Views Bangladesh Logo

জনপ্রশাসনের হাতে ‘ক্ষমতার চাবি’ রেখেই সংস্কার প্রস্তাব

Manik Miazee

মানিক মিয়াজী

সংস্কার বাস্তবায়নের দায়িত্ব মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের হাতে দেয়ার সুপারিশ করেছে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ সরাসরি সরকারপ্রধানের নেতৃত্বে পরিচালিত হওয়ায় এ বিভাগের অধীনে সংস্কার বাস্তবায়নই যুক্তিসঙ্গত বলেই মনে করছে কমিশনটি।

কমিশন বলছে, সুপারিশগুলোর বাস্তবায়নে প্রশাসনিক দক্ষতা বাড়বে, জনসেবার মান উন্নত হবে এবং আমলাতন্ত্রের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত হবে।

চূড়ান্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত ৫৩ বছরে দুই ডজনেরও বেশি কমিশন ও কমিটি গঠিত হলেও সুপারিশগুলো বাস্তবায়িত হয়নি মূলত দুটি কারণে। প্রথমত, রাজনৈতিক নেতৃত্ব অনেক সুপারিশ গ্রহণ করেনি এবং যেগুলো গ্রহণ করেছিল, সেগুলো বাস্তবায়নে আন্তরিক বা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিল না। দ্বিতীয়ত, আমলাতান্ত্রিক স্বার্থের দ্বন্দ্বে বাস্তবায়নে সহযোগিতা করেননি সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।

এসব কারণে কমিশনের পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও পরিস্থিতি অনুকূলে থাকলে সংস্কার সহজ হয়। পাশাপাশি সিভিল সার্ভিসকে সরকারপ্রধানের নির্দেশনায় সংস্কার বাস্তবায়নে প্রশাসনিক নেতৃত্ব দিতে হবে। এবারের সংস্কার কার্যকরভাবে বাস্তবায়নে তাই রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও প্রশাসনিক দৃঢ়তা প্রয়োজন বলেও উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবেদনে।

বুধবার (৫ ফেব্রুয়ারি) প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন হস্তান্তর করেন জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রধান আবদুল মুয়ীদ চৌধুরী। শনিবার (৮ ফেব্রুয়ারি) মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হয় সেটি।

আমলাতন্ত্রের ক্ষমতা বাড়ানো

প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, স্বাধীনতার পর থেকে আমলাতন্ত্রের ভূমিকা নির্দিষ্ট করে কোনো সুস্পষ্ট নীতিমালা গৃহীত হয়নি। ফলে এটি কখনও এতোটাই শক্তিশালী হয়ে ওঠে যে, রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও সাধারণ নাগরিকদের উপেক্ষা করে, আবার কখনও রাজনৈতিক প্রভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে। বিভিন্ন সময়ে নতুন আইন ও বিধি প্রণীত হলেও সেবার পেশাগত মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠায় যথেষ্ট কার্যকর হয়নি।

কমিশন বলেছে, আমলাতন্ত্রকে সুশৃঙ্খল ও জনমুখী করতে ‘সিভিল সার্ভিস কোড’ প্রণয়ন করা উচিত, যা সরকারি কর্মকর্তাদের পেশাদার আচরণবিধি নির্ধারণ করবে। এ আচরণবিধি জনপ্রশাসনকে আরও স্বচ্ছ ও জনবান্ধব হয়ে উঠতে সহায়তা করবে।

প্রশাসনে নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন

কমিশনের আহ্বানে অনলাইন জরিপে অংশ নেয়া এক লাখ ৫ হাজার নাগরিকের ৮৪.৪ শতাংশই মনে করেন, দেশে জনপ্রশাসন সংস্কার প্রয়োজন। ৮০ শতাংশ নাগরিক মনে করেন, জনপ্রশাসন জনবান্ধব নয় এবং ৬৮.৮ শতাংশ মনে করেন, গত ১৫ বছরে প্রশাসনে নিরপেক্ষতার অভাব ছিল।

‘জনপ্রশাসনের প্রধান সমস্যা হলো রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ’ উল্লেখ করে সহজ ও হয়রানিমুক্ত নাগরিক সেবা পেতে বেশকিছু সুপারিশ করা হয়েছে প্রতিবেদনে। সেগুলোর উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, জনবান্ধব হিসেবে গড়তে জনপ্রশাসনকে পুরোপুরি রাজনীতিমুক্ত করা, প্রশাসনিক কাঠামোয় পরিবর্তন, প্রতিটি দপ্তরে জবাবদিহিতা বাড়ানো এবং প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা উন্নত করা।

প্রশাসনিক কাঠামো পুনর্গঠন

প্রশাসনিক কাঠামো পুনর্গঠনে কমিশনের সুপারিশ হচ্ছে, বাংলাদেশ প্রশাসনিক সার্ভিস ও সুপিরিয়র এক্সিকিউটিভ সার্ভিস (এসইএস) গঠন এবং পরীক্ষা নিয়ে উপ-সচিব থেকে অতিরিক্ত সচিব পর্যায়ে নিয়োগ।

বিসিএস ক্যাডার পুনর্গঠনে কাজের ধরন ও বিশেষায়িত দক্ষতার ভিত্তিতে ১৩টি প্রধান সার্ভিসে বিভক্ত করে পৃথক পাবলিক সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে নিয়োগের প্রস্তাব দিয়েছে কমিশন।

বিসিএস (হিসাব ও নিরীক্ষা) সার্ভিসকে দুই ভাগে বিভক্তির সুপারিশ করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, একটি হবে ‘বাংলাদেশ হিসাব সার্ভিস’ এবং আরেকটি হবে ‘বাংলাদেশ নিরীক্ষা সার্ভিস’।

বিসিএস সাধারণ তথ্য ক্যাডারের তিনটি সাব-ক্যাডার একীভূত করার প্রস্তাব দিয়ে কমিশন বলেছে, এগুলোয় পদোন্নতি ও সুযোগ-সুবিধায় বৈষম্য রয়েছে। একীভূত সার্ভিসে থাকবেন, সহকারী পরিচালক/তথ্য কর্মকর্তা/গবেষণা কর্মকর্তা, সহকারী অনুষ্ঠান পরিচালক এবং সহকারী বার্তা নিয়ন্ত্রক। তাদের পদোন্নতি মেধা তালিকার ভিত্তিতে দিতে বলেছে কমিশন।

আইসিটি কর্মকর্তাদের তথ্য সার্ভিসে অন্তর্ভুক্তির সুপারিশ করে কমিশন বলেছে, ‘সরকারি দপ্তরে এখন আইসিটি সম্পৃক্ত বহু কর্মচারী কাজ করেন। তাদের অনেকে বেশ মেধাবীও। অনেকে বিদেশে সাফল্য দেখাচ্ছেন।

আর বিসিএস (তথ্য প্রকৌশল) সার্ভিসকে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি সার্ভিসে অন্তর্ভুক্ত করার সুপারিশ করেছে কমিশন।

বিসিএস ট্রেড ক্যাডার বিলুপ্তির প্রস্তাবনায় কমিশন বলেছে, ‘বিসিএস (ট্রেড) ক্যাডার খুবই ছোট সার্ভিস হওয়ায় একে বিলুপ্ত ও বিসিএস (শুল্ক ও আবগারি)-এ একীভূত করা হোক’।

ইন্টারনেট, সামাজিক মাধ্যম, কুরিয়ার সার্ভিসের মতো সেবা সহজলভ্য হওয়ায় বিসিএস (ডাক) সার্ভিসের গুরুত্ব অনেকটাই কমে গেছে। এজন্য এ সার্ভিসের প্রয়োজনীয়তা পরীক্ষার সুপারিশ জানিয়েছে কমিশন।

মন্ত্রণালয় কমানো

বর্তমানে মোট ৪৩টি মন্ত্রণালয় এবং ৬১টি বিভাগ রয়েছে। বিপুল এই সংখ্যা যুক্তিসঙ্গতভাবে কমিয়ে ২৫টি মন্ত্রণালয় ও ৪০টি বিভাগে পুনর্বিন্যাসের সুপারিশ করছে কমিশন। এ প্রস্তাবটি প্রতিবেদনের সংযুক্তি-৫-এ রাখা হয়েছে।

প্রাদেশিক শাসন ব্যবস্থা চালু

কমিশন বলছে, দেশের জনসংখ্যা বেড়ে সরকারের কার্যপরিধি সুবিস্তৃত হওয়ায় বর্তমান প্রশাসনিক ও স্থানীয় সরকার কাঠামো যথেষ্ঠ বলে প্রতীয়মান হয় না। এককেন্দ্রিক ব্যবস্থায় মন্ত্রণালয় পর্যায়ে খুঁটিনাটি বহু কাজ সম্পাদন করতে হয়। ক্ষমতার প্রত্যর্পণ (ডেলিগেশন) বিবেচনায় বিশাল এই জনসংখ্যার পরিষেবা ব্যবস্থা বিকেন্দ্রীকরণ এবং পুরোনো চারটি বিভাগের সীমানাকে চারটি প্রদেশে বিভক্ত ও প্রাদেশিক শাসন ব্যবস্থা চালু করা যেতে পারে।

ফলে এককেন্দ্রিক সরকারের পক্ষে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করার সুযোগ এবং রাজধানী ঢাকা মহানগরীর ওপর চাপ কমবে।

ক্যাপিটাল সিটি গভর্নমেন্ট

রাজধানী ঢাকা মহানগরীর জনসংখ্যা ও পরিষেবার ব্যপ্তি বিবেচনায় ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লির মতো ফেডারেল সরকার নিয়ন্ত্রিত ‘ক্যাপিটাল সিটি গভর্নমেন্ট’ বা ‘রাজধানী মহানগরী সরকার’ গঠনের সুপারিশ করা হয়েছে প্রতিবেদনে।

জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের মতে, ঢাকা মহানগরী, টঙ্গী, কেরাণীগঞ্জ, সাভার ও নারায়ণগঞ্জকে নিয়ে ‘ক্যাপিটাল সিটি গভর্নমেন্ট’ এর আয়তন নির্ধারণ করা যেতে পারে। অন্যগুলোর মতোই ঢাকা প্রদেশেও নির্বাচিত আইনসভা ও স্থানীয় সরকার থাকবে।

জেলা পরিষদ বাতিল ও পৌরসভা শক্তিশালী করা

স্থানীয় সরকারকে আরো সুসংহত এবং কার্যকরী করতে জেলা পরিষদ বাতিল ও পৌরসভা ব্যবস্থাকে আরো শক্তিশালীকরণের প্রস্তাব দিয়েছে কমিশন।

এতে বলা হয়েছে ‘স্থানীয় সরকারের ধাপ হিসেবে জেলা পরিষদ বহাল থাকবে কি না, সে বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন মহলে আলোচনা রয়েছে। জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান কখনোই নাগরিকদের সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হননি। কিছু জেলা পরিষদ বাদে অধিকাংশেরই নিজস্ব রাজস্বের শক্তিশালী উৎসও নেই। ফলে অধিকাংশ জেলা পরিষদ আর্থিকভাবে স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। সেহেতু জেলা পরিষদ বাতিল করা যেতে পারে। জেলা পরিষদের সহায়-সম্পদ প্রস্তাবিত সংশ্লিষ্ট প্রাদেশিক সরকারকে হস্তান্তর করা যেতে পারে’।

স্বল্পমেয়াদি পদক্ষেপ হিসেবে পৌরসভা শক্তিশালীকরণ বিষয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘পৌরসভার গুরুত্ব বিবেচনায় স্থানীয় সরকার হিসেবে একে অধিকতর শক্তিশালী করতে হবে। পৌরসভার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হবেন ওয়ার্ড কাউন্সিলারদের ভোটে। কারণ, চেয়ারম্যান একবার নির্বাচিত হলে কাউন্সিলারদের আর গুরুত্ব দেন না’।

একই কারণে এবং পেশীশক্তির ব্যবহার কমাতে একই পদ্ধতি বা ইউনিয়ন পরষদ ও জেলা পরিষদ নির্বাচনে পরোক্ষ ভোটের সুপারিশ করেছে স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশনও।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ