পাইপলাইনে থাকা ৩ বিলিয়ন ডলার ঋণ আটকে যাওয়ার শঙ্কা
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণের চতুর্থ ও পঞ্চম কিস্তির অর্থ ছাড়ের বিষয়ে এরই মধ্যে একাধিক বৈঠক করেছে বাংলাদেশ; কিন্তু শর্তে ‘বনিবনা’ না হওয়ায় এই ঋণ পাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। এমনকি বাংলাদেশ যদি এই ঋণ কর্মসূচি থেকে বের হয়ে যায় তাহলে আন্তর্জাতিক ঋণদাতা সংস্থাগুলোর পাইপলাইনে থাকা ঋণের প্রায় ৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার পাওয়া নিয়েও আশঙ্কা থেকে যাচ্ছে।
জানা গেছে, আইএমএফের ঋণের বিষয়ে অর্থনৈতিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে গত এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে আইএমএফের মিশন শেষ হয়। তখন শর্তের বিষয়ে কোনো সমঝোতা হয়নি। এপ্রিলের শেষ দিকে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনে আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের বসন্তকালীন সভায় অংশ নিতে গিয়ে বাংলাদেশের অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুরসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা আইএমএফের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল একটি সূত্র জানিয়েছে, ওই বৈঠকে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য নিয়ে সমঝোতা হয়েছে। আগে আইএমএফ লক্ষ্য দিয়েছিল চলতি অর্থবছরের ৫ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা আদায় করতে হবে। এখন ৪ লাখ ৫৫ হাজার কোটি টাকা আদায়ের নতুন লক্ষ্য দেয়া হয়েছে, এতে বাংলাদেশ রাজি হয়েছে; কিন্তু বৈঠকে বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার উন্মুক্ত করার বিষয়টি অমীমাংসিত থেকে যায়। আইএমএফ চায়, বিনিময় হার পুরোপুরি বাজারের ওপর ছেড়ে দেয়া হোক। যদি অর্থনীতিতে সমস্যা হয়, তাহলে এখন যে তিন টাকা ওঠানামার সীমা আছে, তা সাত থেকে আট টাকা করা যেতে পারে। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক মনে করছে, বিনিময় হার বাজারের ওপর ছেড়ে দিলে রিজার্ভসহ বিভিন্ন খাতে চাপ সৃষ্টি হবে।
সেই চাপ মোকাবিলায় বাংলাদেশের ১০০ কোটি ডলারের স্ট্যাবিলাইজেশন ফান্ড বা স্থিতিশীলতা রক্ষা তহবিল দরকার। তবে আইএমএফ তা মানছে না। এতে ঝুলে যায় বিষয়টি। জানা গেছে, বিশ্বব্যাংকের ৫০০ মিলিয়ন, এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের (এডিবি) ৫০০ মিলিয়ন, এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকের (এআইআইবি) ৪০০ মিলিয়ন, জাইকার ২৫০ মিলিয়ন এবং আইএমএফেরই প্রায় আড়াই বিলিয়ন ডলারসহ মোট ৩ বিলিয়নের মতো অর্থ পাইপলাইনে রয়েছে। আইএমএফের ঋণ কর্মসূচি বাতিল হলে আন্তর্জাতিক এসব ঋণদাতা সংস্থার ঋণও আটকে যেতে পারে।
বিদেশি মুদ্রার সরবরাহ সংকটের মধ্যে শেখ হাসিনার সরকার ২০২২ সালে আইএমএফের কাছে ঋণ চায়। কয়েক দফা আলোচনা শেষে ২০২৩ সালের ৩১ জানুয়ারি সাত কিস্তিতে ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন (৪৭০ কোটি) ডলারের ঋণ অনুমোদন করে ওয়াশিংটনভিত্তিক আর্থিক সংস্থাটি। এরপর তিন কিস্তির অর্থও পেয়েছে বাংলাদেশ। ২০২৩ সালের ২ ফেব্রুয়ারি আইএমএফের কাছ থেকে প্রথম কিস্তির ৪৭ কোটি ৬৩ লাখ ডলার পায় বাংলাদেশ। ওই বছরের ডিসেম্বরে পায় দ্বিতীয় কিস্তির ৬৮ কোটি ১০ লাখ ডলার। আর গত বছরের জুনে তৃতীয় কিস্তির ১১৫ কোটি (১ দশমিক ১৫ বিলিয়ন) ডলার পেয়েছে। তিন কিস্তিতে আইএমএফের কাছ থেকে ২৩১ কোটি (২ দশমিক ৩১ বিলিয়ন) ডলার পেয়েছে বাংলাদেশ। ঋণের বাকি ২৩৯ কোটি (২ দশমিক ৩৯ বিলিয়ন) ডলার পাওয়ার কথা চার কিস্তিতে।
দুই পক্ষ (সরকার ও আইএমএফ) সমঝোতায় আসতে না পারায় বাকি চার কিস্তির ২ দশমিক ৩৯ বিলিয়ন ডলার পাওয়া এখন অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। বিশ্ব ব্যাংক-আইএমএফের বসন্তকালীন বৈঠকে অংশগ্রহণ শেষে গত ২৯ এপ্রিল দেশে ফিরে অর্থ উপদেষ্টা সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, বাংলাদেশ এখন আর আইএমএফ ও বিশ্ব ব্যাংকের ওপর নির্ভরশীল নয়। আইএমএফের ঋণের বাকি কিস্তিগুলোর অর্থ পেতে অন্তর্বর্তী সরকার মরিয়া নয়। তাদের সব শর্ত মেনে আমরা ঋণ নিতে চাই না। বাংলাদেশের অর্থনীতি অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় ভালো। তাই ঋণ দেয়ার বিপরীতে সংস্থাটির যে কোনো শর্ত আমরা মানব না।
তিনি আরও বলেন, আইএমএফ চায় বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় হার বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া হোক। যদি সেটি করা হয়, তবে ডলারের বিনিময় হার ১৬০-২০০ টাকা পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে। তখন পরিস্থিতি শ্রীলঙ্কা বা পাকিস্তানের মতো হতে পারে। দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে ডলারের বিনিময় হার পুরোপুরি বাজারের ওপর ছেড়ে দেয়া সম্ভব নয়। আইএমএফের সব শর্ত মানব না। আমরা আমাদের মতো করে সিদ্ধান্ত নেব। আইএমএফ কিস্তি দিলে দিবে, না দিলে নিজেদের মতো করেই বাজেট করব।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, আইএমএফের ঋণ কর্মসূচি নিয়ে এখনই বলা যাচ্ছে না। এর জন্য আরও কয়েক দিন অপেক্ষা করতে হবে। তবে আইএমএফ ঋণ কর্মসূচি থেকে বের হয়ে গেলে আপাতত তেমন কোনো সমস্যা হবে না। দীর্ঘ মেয়াদে সমস্যা হতে পারে। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, বর্তমানে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ২৬ বিলিয়ন ডলার আছে। আর আইএমএফের হিসাবে এই মজুত ২০ থেকে ২১ বিলিয়ন ডলার। ফলে এই মুহূর্তে বাংলাদেশ ঋণ কর্মসূচিতে না থাকলে কোনো সমস্যা হবে না। তবে ভবিষ্যতে আবার ঋণের প্রয়োজন হলে সমস্যা হতে পারে। বিষয়টা মাথায় রেখে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংক গত ডিসেম্বর মাসে ডলারের নির্দিষ্ট দাম ধরে আড়াই শতাংশ পর্যন্ত ওঠানামার একটি সীমা বেঁধে দেয়। তখন বলা হয়, ১২৩ টাকা পর্যন্ত ডলার লেনদেন করা যাবে। এখন ১২২ থেকে ১২৩ টাকা দরে ডলার বেচাকেনা করছে ব্যাংকগুলো। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তাদের মতে, বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে মুদ্রা বিনিময় হার পুরোপুরি বাজারের ওপর ছেড়ে দেয়া কঠিন। পুরোপুরি বাজারনির্ভর বিনিময় হার ব্যবস্থা চালু হলে যেকোনো সময় অর্থনীতিতে বড় আঘাত আসতে পারে।
২০২২ সাল থেকে বাংলাদেশে ডলারের দাম বেড়েছে। দীর্ঘদিন ধরে ডলারের দাম কৃত্রিমভাবে ধরে রাখায় ইউক্রেন যুদ্ধসহ বৈশ্বিক পরিস্থিতির কারণে হঠাৎ করে ডলারের দাম বাড়তে থাকে। আড়াই বছরে মার্কিন মুদ্রার দাম এই সময়ে ৮৫ টাকা থেকে বেড়ে ১২০ টাকায় উঠেছে। ডলারের দাম ছাড়া কৃষি, জ্বালানিসহ বিভিন্ন খাতে ভর্তুকি কমানো, রাজস্ব খাতে সংস্কার, এসব শর্তও আছে আইএমএফের। অবশ্য এসব শর্ত ধাপে ধাপে পূরণ করছে বাংলাদেশ।
জানা গেছে, স্বাধীনতার পর থেকে এখন পর্যন্ত ১৩ বার আইএমএফের কাছ থেকে ছোট-বড় ঋণ নিয়েছে বাংলাদেশ। ২০১২ সালে সর্বশেষ নেয়া বর্ধিত ঋণ-সহায়তার (ইসিএফ) ১০০ কোটি ডলার পেয়েছিল বাংলাদেশ। সব কিস্তিও পেয়েছে বাংলাদেশ। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, এর আগে কোনো ঋণ কর্মসূচিই পুরোপুরি শেষ করা সম্ভব হয়নি। সর্বশেষ ২০০৩ সালে দারিদ্র্য বিমোচন ও প্রবৃদ্ধি সহায়তা (পিআরজিএফ) কর্মসূচিতে ৪৯ কোটি ডলার পাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত সংস্কার না হওয়ায় তিন কিস্তি পাওয়ার পর বাকি তিন কিস্তি স্থগিত করেছিল আইএমএফ।
এ ছাড়া ১৯৯১ সালে আরেকটি ঋণ কর্মসূচির শর্ত হিসেবে অর্থনৈতিক সংস্কারে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমানের সঙ্গে বনিবনা না হওয়ায় মাঝপথে স্থগিত হয়। পরের ১০ বছর আইএমএফের সঙ্গে কোনো ঋণ কর্মসূচিতে যায়নি বাংলাদেশ। ১৯৭৩ সালে আইএমএফের কাছে প্রথম প্রায় ৪ কোটি ডলার ঋণ নেয় বাংলাদেশ।
বিষয়টি নিয়ে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, আইএমএফের ঋণ স্থগিত হলে বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে যে নেতিবাচক বার্তা যাবে, তাতে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কাছে বাংলাদেশ আস্থা হারাতে পারে। এ ছাড়া বিশ্বব্যাংক, এডিবির কাছে যে ২০০ থেকে ২৫০ কোটি ডলারের বাজেট সহায়তার আলোচনা চলছে, সেগুলো বন্ধ হয়ে যেতে পারে।
তিনি বলেন, আইএমএফের ঋণ কর্মসূচি অব্যাহত থাকলে ব্যাংকিং খাত, করব্যবস্থা, সরকারি ব্যয় ব্যবস্থাপনা, বিনিময় হার নীতিসহ যেসব অর্থনৈতিক সংস্কারের কথা দীর্ঘদিন ধরে বলা হচ্ছে; কিন্তু রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের কারণে করা যায়নি। আইএমএফের কর্মসূচি অব্যাহত থাকলে ওই সব সংস্কার করা তুলনামূলক সহজ হবে। এ ছাড়া বহির্বিশ্বে এক ধরনের বার্তা যাবে, বাংলাদেশের পাশে আইএমএফ আছে। নয়তো বিপরীত চিত্র দেখা দিতে পারে।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে