Views Bangladesh Logo

পুলিশ সংস্কারে দীর্ঘমেয়াদি প্রতিশ্রুতি প্রয়োজন

Kamrul  Hasan

কামরুল হাসান

দেশের পুলিশ বাহিনীর সংস্কারে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে বিস্তৃত সুপারিশমালা পেশ করেছে পুলিশ সংস্কার কমিশন। আটক-গ্রেপ্তার, তল্লাশি, জিজ্ঞাসাবাদের বিধি-প্রণিধান সংশোধন ও পুলিশের দুর্নীতি প্রতিরোধে ব্যবস্থা নিতে প্রণীত সুপারিশগুলো আইনশৃঙ্খলা বাহিনীটির প্রতি জনগণের আস্থা পুনরুদ্ধারে উল্লেখযোগ্য প্রচেষ্টার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেছে।

আমলা সফররাজ হোসেনের নেতৃত্বে এবং প্রাক্তন ও বর্তমান পুলিশ কর্মকর্তা, মানবাধিকার কর্মী এবং অন্য স্টেকহোল্ডার সমর্থিত ১০১ পৃষ্ঠার প্রতিবেদনে ১৫টি প্রধান ক্ষেত্রের অধীনে ১০৩টি সুপারিশের রূপরেখা দেয়া হয়েছে। ভুয়া ও গায়েবি মামলায় চার্জশিট দিলে তদন্তকারী কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া, মামলায় ‘অজ্ঞাতপরিচয় আসামি’ করার চর্চা বন্ধ, চূড়ান্তভাবে দোষী প্রমাণিত না হলে গণমাধ্যমের সামনে হাজির না করাসহ বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ এগুলোর অন্তর্ভুক্ত। রয়েছে চাকরিপ্রার্থীদের ক্ষেত্রে এনআইডির স্থায়ী ঠিকানা দেখে অনুসন্ধানের বাধ্য-বাধকতা বাতিল, যে কোনো ভেরিফিকেশনে পুলিশকে যুক্ত না করা ও রাজনৈতিক মতাদর্শ যাচাই না করারও সুপারিশও।

ফৌজদারি মামলা পরিচালনায় পুলিশ বাহিনীর মধ্যে বিশেষায়িত পৃথক তদন্ত ইউনিট গঠনের প্রস্তাব করেছে কমিশন, যাদের তদন্ত সংক্রান্ত ইউনিট ও থানা ছাড়া অন্যত্র বদলি করা যাবে না। এই ইউনিট তদন্তকে সুবিন্যস্ত করবে, থানার মধ্যে দায়িত্বপূর্ণদের বর্তমান ধামাচাপা দেয়ার প্রবণতাকে রোধ করবে। যদিও তদন্তকারী এবং অপারেশনাল পুলিশকর্মীদের মধ্যে অনানুষ্ঠানিক বিভাজন বিরাজমান, এই আনুষ্ঠানিক পদ্ধতির লক্ষ্য দক্ষতা বাড়ানো।

আরেকটি বড় পরামর্শ হলো, বাহিনীতে নিরপেক্ষতা ও জবাবদিহি নিশ্চিতে পুলিশ কমিশন গঠন। সংস্থাটি সাংবিধানিকভাবে সংজ্ঞায়িত না হলেও কমিশন চাইছে, অপারেশন তত্ত্বাবধান করবে এবং নিরপেক্ষতা বজায় রাখবে পুলিশ। রয়েছে জনসাধারণের তদারকি নিশ্চিতে রয়েছে সাধারণ জনগণের প্রতিনিধিদের নিয়ে টাস্কফোর্স গঠনের সুপারিশও।

অন্যদিকে পুলিশিং কৌশলগুলোতে চলমান উন্নতিতে ফোকাস করতে পুলিশ রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (সিপিআরডি) কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার সুপারিশ করা হয়েছে।

১৮৯৮ সালের ফৌজদারি আইন, ১৮৬১ সালের পুলিশ আইন ও ১৯৪৩ সালের পুলিশ রেগুলেশনস- এর পুরোনো আইনগুলো পর্যালোচনায় জোর দিয়েছে পুলিশ সংস্কার কমিশন, যা আধুনিকীকরণ, জনমুখী পুলিশিংয়ের পক্ষে কথা বলে। আইনগুলোর যথাযথ সংস্কার ও অনুসরণ এবং সময়ের ব্যবধানে আধুনিক বিশ্বে উচ্ছৃঙ্খল জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে যেসব প্রযুক্তিগত কৌশল ব্যবহার করা হয় তা বিবেচনায় নিয়ে পাঁচ ধাপে বল প্রয়োগের পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়েছে। এই ধাপগুলো জাতিসংঘ কর্তৃক বল প্রয়োগের জন্য নির্ধারিত নীতিমালা অনুসরণ করে প্রস্তুত করা হয়েছে। এতে ন্যূনতম ক্ষয়ক্ষতি এবং প্রাণহানির ঝুঁকি এড়িয়ে চলা সম্ভব হবে।

পুলিশের অপারেশন আধুনিকীকরণ ও সাইবার ক্রাইম মোকাবিলায় মূল প্রযুক্তি দল তৈরি করতে বলছে কমিশন। অপরাধের দৃশ্য বিশ্লেষণ এবং প্রমাণ পরিচালনায় দক্ষতা তৈরিতে প্রতিটি বিভাগে জাতীয় ফরেনসিক ট্রেনিং ইনস্টিটিউট (এএফআইটি), ডিজিটাল ফরেনসিক ল্যাব, স্বয়ংক্রিয় ডিএনএ ল্যাব এবং ব্যালাস্টিক ইউনিটের মতো সুবিধা স্থাপনসহ প্রযুক্তি-চালিত সংস্কারেরও আহ্বান জানানো হয়েছে প্রতিবেদনে।

পুলিশের দুর্নীতি রোধে ওয়াচডগ বা ওভারসাইট কমিটি গঠনের কথা বলা হয়েছে সুপারিশনামায়। বলা হয়েছে, প্রতিটি থানা-উপজেলায় ‘সর্বদলীয় কমিটি’ গড়ে তোলা যেতে পারে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, প্রতিটি মেট্রোপলিটন এলাকায় নিয়ন্ত্রক কার্যালয় তৈরি করা উচিত।

নারী সুরক্ষায় দৃষ্টি নিবদ্ধকারী ইউনিটগুলোতে কর্মীবাহিনী, বিশেষ করে নারী কর্মকর্তা বাড়ানোরও পরামর্শ দিয়েছে কমিশন। বর্তমানের ১৬ হাজার ৮০১ জন নারী পুলিশ কর্মী থেকে বাড়িয়ে ২৯ হাজার ২৪৮ জনের দলে পরিণত করার প্রস্তাব করে তাদের প্রতিবেদনটি।

কমিশন বলছে, ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থানে’ ছাত্র-জনতাকে হত্যা ও আহত করার জন্য দোষী পুলিশ সদস্যদের চিহ্নিত করে যথাযথ আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে শাস্তি নিশ্চিত এবং জবাবদিহি নিশ্চিতে র‍্যাবের অতীত কার্যক্রম ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ পর্যালোচনা করে এর প্রয়োজনীয়তা পুনর্মূল্যায়ন করতে হবে।

বিশ্বব্যাপী সর্বোত্তম অনুশীলন থেকে শিক্ষা নিয়ে, কমিশন বৃহৎ সমাবেশ মোকাবিলায় কসোভোর মডেল গ্রহণের সুপারিশ করেছে। এটি এমন একটি পদ্ধতি, যা জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে দায়িত্ব পালনকারী বাংলাদেশি পুলিশ কর্মকর্তাদের অনুমোদিত।

সুপারিশগুলো ব্যাপক হলেও বাস্তবায়নে উল্লেখযোগ্য বাধার মুখোমুখি। একজন পুলিশ সুপারিনটেনডেন্টের মতে, অনেক প্রস্তাব বর্তমান প্রথার সঙ্গে মিলে যায়; কিন্তু অব্যবহৃত বা অব্যবস্থাপিত থাকে। এসব বাধা অতিক্রমে রাজনৈতিক অঙ্গীকার অত্যাবশ্যক।

বাংলাদেশের ঘনবসতি এবং জটিল চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ‘স্মার্ট পুলিশিং’ এর প্রয়োজনীয়তায় জোর দিয়েছেন সাবেক অতিরিক্ত আইজিপি নাজমুল হক। তবে প্রস্তাবিত প্রতিষ্ঠান ও ইউনিট তৈরিতে রাজনৈতিক ঐকমত্য এবং বিশেষজ্ঞদের অংশগ্রহণ ছাড়া সংস্কারের সম্ভাব্যতা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেন তিনি।

কমিশনের প্রধান সফররাজ হোসেন বলেন, ‘সুপারিশগুলো বাস্তবায়নের সময়সীমার ভিত্তিতে শ্রেণিবদ্ধ করা হয়েছে। কিছু অন্তর্বর্তীকালীন সরকারই প্রণয়ন করতে পারে। অন্যগুলোর জন্য নির্বাচিত সরকারের প্রতিশ্রুতি প্রয়োজন। তিনি জোর দিয়ে বলেন, ‘দৃঢ় রাজনৈতিক ইচ্ছাই সফল সংস্কারের চাবিকাঠি’।

কমিশনের প্রচেষ্টা বাংলাদেশের পুলিশ বাহিনীকে বৈশ্বিক সর্বোত্তম অনুশীলন, স্বচ্ছতা, জবাবদিহি এবং জনগণের আস্থা বৃদ্ধির সঙ্গে সারিবদ্ধ করার ইচ্ছা প্রতিফলিত করে। লক্ষ্যগুলো অর্জনে ঐক্যবদ্ধ রাজনৈতিক প্রচেষ্টা, বিশেষজ্ঞ সংস্থান এবং পরিবর্তনে দীর্ঘমেয়াদি প্রতিশ্রুতি প্রয়োজন বলেও মনে করছে কমিশন।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ