সংস্কার প্রস্তাব: সমালোচনা, নির্বাচনের চাওয়া এবং ঐক্যের প্রতিশ্রুতি
সংবিধান, জনপ্রশাসন, বিচার বিভাগ, নির্বাচন প্রক্রিয়া ও দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সংস্কারে গঠিত কমিশনগুলোর প্রতিবেদন বা সুপারিশমালার ওপর লিখিত মতামত জমা দিচ্ছে রাজনৈতিক দলগুলো। একদিকে অন্তর্বর্তী সরকার প্রণীত ঐকমত্য কমিশনের পদক্ষেপের সমালোচনা করছে, অন্যদিকে এই সরকারকে সফল করতে নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় সহায়তার কথা বলছেন তারা।
কিছু দল দ্রুত প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে নির্বাচন আয়োজনের দাবি জানালেও সব সংস্কারের পর ডিসেম্বরের শেষে নির্বাচনের পক্ষপাতী অন্যরা।
ঐকমত্য কমিশন বলছে, শনিবার (২২ মার্চ) সকাল পর্যন্ত ১৬টি রাজনৈতিক দলের কাছ থেকে মতামত পেয়েছেন তারা। দলগুলো হচ্ছে, লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি), খেলাফত মজলিশ, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ, জাকের পার্টি, ভাসানী অনুসারী পরিষদ, জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলন (এনডিএম), আম জনতার দল, রাষ্ট্রসংস্কার আন্দোলন, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিশ, বাংলাদেশ জাসদ, বাংলাদেশ লেবার পার্টি, আমার বাংলাদেশ পার্টি (এবি পার্টি), নাগরিক ঐক্য এবং বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন কাজ শুরু করে ১৫ ফেব্রুয়ারি। এতে সহ সভাপতি হিসেবে আছেন সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান অধ্যাপক আলী রীয়াজ। ১৩ মার্চের মধ্যে মতামত জানাতে ৩৮টি দলকে অনুরোধ জানিয়েছিল এ কমিশন।
কিন্তু এখনো পূর্ণাঙ্গ মতামত দেয়নি বিএনপিসহ ২২টি রাজনৈতিক দল। এজন্য আরও সময় চেয়েছে দলগুলো।
রোববার (২৩ মার্চ) বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদের নেতৃত্বে প্রতিনিধিদল ঐকমত্য কমিশনের সরবারহ করা স্প্রেডশিট এবং লিখিত প্রতিবেদন জমা দেবেন।
মতামত চাওয়ার প্রক্রিয়া নিয়ে অসন্তোষ
ফেব্রুয়ারিতে ড. ইউনূস রাজনৈতিক দলগুলোকে বলেছিলেন, ‘আপনারা কে কোন সংস্কার চান, সেটা লিখে দেন, আমরা ওয়েবসাইটে প্রকাশ করবো। যদি আপনি সংস্কার চান, সেটাও প্রকাশ করবো, অথবা যেটা চান না, সেটাও প্রকাশ করবো’।
এর পরই দলগুলোকে মতামত দিতে নানা সুপারিশ সম্বলিত স্প্রেডশিট সরবরাহ করা হয়।
রাজনৈতিক দলগুলো বলছে, সংস্কার প্রস্তাবগুলোতে মতামত দিতে তিনটি অপশন দেয়া হয়েছিল- একমত, একমত নই এবং আংশিক একমত। আর সংস্কার বাস্তবায়নের পদ্ধতি এবং সময়কাল উল্লেখের অপশন দেয়া হয়েছিল ছয়টি- নির্বাচনের আগে অধ্যাদেশের মাধ্যমে, নির্বাচনের আগে গণভোটের মাধ্যমে, নির্বাচনের সময় গণভোটের মাধ্যমে, গণপরিষদের মাধ্যমে, নির্বাচনের পরে সাংবিধানিক সংস্কারের মাধ্যমে এবং গণপরিষদ ও আইনসভা হিসাবে নির্বাচিত সংসদের মাধ্যমে।
শনিবার বিএনপি চেয়ারপারসনের গুলশানের রাজনৈতিক কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের পাঠানো স্প্রেডশিটে যে অপশন/পছন্দগুলোর ঘরে টিক চিহ্ন দিতে বলা হয়েছে, তাতে একটি বিষয় প্রতিভাত হয়েছে, যে বিষয়গুলো প্রস্তাবাকারে আসতে পারতো সেগুলো প্রস্তাব না রেখে লিডিং কোয়েশ্চনের আকারে হ্যাঁ, না- উত্তর দিতে বলা হয়েছে।
নিজেদের সংবাদ সম্মেলনে নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্নাও বলেন, সংস্কার কমিশনগুলো রাজনৈতিক দলগুলোর কছে পাঠানো প্রতিবেদনগুলোতে যেসব সুপারিশ উল্লেখ করেছে, জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের প্রশ্নমালায় তার বেশিরভাগ সুপারিশগুলোই অনুপস্থিত। ধরা যেতে পারে, এই ১৬৬টি প্রশ্ন গুরুত্বপূর্ণ। তবে, এই ১৬৬টি প্রশ্নে আলাদা করে রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত নেয়া থেকে এই প্রশ্ন উঠতেই পারে যে, সংস্কার কমিশনগুলো এতো পরিশ্রম, সময় এবং সম্পদ ব্যয় করে যে প্রায় ৭৫০টি সুপারিশ বা প্রস্তাব দিলো সেগুলো কি অপ্রয়োজনীয় বা গুরুত্বহীন?’।
এর সমালোচনা করলেও অন্তর্বর্তী সরকার এবং জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করেছে এলডিপি, বাংলাদেশ লেবার পার্টিসহ বেশ কিছু রাজনৈতিক দল।
মান্না বলেন, ‘নীতিগতভাবে যদিও আমরা তাদের এই ‘আগে থেকেই নিয়ে রাখা সংস্কার সিদ্ধান্তের’ সাথে একমত হতে পারি না, তবুও, শুধুমাত্র জাতীয় সংহতির কথা চিন্তা করেই আমরা তাদের এই প্রশ্নের উত্তরগুলো দিয়েছি। এতে আমরা দেখিয়েছি যে, ১০৪টি প্রশ্নে আমরা তাদের সাথে একমত, ৫১টি প্রশ্নে একমত নই এবং ১১টি প্রশ্নে আংশিক একমত’।
মির্জা ফখরুল বলেন, ‘বিএনপি মতামত দিতে যেখানে প্রযোজ্য হ্যাঁ বা না উল্লেখ করবে এবং যেখানে প্রযোজ্য নিজস্ব বক্তব্য উল্লেখ করবে। তবে বিএনপি নিশ্চিত করছে, সরকারকে সব ধরনের সহায়তা করবে’।
এলডিপির চেয়ারম্যান অলি আহমদ বলেন, ‘দ্বিধা-বিতর্ক থাকবেই। তবুও আমরা চাই, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এই বিষয়গুলোর একটা ঐকমত্য সৃষ্টি হোক। যেন দেশ নির্বাচিত সরকারের মাধ্যমে আত্মনির্ভরশীল হয়ে সমৃদ্ধির পথে এগোতে পারে’।
তবে জামায়াত, খেলাফত মজলিশ, বাংলাদেশ জাসদ এবং এবি পার্টিসহ অনেক রাজনৈতিক দলই সংস্কার প্রক্রিয়া নিয়ে কোনো বক্তব্য দেয়নি।
রাজনীতিবিদদের অবমুল্যায়ন এবং অরাজনীতিবিদদের ক্ষমতায়নের শঙ্কা
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম বলেন, ‘সাংবিধানিক কমিশনসহ (এনসিসি) বিভিন্ন সংস্কার কমিশনের সুপারিশমালায় নতুন নতুন প্রস্তাব, বিশেষত সংবিধান ও নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সুপারিশগুলো পর্যালোচনা করলে প্রতীয়মান হয় যে, রাজনীতিবিদরা অপাংক্তেয় এবং অনির্বাচিতদেরই দেশ পরিচালনার সুযোগ তৈরিই শ্রেয়’।
এর ব্যাখ্যায় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘সংস্কার কমিশনের সুপারিশমালায় সাংবিধানিক কমিশনের (এনসিসি) কথা বলা হয়েছে। এ কমিশনের এখতিয়ার, কার্যক্রমের যে বর্ণনা দেয়া হয়েছে, তাতে মনে করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে যে, অনির্বাচিতদের ক্ষমতায়নের চেষ্টা করা হয়েছে এখানে’।
‘সুপারিশগুলো আইন বিভাগ ও নির্বাহী বিভাগকে যতোটা সম্ভব অবমূল্যায়ন এবং ক্ষমতাহীন করাই উদ্দেশ্য। যার ফলশ্রুতিতে দুর্বল ও প্রায় অকার্যকর সরকার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হবে’ বলেও মন্তব্য করেন মির্জা ফখরুল।
তিনি বলেন, ‘দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন ভালোভাবে লক্ষ্য করলে খুব স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, দুদক এবং সংস্কার কমিশন উভয়েই প্রধানত আর্থিক দুর্নীতিকেই দুর্নীতি হিসেবে দেখছে। আর্থিক ছাড়াও আরো যে দুর্নীতিগুলি সমাজে আছে, সেগুলোকে প্রতিফলিত করা হয়নি। বরং জাতিসংঘের দুর্নীতি বিরোধী কনভেনশনে (ইউএনসিএসি) উল্লেখিত অনেক দুর্নীতির উল্লেখ না করাকে কৌশলে সরকারি কর্মকর্তাদের অনৈতিক কার্যকলাপকে অপরাধ হিসেবে না দেখা এবং শাস্তির আওতায় আনতে হবে বলে উল্লেখ না করায় আমরা বিস্মিত’।
২০ মার্চ জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহ সভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজের কাছে সুপারিশ জমা দিয়ে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার গণপরিষদ নির্বাচন নিয়ে বলেন, ‘আস্থাভোট ও বাজেট প্রণয়নে ৭০ ধারা অনুসারে সংসদ সদস্যরা কীভাবে ভূমিকা পালন করবেন, সে বিষয়ে আমরা বলেছি। কমনলি আমরা মেনে নেইনি, প্রভাইডলি আমরা কিছু শর্ত দিয়েছি’।
সংবিধানের মূলনীতিতে ধর্ম নিরপেক্ষতা রাখার বিষয়ে নেতিবাচক মনোভাবের কথাও জানান জামায়াতের এই নেতা।
‘কমিশনের প্রস্তাবের সঙ্গে কিছু কিছু ক্ষেত্রে জামায়াত একমত হতে পারেনি’ উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘অনেক বিষয়েই একমত হওয়া গেছে। ব্যাখ্যাসহ আমাদের বক্তব্য তুলে ধরেছি। আমরা সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনের বিষয়ে গুরুত্বারোপ করেছি। আশা করি, দ্রুত সংস্কার সম্পন্ন করে অর্থবহ নির্বাচন আয়োজনে কাজ করবে অন্তর্বর্তী সরকার’।
শনিবার সকালে জাতীয় সংসদের এলডি হলে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে বৈঠক শেষে খেলাফত মজলিসের মহাসচিব আহমদ আবদুল কাদের জানান, তারা কমিশনের ১৬৬টি প্রস্তাবের ১৪০টিতে ঐকমত্য পোষণ করছেন এবং ১০টিতে একমত হননি, আর ১৫টিতে আংশিকভাবে একমত।
‘আমরা মনে করি, প্রয়োজনীয় সংস্কার ১০ মাসেই করা সম্ভব। এটি অধ্যাদেশ জারি করে করা উচিত। বিদ্যমান সংস্কার নির্বাচনের আগেই সম্ভব’ বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
সংস্কার সনদ প্রণয়নের প্রস্তাব
‘জুলাই সনদ’- এর বিরোধিতা করলেও রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্যে এবং নির্বাচিত সরকারের বাধ্যবাধকতা তৈরিতে charter of Reforms বা ‘সংস্কার সনদ’ করার কথাও বলছে বিএনপি।
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল বলেন, ‘সংস্কারের উদ্দেশ্য হলো, জনগণের জীবনমানের উন্নয়ন, জনসাধারণের জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তা বিধান এবং জবাবদিহিতা ও আইনের শাসনের নিশ্চয়তা বিধান। সর্বোপরি দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বকে সুরক্ষিত রাখা’।
তিনি বলেন, ‘সংস্কার আগে নাকি নির্বাচন পরে, কিংবা নির্বাচন আগে নাকি সংস্কার পরে এ ধরনের অনাবাশ্যক বিতর্কের কোন অবকাশ নেই। সংস্কার চলমান প্রক্রিয়া বলে সংস্কার ও নির্বাচন প্রক্রিয়া দুটিই একই সাথে চলতে পারে। রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্যে charter of Reforms (সংস্কার সনদ) তৈরি হতেই পারে, নির্বাচিত সরকার পরবর্তীতে যা বাস্তবায়ন করবে।
আলোচনায় স্বল্প সময়ে জাতীয় ঐকমত্য চায় কমিশন
জাতীয় সংসদের এলডি হলে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে খেলাফত মজলিশের বৈঠকের শুরুতে কমিশনের সহ সভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, ‘সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে স্বল্প সময়ের মধ্যে জাতীয় ঐকমত্য তৈরি সম্ভব হবে বলে আশা করছি’।
‘আপনারা (রাজনৈতিক দল) মতামতগুলোর অনেক ক্ষেত্রে একমত পোষণ করেছেন। অনেক ক্ষেত্রে আপনাদের কিছু ভিন্নমত আছে, বক্তব্য আছে, সেগুলো আমরা শুনব। আমরা মনে করি, আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়ে জাতীয় ঐকমত্য তৈরি করতে পারব’- বলেন তিনি।
আলী রিয়াজ বলেন, ‘রাজনৈতিক দলগুলো যে মতামতগুলো জানিয়েছেন, সেই মতামতগুলোর ভিত্তিতে আমরা আলোচনাটা শুরু করব। আশা করছি, তার মধ্য দিয়ে স্বল্প সময়ের মধ্যে এক জায়গায় আসতে পারব’।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে