বেড়েছে। বিশেষ করে ২০২৩ সালে বৈশ্বিক তাপমাত্রা ১.৪৮ ডিগ্রি ও ২০২৪ সালে ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস অতিক্রম করেছে। অর্থাৎ শিল্প উন্নয়ন প্রাক্কালের চেয়ে দ্রুত বৈশ্বিক তাপমাত্রা বেড়েছে। এই বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি ও খড়ার কারণে ধান ও গমের উৎপাদনসহ পুরো কৃষির উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তা ছাড়া অতিবৃষ্টি-বন্যার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে উৎপাদন। এর ফলে এখন অন্য যে কোনো সময়ের চেয়ে বিশ্বে খাদ্য সংকট ও সরবরাহে ঘাটতি বেশি। উৎপাদনের গড় প্রবৃদ্ধি কমে যাচ্ছে। এতে করে খাদ্যপণ্যের দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই বৈশ্বিক পরিস্থিতির নেতিবাচক প্রভাব বাংলাদেশেও পড়েছে। গত ২০২৪ সালের শুরুতে ছিল খরা, পরে হয়েছে বন্যা। কোথাও কোথাও হয়েছে অতি বৃষ্টি ও বন্যা। এতে করে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কৃষি। তারপর আঘাত হেনেছে ঘূর্ণিঝড় রিমেল। এসব প্রাকৃতিক দুর্যোগ একসঙ্গে আঘাত করায় খাদ্য উৎপাদন কমেছে। এ অবস্থায় দরকার ছিল প্রচুর খাদ্য আমদানির; কিন্তু ডলার সংকটের কারণে প্রয়োজনীয় আমদানি সম্ভব হয়নি। লেটার অব ক্রেডিট (এলসি) খোলা যাচ্ছিল না। টাকার অবচয়ন হয়েছে। এসব কারণেও খাদ্যশস্যের দাম বেড়েছে। গত দুই বছরের আগ পর্যন্ত আমদানি বাড়ছিল; কিন্তু গত দুই বছর তা কমেছে। আমাদের উৎপাদন বেশি হয়েছে এজন্য আমদানি করা হয়নি বিষয়টি তেমন না, বরং ডলারসহ অন্যান্য সংকটে খাদ্যশস্য আমদানি করা যাচ্ছিল না। এ কারণে সরবরাহ সংকট সৃষ্টি হয়েছে। ফলে চালসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বেড়ে গেছে।

আমরা একদিকে চাহিদা মতো কৃষিসহ অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য উৎপাদন করতে পারছি না, অপরদিকে আমদানিও করা যাচ্ছিল না। তাতে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। গত বছরের নভেম্বরে খাদ্য মূল্যস্ফীতি এক দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ দাঁড়িয়েছিল ১৩.৮ শতাংশ। আর ডিসেম্বরে কিছুটা কমলেও ১৩ শতাংশের কাছাকাছিই ছিল। গত ফেব্রুয়ারিতে তা কিছুটা কমে হয়েছে ৯.২৪ শতাংশ। এটা খুবই উচ্চ মূল্যস্ফীতি। এমন পরিস্থিতিতে কৃষি খাতের উৎপাদন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বৈশ্বিক অস্থির পরিস্থিতি, বাংলাদেশের আর্থিক সংকট ও উচ্চ মূল্যস্ফীতির ক্ষেত্রে কৃষিপণ্যের উৎপাদন বাড়ানো ছাড়া গত্যন্তর নেই। তাছাড়া কোনোভাবেই খাদ্য মূল্যস্ফীতি দমানো যাবে না। কৃষির উৎপাদন অনেক দিক থেকে চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। এগুলোর একটি প্রকৃত মূল্যায়ন হওয়া দরকার। দেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে নতুন সরকার গঠন হয়েছে। তাদের কাজে সহায়তার জন্য কৃষি খাতের পুরো পরিস্থিতির একটি রিভিউ করা দরকার। আমরা কৃষি খাতে কোথায় আছি, তার মূল্যায়ন দরকার। এর জন্য দরকার কৃষি কমিশন। উক্ত কমিশন বর্তমান কৃষি ব্যবস্থার একটি বিস্তারিত রিভিউ উপস্থাপন করবেন এবং বর্তমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ভবিষ্যতের জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য-উপত্তের গভীর বিশ্লেষণ করে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ গ্রহণে সুপারিশ করবেন। নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ১১টি কমিশন গঠন করেছে। এগুলোর দরকার ছিল। কয়েকটি কমিশন ইতোমধ্যেই তাদের প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। সেখানে তারা খুবই গুরুত্বপূর্ণ কিছু সুপারিশ করেছে।

উৎপাদনের সবচেয়ে বড় খাত হচ্ছে কৃষি খাত। আসলে উৎপাদনশীল খাত বলতে প্রধানত কৃষিকেই বোঝায়। সুদূর অতীতেও কৃষিকেই উৎপাদনশীল খাত হিসেবে চিহ্নিত করা হতো। অন্যান্য খাত তথা শিল্প, সেবা, কলকারখানা এগুলো সহযোগী খাত। শিল্পের কাঁচামাল কৃষি থেকেই আসে। তার ওপরই নির্ভর করে আমাদের খাদ্যনিরাপত্তা। অতীতের মতো বিদেশের ওপর নির্ভরশীল থেকে দেশের খাদ্যনিরাপত্তা যে নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে না, তা এখন অবধারিত। তাই কৃষি খাতের উৎপাদন বাড়াতে হবে। বর্তমানে কৃষির উৎপাদনে অনেকটা স্থবিরতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এর আগে ৭০ ও ৮০ দশকের গোড়ার দিকে কৃষি খাতে ছোট করে মূল্যায়ন হয়েছিল। পরবর্তীতে ১৯৮৮-৮৯ সালে জাতিসংঘের সহায়তায় বিস্তারিতভাবে কৃষি খাতের রিভিউ করে দুই ভলিয়মে তা বই আকারে প্রকাশ করা হয়েছিল। সেখানে ক্রপস, লাইভস্টক, ফিশারিজ, ফরেস্ট্রি এবং মেকানাইজেশনসহ সব উপখাতের ওপর আলোকপাত করা হয়েছিল। কৃষিকে সামগ্রিকভাবে বিবেচনা করে গভীর বিশ্লেষণ করা হয়েছিল ও সুপারিশ পেশ করা হয়েছিল। নব্বইয়ের দশকে অধ্যাপক রেহমান সোবহান পরিকল্পনা কমিশনের উপদেষ্টা থাকাকালে বিভিন্ন টাস্কফোর্স গঠন করেছিলেন। সেগুলো প্রকাশনী সংস্থা ইউপিএল থেকে ৪টি ভলিয়মে প্রকাশিত হয়েছিল। সেখানে একটি বিষয় ছিল কৃষি। নব্বইয়ের পর গত প্রায় ৩৪ বছর যাবৎ কৃষি খাতে রিভিউ করা হয়নি। এখানে একটি গভীর বিশ্লেষণ প্রয়োজন।

কৃষি খাতে বর্তমান সমস্যাগুলো কী তা আমরা মোটামুটিভাবে জানি। একটা সময় ছিল যখন আমরা শস্য খাতের ওপর বেশি নির্ভরশীল ছিলাম। মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির প্রায় ৮০ শতাংশই ক্রপস সেক্টর থেকে আসত। কালক্রমে আমরা তা থেকে উত্তরণ ঘটিয়েছি। বর্তমানে ক্রপস সেক্টর থেকে আসছে ৫০ শতাংশ ও বাকি ৫০ শতাংশ আসছে লাইভস্টক, ফিশারিজ ও ফরেস্ট্রি সেক্টর থেকে। তবে পরিবর্তনের গতিটা খুবই কম। আমরা ধানের ওপর যতটা গুরুত্ব দিয়েছি অন্যান্য শস্যের ওপর ততটা দিচ্ছি না। ধান উৎপাদনের জন্য ৭২ শতাংশ জমি ব্যবহার করা হচ্ছে। এখন ধান উৎপাদনে মোটামুটিভাবে আমরা স্বয়ম্ভরতা অর্জন করেছি। যখন ভালো উৎপাদন হয় তখন আমদানি করতে হয় না। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে চালের মোট উৎপাদন ছিল ৪ কোটি সাড়ে ৭ লাখ টনের মতো। এতে করে তখন আমদানি করতে হয়নি। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে খরা, বন্যা, ঘূর্ণিঝড়সহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে উৎপাদন অনেক কমেছে। এই উৎপাদন কমে যাওয়ার ফলে আমাদের আবার আমদানি করতে হচ্ছে। এবার অন্তত ১০ লাখ টনের মতো খাদ্যশস্য আমদানি করতে হবে। তাছাড়া অন্যান্য শস্যের ক্ষেত্রেও প্রচুর আমদানি করতে হয়। মসলা জাতীয় ফসল, ডাল, তেল ইত্যাদি আমদানি করতে হয় অনেক। তা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। গ্রহণ করতে হবে আমদানি প্রতিস্থাপন নীতি।

দেশে কৃষিজমি হ্রাস পাচ্ছে। ১৯৮৪ সালে বিস্তারিতভাবে দেশে কৃষি শুমারির আয়োজন করা হয়েছিল। সর্বশেষ ২০১৮-১৯ সালের কৃষি শুমারির হিসেব মতে, কৃষি খাতে গত ৩৫ বছরে জমির পরিমাণ বার্ষিক গড়ে শূন্য দশমিক ৫৮ শতাংশ হারে কমছে। এই হারে যখন জমি কমছে, তখন আমরা কী করতে পারি? দেশে আইন রয়েছে দুই ফসলি ও তিন ফসলি জমি কৃষি ছাড়া অন্য কোনো কাজে ব্যবহার করা যাবে না। এটা কেউ মানছে না। আমাদের রুরাল ডেভেলপমেন্ট প্যাটার্ন ও হাউজিং প্যাটার্নে কীভাবে পরিবর্তন আনা যায়, যাতে করে কৃষিজমি ক্ষতিগ্রস্ত না হয় তা ভাবা দরকার। আমাদের ভবিষ্যৎ উৎপাদন যাতে বিঘ্নিত না হয়, এ ব্যাপারে চিন্তাভাবনা করা দরকার। বাংলাদেশ হলো পৃথিবীর অনেক গরিব দেশের মধ্যে একটি। আমাদের খাদ্য সংকট তীব্র; কিন্তু খাদ্য অপচয়ে আমরা বিশ্বের শীর্ষে। আমাদের বছরে জনপ্রতি প্রায় ৮২ কেজি খাদ্য অপচয় হয়। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, রাশিয়া এবং ভারতের চেয়েও এখানে খাদ্য অপচয় বেশি। তার কারণ হচ্ছে প্রসেসিং ও গ্রেডিং, পরিবহন ও সংরক্ষণে আমরা অনেক পিছিয়ে আছি। অভাব রয়েছে বিজ্ঞানভিত্তিক জ্ঞানের।

আমাদের দেশে প্রচুর কৃষি শ্রমিক আছে; কিন্তু অভাব রয়েছে উৎপাদনের আধুনিক উপকরণের। এক সময় ভাবা হতো, দেশে প্রচুর গ্যাস আছে তাই সার উৎপাদন সম্ভব। কয়েকটি কারখানাও স্থাপন করা হয়েছিল। ইউরিয়ার উৎপাদন ছিল আশাব্যঞ্জক। প্রয়োজনের ৭০-৮০ শতাংশ ইউরিয়া দেশে উৎপাদন করা হতো। কালক্রমে সেই উৎপাদন কমে গিয়ে আমদানি নির্ভরতা বেড়েছে। এখন বছরে যা প্রয়োজন তার মাত্র ২০ শতাংশ উৎপাদন হয়, বাকিটা আমদানি। তবে বিভিন্ন কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে সার তেমন সহজলভ্য নয়। তাই বিদেশের ওপর নির্ভর করা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। যেভাবেই হোক সারের উৎপাদন বাড়াতে হবে। বন্ধ থাকা কারখানাগুলো চালু করতে হবে। অন্যান্য কৃষি উপকরণেও নিজেদের আত্মনির্ভরশীল হওয়া দরকার। যান্ত্রিকীকরণের জন্য আমরা পুরোপুরিভাবে বিদেশের ওপর নির্ভরশীল, অথচ দেশে যৌথভাবে বিভিন্ন যন্ত্র উৎপাদন করা যায়। বছরে ৩৫-৪০ লাখ টন কীটনাশক আমাদের আমদানি করতে হয়। আমরা জানি কীটনাশক তৈরিতে কি কি উপকরণ দরকার। তাই প্রয়োজনীয় উপকরণ আমদানি করে দেশেই কীটনাশক উৎপাদন করা সম্ভব। বর্তমানে ব্যবহৃত সেচযন্ত্রের প্রায় এক-চতুর্থাংশ বিকল। এগুলোর ৩০-৩৫ শতাংশ বিদ্যুৎ চালিত, বাকি ডিজেলচালিত। বর্তমানে বিদ্যুৎ ও ডিজেলের দাম বেড়েছে, তাতে বেড়েছে উৎপাদন খরচ। এক্ষেত্রে সৌরবিদ্যুতের ব্যবহার খুবই সাশ্রয়ী হতে পারত। এসব বিষয়ে চিন্তাভাবনা করা দরকার।

বিশ্বের অনেক দেশের তুলনায় কৃষি খাতে বাংলাদেশে ভর্তুকি কম। বহু বছর ধরে আমরা কৃষি খাতে ভর্তুকি দিয়ে আসছি, এখনো দিচ্ছি। আমাদের ৯২ শতাংশ কৃষক হচ্ছে ক্ষুদ্র। তারা প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ করতে পারে না। চীনে প্রত্যেক কৃষককে ভর্তুকি দেয়া হয় ১৫৯ ডলার ও বাংলাদেশ ৭.৮ ডলার মাত্র, এটি খুবই কম। কৃষি খাতে অর্থায়ন বড় সমস্যা। এ জন্য গরিব কৃষকদের জন্য অর্থের জোগান দেয়া দরকার। সাম্প্রতিক সময়ে কৃষি ঋণ গড়ে ৭-৮ শতাংশ হারে বাড়ছে। গত ১৫-২০ বছর যাবৎ কৃষি ঋণ বাড়লেও দেশের কৃষকদের মধ্যে প্রায় ৪০ শতাংশের বেশি এখনো প্রাতিষ্ঠানিক ঋণ পাচ্ছে না। মূল টাকাটা ধনিক শ্রেণির মানুষ নিয়ে যাচ্ছে। এসব সমস্যা চিহ্নিত করতে হবে। এ জন্য কৃষি খাতে গভীর বিশ্লেষণ দরকার।

কৃষি উৎপাদনের সরকারি পরিসংখ্যান খুব কম নির্ভরশীল। খাদ্যশস্য উৎপাদন থেকে শুরু করে মাছ-মাংস খাওয়ার যে পরিসংখ্যান আমরা পাচ্ছি তা অনেক ক্ষেত্রে বস্তুনিষ্ঠ নয়। এ বছর বন্যাসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে আউশের উৎপাদন কমপক্ষে ৪ ভাগের এক ভাগ নষ্ট হয়েছে। আমনের উৎপাদন ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। যা টার্গেট ছিল তার তুলনায় ৩ লাখ হেক্টর কম জমিতে উৎপাদন হয়েছে আমন। অনেক ক্ষেত্রেই আমন দ্বিতীয় ও তৃতীয়বার রোপণ করতে হয়েছে। দেরিতে রোপণের কারণেও উৎপাদন কমেছে। তারপরও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (ডিএই) পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে- আমনের উৎপাদন প্রায় ১ কোটি ৭১ লাখ টন হয়েছে। বাজারের যে অবস্থা তাতে মনে হয় না যে ওই পরিমাণ আমন চাল উৎপাদিত হয়েছে। যদি এতই উৎপাদন হতো, তাহলে বাজারে চালের দাম এতটা ঊর্ধ্বমুখী হতো না। আলু, পেঁয়াজ, ডিম, দুধ ও মাংসের ক্ষেত্রে উৎপাদনের যে হিসেব দেয়া হয়, বাস্তবতার সঙ্গে তার মিল পাওয়া যায় না। তাছাড়া বিভিন্ন পণ্যের ভোগ চাহিদার ক্ষেত্রেও সঠিক পরিসংখ্যানের অভাব। আমাদের উৎপাদন ও ভোগের পরিসংখ্যান প্রদানের ক্ষেত্রে যে নিয়ম অনুসরণ করা হয় তার চুলচেরা বিশ্লেষণ প্রয়োজন। সঠিক পরিসংখ্যানের জন্য দরকার পদ্ধতিগত সংস্কার।

কৃষি খাতে উৎপাদনের স্থবিরতা এবং বড় ধরনের আমদানি নির্ভরতা আমাদের শংকার কারণ। এর সঙ্গে কৃষকদের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য না পাওয়া এবং কৃষিকাজে তাদের উৎসাহ হারানো খুবই উদ্বেগের বিষয়। তাছাড়া কৃষি জমি মালিকানায় ক্ষয়িষ্ণু ধারা এবং ছোট ও প্রাপ্তিক কৃষকদের সংখ্যাবৃদ্ধি বাণিজ্যিক চাষাবাদের বড় প্রতিবন্ধক হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। কৃষি উপকরণ জোগানের জন্য বিদেশ নির্ভরতাও আমাদের উদ্বেগের বিষয়। আমাদের কৃষি ব্যবস্থায় ক্রমাগতভাবে পরিবর্তন ঘটছে। এর সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর জন্য সাম্প্রতিক তথ্য-উপাত্তের সমারোহ ঘটানো প্রয়োজন। এর জন্য গঠন করতে হবে এগ্রিকালচার কমিশন। উক্ত কমিশন থেকে যে সুপারিশ আসবে তা এই সরকার যতটুকু পারে বাস্তবায়ন করবে। আগামীতে নির্বাচিত সরকারের ওপর বাকিটা বাস্তবায়নের ভার থাকবে। এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যদি কৃষি খাতে একটি রিভিউ করে যেতে পারে তাহলে দেশের জন্য ভালো একটা কাজ হবে।

ড. জাহাঙ্গীর আলম: কৃষি অর্থনীতিবিদ, সাবেক মহাপরিচালক, বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউট; সাবেক উপাচার্য, ইউনিভার্সিটি অব গ্লোবাল ভিলেজ 

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ