Views Bangladesh Logo

হাইকোর্টে বহাল থাকলেও ৭ মার্চ বাতিলের সুপারিশ সংস্কার কমিশনের

৯৭১ সালের ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণা ও মহান মুক্তিযুদ্ধে মুজিবনগর সরকারের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র বহাল রেখে গত বছরের ১৭ ডিসেম্বর সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিলের রায় দেন হাইকোর্ট। তবে অন্তর্বর্তী সরকারকে দেয়া চূড়ান্ত প্রতিবেদনে সংবিধানের ১৫২(২) অনুচ্ছেদ বাতিলের প্রস্তাব করেছে সংবিধান সংস্কার কমিশন, যেটিতে রয়েছে ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণা এবং মুজিবনগর সরকারের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র।

প্রতিবেদনে সংবিধানের ১৫৩টি অনুচ্ছেদের ৬৪টি সংশোধন, পরিবর্তন বা বাতিলের সুপারিশ করেছে রাষ্ট্র সংস্কারে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত এই কমিশন। পাশাপাশি একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের ধারাবাহিকতা রেখেও ‘চব্বিশের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানকে’ প্রস্তাবনার অংশ করতে নতুন চারটি অনুচ্ছেদ সংযোজনের প্রস্তাব দেয়া হয়েছে।

শনিবার (৮ ফেব্রুয়ারি) প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন জমা দেয় অধ্যাপক আলী রীয়াজের নেতৃত্বে সংবিধান সংস্কার কমিশন। তবে কীভাবে সংবিধানের এসব সংস্কার হবে তা বলা হয়নি।

সংবিধান অনুসারে সংসদে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছাড়া সংবিধান সংশোধন করা যায় না। নির্বাচিত সংসদ সদস্যরাই তা করতে পারেন। সংবিধান সংশোধনে তাই প্রয়োজন জাতীয় সংসদও।

কার্যকর গণতন্ত্র, মৌলিক মানবধিকার সুনিশ্চিতকরণ এবং জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বেশ কিছু বিষয়কে গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করতে বলেছেন সংবিধান সংস্কার কমিশন। প্রস্তাবগুলো হচ্ছে- ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের মহান আদর্শ এবং ‘২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানের’ জনআকাঙ্ক্ষার প্রতিফলনস্বরূপ সংবিধান ও রাষ্ট্রের মূলনীতি হিসেবে ‘সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক সুবিচার, বহুত্ববাদ ও গণতন্ত্র’, ক্ষমতার প্রাতিষ্ঠানিক ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা, প্রধানমন্ত্রী পদের একচ্ছত্র ক্ষমতা হ্রাস, অন্তর্বর্তী সরকার কাঠামোর সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব, বিচার বিভাগের বিকেন্দ্রীকরণ, শক্তিশালী স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা সুনিশ্চিত ও মৌলিক অধিকারের আওতা সম্প্রসারণ এবং সাংবিধানিক সুরক্ষা ও বলবৎযোগ্যতা নিশ্চিত।

সংবিধানের বিদ্যমান প্রস্তাবনার ভাষ্যকে বদলে পুনঃপ্রতিস্থাপনেরও সুপারিশ করেছে কমিশন।

প্রস্তাবনায় উঠে এসেছে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় স্বৈরাচারী ও ফ্যাঁসিবাদী শাসনের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধও।

প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, ‘আমরা জনগণের সার্বভৌম অধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক সুবিচার, বহুত্ববাদ ও গণতন্ত্রকে সংবিধানের মূলনীতি হিসেবে গ্রহণ করে জনগণের জন্য একটি সংবিধান রচনা ও বিধিবদ্ধ করছি, যে সংবিধান বাংলাদেশের জনগণের সর্বোচ্চ আকাঙ্ক্ষার বহিঃপ্রকাশ এবং যে সংবিধান স্বাধীন সত্তায় যৌথ জাতীয় বিকাশ সুনিশ্চিত করবে এবং বর্তমান ও ভবিষ্যত প্রজন্মের অধিকার সংরক্ষণ করবে। আমরা দৃঢ়ভাবে ঘোষণা করছি যে, এই সংবিধান প্রতিটি নাগরিককে পরস্পরের প্রতি অধিকার, কর্তব্য ও জবাবদিহিতার চেতনায় সংঘবদ্ধ করবে, সর্বদা রাষ্ট্র পরিচালনায় জনপ্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করবে, আন্তর্জাতিক শান্তি ও সহযোগিতার নীতিকে অনুসরণ করবে এবং রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব সমুন্নত রাখবে’।

সংবিধানের দ্বিতীয় ও তৃতীয় ভাগের অধিকারগুলোকে সমন্বিত করে ‘মৌলিক অধিকার ও স্বাধীনতা’ সনদ গঠনের প্রস্তাব করা হয়েছে, যা আদালতে বলবৎযোগ্য হবে এবং অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক অধিকার ও নাগরিক, রাজনৈতিক অধিকারের মধ্যে বিদ্যমান তারতম্য দূর করবে।

সুপারিশমালায় রয়েছে বাংলাদেশের সংবিধানের অন্যতম আলোচিত ৭০ অনুচ্ছেদ বাতিলও। এতে বলা হয়েছে - ‘কোনো রাজনৈতিক দলের প্রার্থী মনোনীত হয়ে কোনো ব্যক্তি যদি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন, তিনি যদি নিজ দল থেকে পদত্যাগ করেন অথবা সংসদে নিজ দলের বিপক্ষে ভোটদান করেন, তাহলে সংসদে তার আসনটি আসন শূন্য বলে বিবেচিত হবে।’

বাংলাদেশের এককক্ষ বিশিষ্ট সংসদে নারীদের ৫০টি সংরক্ষিত আসনসহ মোট ৩৫০টি আসন রয়েছে। কমিশনের সুপারিশে দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট সংসদের প্রস্তাবনা দেয়া হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ‘সংসদ হতে পারে দুই কক্ষের, আসন থাকবে পাঁচ শতাধিক, ভোট হবে নারী আসনেও। সংসদের নিম্নকক্ষের আসন সংখ্যা বেড়ে হবে চারশ’টি। এর সঙ্গে উচ্চকক্ষে আরো ১০৫টি আসন যুক্ত করার কথা বলা হয়েছে। নিম্নকক্ষের চারশ’ আসনের ১০০টি নারী আসন হবে। তাদের দলের মনোনয়ন পেলেই হবে না, সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হতে হবে’।

‘একজন সংসদ সদস্য একইসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী, সংসদনেতা কিংবা রাজনৈতিক দলের প্রধান- এই তিনটির যেকোনো একটির বেশি পদে অধিষ্ঠিত হবেন না। এর পাশাপাশি, অর্থবিল ছাড়া নিম্নকক্ষের সদস্যদের মনোনয়নকারী দলের বিপক্ষে ভোট দেয়ার পূর্ণ ক্ষমতা থাকবে এবং আইনসভার স্থায়ী কমিটিগুলোর সভাপতি সবসময় বিরোধীদলীয় সদস্যদের মধ্য থেকে মনোনীত হবেন’।

তরুণদের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত করারা ভাবনা থেকে কমিশন আরও সুপারিশ করেছে, ‘রাজনৈতিক দলগুলো নিম্নকক্ষের মোট আসনের ন্যূনতম ১০ শতাংশ আসনে তরুণ-তরুণীদের মধ্য থেকে প্রার্থী মনোনীত করবে এবং সংসদীয় নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার ন্যূনতম বয়স হবে ২১ বছর। সংসদে বিরোধী দল থেকে মনোনীত একজনসহ ২ (দুই) জন ডেপুটি স্পিকার থাকবেন এবং সংবিধানের যেকোনো সংশোধনী উভয় কক্ষের দুই-তৃতীযাংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার অনুমোদন ও পরবর্তীতে প্রস্তাবিত সংশোধনী উভয় কক্ষে পাস হলে গণভোটে উপস্থাপন করতে হবে’।

রাষ্ট্রীয় কার্যাবলীতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা এবং রাষ্ট্রীয় অঙ্গ ও প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ভারসাম্য নিশ্চিতে ‘জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল (এনসিসি)’ গঠন এবং আইনসভার মেয়াদ শেষ হওয়ার পরে কিংবা আইনসভা ভেঙে গেলে পরবর্তী নির্বাচিত সরকার শপথ না নেয়া পর্যন্ত, সর্বোচ্চ ৯০ (নব্বই) দিন মেয়াদের অন্তর্বর্তী সরকার নিয়োগের সুপারিশ করা হয়েছে।

সংবিধান প্রধানমন্ত্রীকে যে 'একচ্ছত্র আধিপত্য ও ক্ষমতা' দিয়েছে, সেই ব্যবস্থায় পরিবর্তন করে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো মধ্য দিয়ে প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার সুপারিশ করেছে কমিশন।
সংবিধান সংস্কার কমিশনের সুপারিশে বলা হয়েছে, ‘সাধারণ নির্বাচনে কোনো রাজনৈতিক দলের প্রাপ্ত ভোটের হার অনুসারে উচ্চকক্ষে আসন পাবে প্রতিটি দল। এতে সব দলের প্রতিনিধিত্বের পথ তৈরি হবে। কতো শতাংশ মানুষ তাদের ভোট দিয়েছেন, সেই বিবেচনা থেকে যদি প্রতিনিধিত্ব থাকে, তাহলে সব মানুষের প্রতিনিধিত্ব থাকবে সংসদে’।

বিচার বিভাগের স্বাধীনতার বিষয়ে প্রস্তাব করা হয়েছে, ‘বাংলাদেশের বিচার বিভাগ আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নির্বাহী বিভাগ থেকে পৃথক হয়েছিল ২০০৭ সালে। লক্ষ্য ছিল, রাজনৈতিক ও অন্য ক্ষেত্রে প্রভাবমুক্ত হয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া। কিন্তু, বিগত দিনে বিরোধী রাজনৈতিক দল ও বিভিন্ন পক্ষ থেকে অভিযোগ তোলা হয়েছে, বিচার বিভাগ আদতে স্বাধীন নয়, সরকারের ইচ্ছা অনুসারেই পরিচালিত হয়। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিতে বিচার বিভাগের আলাদা সচিবালয় করা দরকার’।

প্রতিবেদনে জনদুর্ভোগ নিরসনে উচ্চ আদালতের বিকেন্দ্রীকরণ করে দেশের সকল বিভাগে হাইকোর্ট বিভাগের সমান এক্তিয়ার সম্পন্ন হাইকোর্টের স্থায়ী আসন প্রবর্তনের সুপারিশ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ‘তবে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের আসন রাজধানীতেই থাকবে’। একইসঙ্গে কমিশন বিচার বিভাগকে পূর্ণ আর্থিক স্বাধীনতা দেয়ার প্রস্তাবও করেছে কমিশন।

সরকার তথা নির্বাহী বিভাগের ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে বিচার বিভাগে আর্থিক বরাদ্দ সরাসরি কনসোলিডেটেড ফান্ড (স্বতন্ত্র তহবিল) থেকে নিয়ে আসার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে।

স্থানীয় সরকারের বিষয়ে বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশে প্রায় এক দশক ধরে স্থানীয় সরকার নির্বাচনও দলীয় প্রতীকে হয়ে আসছিল। স্থানীয় পর্যায়ের উন্নয়নে সংসদ সদস্যদের তহবিল বরাদ্দসহ তাদের সম্পৃক্ততা বাড়ানো হয়েছিল। এসব কারণে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা কেন্দ্রীয় সরকার নির্ভর হয়ে পড়েছে। তাদের বাজেট পর্যন্ত সম্পূর্ণভাবে নির্বাহী বিভাগ এতোটাই নিয়ন্ত্রণ করে যে, স্থানীয় সরকারের পক্ষে কিছু করা সম্ভব হয় না। এছাড়া সংসদ সদস্যরা সমস্ত উন্নয়ন কাজের দায়িত্ব নিয়ে নিয়েছিলেন। তাই স্থানীয় সরকারকে স্বতন্ত্র বরাদ্দের পাশাপাশি সরাসরি উন্নয়ন কাজের দায়িত্ব দেয়া দরকার’।

খাদ্য, শিক্ষা, চিকিৎসা, বাসস্থান ও বস্ত্রের পাশাপাশি সংবিধানে কিছু নতুন অধিকার, যেমন ইন্টারনেট প্রাপ্তি, তথ্য প্রাপ্তি, ভোটাধিকার ও রাষ্ট্র পরিচালনায় অংশগ্রহণ, গোপনীয়তা রক্ষা, ভোক্তা সুরক্ষা, শিশু উন্নয়ন, বিজ্ঞান এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের অধিকার অন্তর্ভুক্তিরও সুপারিশ করেছে সংবিধান সংস্কার কমিশন।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ