Views Bangladesh

Views Bangladesh Logo

ত্রাণের টাকা ব্যাংকে, ক্ষুধায় কাতর বন্যার্তরা

Manik Miazee

মানিক মিয়াজী

বৃহস্পতিবার, ১০ অক্টোবর ২০২৪

‘মনে সারাক্ষণ ভয়, একটু বৃষ্টি হলেই আঁতকে উঠি। দুইটা দুধের বাচ্চাকে নিয়ে দেড়মাসের মতো পানির উপরেই আছি। বাড়ছে সাপের ভয়ও। ডায়রিয়ায় ভুগছেন এলাকার প্রায় সবাই। তার মধ্যে খেয়ে না খেয়ে কোনোমতে বেঁচে থাকা’।

কান্নাজড়িত কণ্ঠে কথাগুলো বলছিলেন নোয়াখালী সদর উপজেলার দামদরপুর ইউনিয়নের হুগলী গ্রামের নাছিমা বেগম। ভিউজ বাংলাদেশকে তিনি জানান, চারপাশে শুধু পানি আর পানি। তিনি কিংবা তার বংশের কেউই কখনো এমন বৃষ্টি বা বন্যা দেখেননি।

নাছিমা জানান, বন্যার শুরু থেকেই কর্মহীন তার ম্বামী মোজাম্মেল হোসেন। দিনমজুর মোজাম্মেলের আয়ে চারজনের পরিবার বেশ ভালোই চলছিলো। কিন্তু বানের পানি হু হু দ্রুত বাড়তে থাকায় রাতের আঁধারে দুই সন্তানকে নিয়ে হুগলী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে হয় তাদের। সাথে যায় আরও কয়েকশ পরিবারও। সেখানে ১২ দিন বসবাসের পর পানি একটু কমলে বাড়িতে ফেরেন নাছিমার পরিবার। ততোদিনে তাদের পালিত কয়েকটি হাঁস-মুরগি মারা যায়। বাড়িতে গিয়ে দেখেন, মেঝে পর্যন্ত তখনো পানি। বাধ্য হয়েই মাসখানেক ধরে তক্তপোষের এক কোণে সন্তানদের নিয়ে বসবাস আর এক কোণে কোনোমতে করছেন রান্নাবাড়া।

শুধু নাছিমাই নন, জীবোদ্দশায় কখনোই এমন ভয়াবহ বন্যার কবলে পড়েননি নোয়াখালী-ফেনী অঞ্চলের লাখো মানুষ। তেমন একটা ত্রাণসহায়তা না পেয়ে দেড়মাস ধরে মানবেতর জীবনযাপন তাদেরও।

অথচ ২৬ আগস্ট থেকে চলমান বন্যায় দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের এসব দুর্গত মানুষের জন্যই দেশজুড়ে সরকারি- বেসরকারি পর্যায়ে ত্রাণ সংগ্রহের হিড়িক পড়েছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে এক বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনই সংগ্রহ করে প্রায় ১২ কোটি টাকা আর অসংখ্য মানুষের দেওয়া কয়েক কোটি টাকার ত্রাণসমাগ্রী। এক হাজার কোটি টাকার ত্রাণ তহবিল গড়ার ঘোষণা দেন প্রধান উপদেষ্টাও। টিএসসিতে উঠানো আট কোটি টাকা ওই তহবিলে জমা পড়লেও সে টাকা কিভাবে পুনর্বাসনে ব্যয় করা হবে, তার কোনো রুপরেখাও জানানো হয়নি।

সরকারি এসব ত্রাণের কথা শোনেনওনি নোয়াখালী-ফেনীর বন্যার্তরা। নাছিমাও জানান, আশ্রয়কেন্দ্রে কিছু ত্রাণ পেয়েছিলেন। তা দিয়ে আর স্থানীয়দের সহায়তায় ২০ দিনের মতো পার করলেও এখন প্রায় না খেয়েই কাটছে তাদের দিন। এমন পরিস্থিতিতেও প্রতিদিনই বৃষ্টি হওয়ায় পানি আবারও বাড়ছে। তিনদিন রোদ উঠলে দুই ইঞ্চি পানি কমে তো, একদিনের বৃষ্টিতে তিন ইঞ্চি বাড়ে।

‘পানি আরো বেড়ে আবারও বন্যা হলে এবার আর মরণ ছাড়া গতি নেই’- বলছিলেন নাছিমা।

নোয়াখালীর নয়টি উপজেলার মধ্যে হাতিয়া ছাড়া অন্য উপজেলাগুলোতে বন্যা হয়। বৃহস্পতিবার (১০ অক্টোবর) বন্যাকবলিত বেগমগঞ্জ, কোম্পানিগঞ্জ, কবিরহাট, সুবর্ণচর, সদর, চাটখিল, সোনাইমুড়ী ও সেনবাগ উপজেলার ৭৫ শতাংশ এলাকিই পানিতে ডুবে আছে।

জেলার সচেতন মহল বলছেন, দেশের সাধারণ মানুষ বন্যার্তদের জন্য সর্বস্ব দিয়ে সহায়তা করেছেন। এর কিছু অংশ উত্তরবঙ্গে চলমান বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তা করা হয়েছে। বাকি টাকা ব্যাংকের অ্যাকাউন্টে রাখা হয়েছে। অথচ সাধারণ মানুষ না খেয়ে আছেন।

বিষয়টি জানার পর নাছিমাও বলেন, ‘আমাদের জন্য দানের টাকা ব্যাংকে আছে। অথচ আমার বাচ্চারাই না খেয়ে আছে’। সরকার এবং কর্তৃপক্ষের কাছে পুনর্বাসন শুরু হলে সঠিক পন্থায় সহায়তার আবেদনও জানান তিনি।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন অবশ্য গণত্রাণ কর্মসূচির পূর্ণাঙ্গ অডিট ঘোষণা করেছে। তারা বলছে, মোট আয় হয়েছে ১১ কোটি ৬৯ লাখ ৮৪ হাজার ৪২০ টাকা। ব্যয় হয়েছে এক কোটি ৭৮ লাখ ৩৩ হাজার ২০৭ টাকা। দুটি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে জমা থাকা নয় কোটি ৯১ লাখ ৫১ হাজার ২১৩ টাকার মধ্যে প্রধান উপদেষ্টার ত্রাণ তহবিলে আট কোটি টাকার চেক জমা দেওয়া হয়েছে।

অন্যদিকে জাতীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের হিসেব অনুসারে, সরকারি ত্রাণভাণ্ডার থেকে নোয়াখালী-ফেনীতে ২১ হাজার ৬০০ মেট্রিকটন চাল, নগদ আট কোটি ৬৯ লাখ টাকা, সাত হাজার ৬৯০ প্যাকেট শুকনো খাবার, ৫০ লাখ টাকার গোখাদ্য এবং ৫০ লাখ টাকার শিশুখাদ্য সহায়তা দেওয়া হয়েছে।

স্মরণকালের এই ভয়াবহ বন্যায় নোয়াখালী জেলায় নারী-শিশুসহ মারা গেছেন ৭৪ জন। ৩৬ কোটি ২৫ লাখ টাকা মূল্যের ৮৮২টি গরু, মহিষ, ছাগল ও ভেড়া এবং ২৪ কোটি ৬৪ লাখ ৩০ হাজার টাকা মূল্যের দুই লাখ ৯৭ হাজার ৯১৫টি হাঁস-মুরগি মারা গেছে। মানুষের সহায়সম্পদ, রাস্তাঘাটসহ যোগাযোগ, কৃষি এবং মৎস্য ও প্রাণিসম্পদসহ সব খাত মিলে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ১৪ হাজার কোটি টাকারও বেশি।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ