পল্লী বিদ্যুতের সংস্কার
প্রাতিষ্ঠানিক ‘লক-ইন’ দূর করুন
বাংলাদেশের গ্রামীণ এলাকার ১৪ কোটি গ্রাহককে সেবা প্রদানকারী পল্লী বিদ্যুৎ সংস্থা দীর্ঘকাল ধরেই ‘লক-ইন’-এ আক্রান্ত। প্রাতিষ্ঠানিক ‘লক-ইন’ বলতে এমন একটি পরিস্থিতি বোঝায় যেখানে প্রতিষ্ঠান বা পুরো সেক্টরের মধ্যে প্রাতিষ্ঠানিক চর্চার চেয়ে ওপর মহলের হুকুমদারীই প্রধান, যার ফলে প্রতিষ্ঠানটি স্বাভাবিক গতিতে চলতে বাধাগ্রস্ত হয় এবং অব্যবস্থাপনার ফলে দরকারি পরিবর্তন বা নতুন প্রযুক্তি গ্রহণকে বাধাগ্রস্ত করে।
আজ শনিবার (৩১ মে) সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, বাংলাদেশের মোট সরবরাহ করা বিদ্যুতের ৫৭ শতাংশ সরবরাহ করে পল্লী বিদ্যুৎ। পল্লী বিদ্যুৎ বাংলাদেশের অর্থনীতিতে, বিশেষ করে শিল্প-কৃষিসহ অন্যান্য সেবা খাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ খাতে ২০ বছর ধরে সংস্কার নিয়ে আলোচনা চলছে অথচ এখনো আলোর মুখ দেখেনি। এভাবে প্রাতিষ্ঠানিক জড়তার (লক-ইন) একটা উৎকৃষ্ট উদাহরণ হয়ে দাঁড়িয়েছে পল্লী বিদ্যুতের সংস্কারের প্রশ্নটি। পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি) ও পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির (পবিস) মধ্যে বিদ্যমান সংকট নিরসনের জন্য গত ২১ মে থেকে ৭ দফা দাবিতে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে অবস্থান কর্মসূচি পালন করছে পবিস শ্রমিকরা। শুক্রবার (৩০ মে) দশম দিনের মতো নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সেবা স্বাভাবিক রেখে কর্মসূচি পালিত হলেও সরকারের পক্ষ থেকে সংকট সমাধানে দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। ফলে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন তারা।
২০২৪ সালের জানুয়ারি মাসে পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আন্দোলনের মাধ্যমে বিষয়গুলো প্রথমবারের মতো দেশবাসীর নজরে আসে। বিতরণ ব্যবস্থায় ব্যবহৃত মালামাল যে নিম্নমানের সেটি প্রকাশ্যে আনেন খোদ পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। তাদের অভিযোগ, ঝড়-বৃষ্টি হলে পল্লী বিদ্যুতের লাইন বন্ধ হয়ে যায়, লাইন পুনরুদ্ধারে সময় বেশি লাগে। এ কারণে অনেক সময় গ্রাহকের সঙ্গে পল্লী বিদ্যুতের কর্মীদের বচসা হয়। এমনকি পল্লী বিদ্যুতের কর্মীদের শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত বা মারধরের শিকার হতে হয়; কিন্তু দেশের প্রায় ১৪ কোটি মানুষের বিদ্যুৎসেবা যারা নিশ্চিত করছেন তারা এই যৌক্তিক বিষয়টি সামনে নিয়ে আসায় কর্তৃপক্ষ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট হতে পারেনি।
২০২৪ সালের ১৭ অক্টোবর পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির কর্মীরা প্রতীকী প্রতিবাদ হিসেবে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে দুই থেকে তিন ঘণ্টা বিদ্যুৎসেবা বন্ধ রাখায় পুরো বিষয়টি আবার আলোচনায় আসে। তখন ১৭ জন কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। তাদের কাউকে কাউকে ‘স্বৈরাচারের দোসর’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। লক্ষণীয় হলো, হাসিনা সরকারের আমলে যাদের ‘দেশদ্রোহী’ বা ‘উন্নয়নবিরোধী’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল তাদেরই ‘স্বৈরাচারের দোসর’ বলা হয়েছে। অর্থাৎ পল্লী বিদ্যুতের কর্মীদের ন্যায্য দাবিকে উপেক্ষা করতে উভয় সরকারের আমলেই রাজনৈতিক রং দেয়া হয়েছে।
সর্বশেষ আন্দোলনের স্ফুলিঙ্গ তৈরি হয় ২০ মে, যখন সমিতির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নির্বিচারে চাকরিচ্যুতি, সাময়িক বরখাস্ত, স্ট্যান্ড রিলিজ, হয়রানিমূলক বদলি এক মাসে আড়াই হাজার ছাড়িয়ে যায়। এর মধ্যে পল্লী বিদ্যুতের ‘অপরিহার্য’ কর্মী লাইনম্যানদের সংখ্যাই সবচেয়ে বেশি। বদলিগুলো এতই নির্বিচারে হয়েছে যে এর মধ্যে একজন মৃত ব্যক্তিকে বদলির নির্দেশ দেয়া হয়। আরইবি যদিও যুক্তি দিয়েছে, সংস্কারের অংশ হিসেবে কর্মীদের বদলি করা হয়েছে; কিন্তু বদলিগুলো যে প্রাতিষ্ঠানিক প্রয়োজনে করা হয়নি তা স্পষ্ট।
বাংলাদেশে এটা অত্যন্ত এক নিকৃষ্ট অপসংস্কৃতি চালু হয়েছে, মতের বিপক্ষে, এমনকি প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের বিষয়ে কেউ কথা বললেও তাকে ‘রাজনৈতিক ট্যাগ’ দিয়ে দেয়া হচ্ছে। এই ‘অপরায়ন’ প্রক্রিয়া থেকে বেরোতে না পারলে আমরা এগোতে পারব না। পল্লী বিদ্যুৎ সমিতিতে সত্যিই কী ধরনের সমস্যা চলছে এবং তার জন্য কী ধরনের সংস্কার জরুরি, তার জন্য সুষ্ঠু তদন্ত হতে পারে। সংস্কারের দাবিতে শ্রমিকরা মাঠে নামলে তাদের চাকরিচ্যুত করা কোনো গণতান্ত্রিক সমাজের পরিচয় নয়।
বিদ্যুৎ-সংক্রান্ত বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তাদের অনেক দাবিই যৌক্তিক। সরকারের উচিত তা সুবিবেচনায় নেয়া। ২০২০ সালে আরইবিতে বিদ্যুৎ বিভ্রাট সংক্রান্ত একটি কর্মশালার প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, উৎপাদন ঘাটতি না থাকা সত্ত্বেও শুধু পল্লী বিদ্যুৎ ব্যবস্থাপনায় নিম্নমানের মালামালের কারণে শতকরা ৬৮% বিদ্যুৎ বিভ্রাট ঘটে। যদি সত্যিই তা হয়ে থাকে তাহলে অতি সত্বর জরুরি ভিত্তিতে পল্লী বিদ্যুতের সংস্কার এবং প্রাতিষ্ঠানিক ‘লক-ইন’ দূর করা জরুরি। আমরা চাই সরকার অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির শ্রমিকদের দাবি-দাওয়াগুলো আমলে নিক।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে