জবাবদিহি নেই বিধায় বার বার আগুন লাগে
সম্প্রতি রাজধানীর বেইলি রোডের একটি ভবনে যে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে আমরা পত্রিকার প্রতিবেদন পড়ে জানতে পারি আগুনের সূত্রপাত একটি কফি রেস্তোরাঁ থেকে ঘটে। এ ছাড়া ভবনের নিচ তলাতে গ্যাস সিলিন্ডারের মজুত ছিল। ফলে অগ্নিকাণ্ডের ভয়াবহতা অনেক গুণ বেড়ে যায়। ভবনটি আবাসিকের উদ্দেশ্যে ব্যবহারের জন্য তৈরি করা হলেও পরে তা বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহারের অনুমতি দেয়া হয়। যে কোনো ভবন নির্মাণ করতে হলে জাতীয় বিল্ডিং কোড মেনে তা করতে হয়। প্রথমে ২০০৬ সালে বিল্ডিং কোড প্রণয়ন করা হয়। পরে তা ২০২০ সালে এই বিল্ডিং কোডকে হালনাগাদ করা হয়। যে ভবন নির্মিত হচ্ছে, তা কি কাজে ব্যবহৃত হবে সেই অনুপাতে বেশ কিছু শর্ত পরিপালন করতে হয়। বিল্ডিং কোডে এই শর্তাদি নির্দেশিত আছে। আবাসিক কাজে ব্যবহারের জন্য ভবন তৈরি করা হলে তার জন্য এক ধরনের ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা থাকতে হয়।
আবার যদি বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে ব্যবহারের জন্য ভবন নির্মাণ করা হয়, তার ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা থাকবে অন্যরকম। নির্মাণাধীন ভবনের ধরন বুঝে ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা নির্ধারণ করতে হয়। এবং একইসঙ্গে যে ম্যাটেরিয়াল ব্যবহার করা হবে, তার গুণগত মান নির্ণয় করা হবে। যেমন, কোনো ভবন যদি আবাসিকের উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হয়, তাহলে তাতে এক ধরনের ম্যাটেরিয়াল ব্যবহার করা যেতে পারে। আবার যদি ভবনটি বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হয়, তার জন্য অন্য ধরনের ম্যাটেরিয়াল ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে সব ক্ষেত্রেই ব্যবহৃত ম্যাটেরিয়াল যাতে ভূমিকম্প সহনীয় এবং অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত না হয় এমন হওয়া উচিত।
বহুতল বিশিষ্ট ভবনে যারা উপরের দিকে বসবাস করেন ভূমিকম্প বা অগ্নিকাণ্ডের সময় তাদের দ্রুত সময়ের মধ্যে নিচে নেমে আসার ক্ষেত্রে সমস্যা পড়তে হয়। এই সমস্যা মোকাবেলা করার জন্য ভবনে লিফটের পাশাপাশি বিকল্প এক বা একাধিক প্রশস্ত সিঁড়ি তৈরি করা যেতে পারে, জরুরি মুহূর্তে উপরের তলার মানুষগুলো নেমে আসতে পারে; কিন্তু অধিকাংশ বহুতল ভবনেই বিকল্প সিঁড়ি থাকে না। ফলে ভূমিকম্প বা অগ্নিকাণ্ডের সময় উপরের তলায় বসবাসকারি মানুষগুলো বিপদের মুখোমুখি হয়ে থাকে। ঢাকার মতো জনবহুল শহরে বিল্ডিং কোড মেনে ভবন নির্মাণ করা খুবই জরুরি; কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি, আমাদের এই শহরে যেসব বহুতল ভবন নির্মিত হচ্ছে তার বেশির ভাগই বিল্ডিং কোড সঠিকভাবে মেনে তৈরি হচ্ছে না। ফলে কোনো সময় ভূমিকম্প বা অগ্নিকাণ্ড সংঘঠিত হলে ক্ষতির পরিমাণ ভয়াবহ আকার ধারন করে। অনেকের মধ্যেই এমন একটি ধারনা বিদ্যমান যে আমার ভবনে আগুন লাগবে না; কিন্তু ভবনটি যদি ভূমিকম্প অথবা অগ্নিকাণ্ড সহনীয় করে তৈরি করতে যাই তাহলে অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় হবে। তারচেয়ে বরং সাধারণভাবে ভবন তৈরি করলে নির্মাণ ব্যয় কম হবে। কিছু মানুষ আছেন, যারা সামান্য কিছু অর্থ সাশ্রয় করতে গিয়ে নিজেদের জন্য বড় ধরনের ঝুঁকি ডেকে আনেন। অথচ কিছু বাড়তি অর্থ ব্যয় করে যদি ভবনটি ভূমিকম্প বা অগ্নিকাণ্ডে সহনীয়ভাবে তৈরি করা হতো তাহলে বসবাসকারীদের এমন ঝুঁকি বহন করতে হতো না। অনেকে আবাসিক ভবন তৈরি জন্য অনুমোদন গ্রহণ করেন; কিন্তু ভবন তৈরি হবার পর তা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের নিকট ভাড়া দেন বা নিজেরা বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করেন।
যারা ভবন তদারকির দায়িত্বে থাকেন তাদের এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব রয়েছে। ভবন তদারকির দায়িত্বে থাকা সংশ্লিষ্ট বিভাগের অজ্ঞাতসারে কেউ একটি আবাসিক ভবন অন্য কোনো উদ্দেশ্যে ব্যবহার করতে পারেন না। আবাসিক ভবনে রেস্টুরেন্ট ব্যবসায় করার তো কোনো সুযোগ নেই; কিন্তু বেইলি রোডের যে ভবনটি অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত হলো সেই বিল্ডিংয়ের নিচ তলায় অবস্থিত একটি রেস্টুরেন্ট থেকেই অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত হয়েছে বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা মিডিয়ার সামনে বলেছেন। এটা কি করে সম্ভব? তাহলে কি তারা এতদিন সংশ্লিষ্ট তদারককারি প্রতিষ্ঠানের সদস্যদের চোখে ধুলা দিয়ে ব্যবসায় পরিচালনা করছিলেন? এটাও কি সম্ভব? আমরা যদি অনুসন্ধান করি, তাহলে দেখব যে ভবনে অগ্নিকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে তার পাশের ভবনও ঝুঁকিপূর্ণ। বেইলি রোডের যে ভবনে অগ্নিকাণ্ড সংঘটিত হয় তার নিচ তলায় যে রেস্টুরেন্ট আছে, তারা গ্যাসের সিলিন্ডার ব্যবহার করত। সিঁড়িতে প্রচুর পরিমাণ গ্যাস সিলিন্ডার ছিল। আগুন লাগার পর সেই সব গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরিত হয়ে অগ্নিকাণ্ডের ভয়াবহতা আরও বাড়িয়ে দেয়।
একটি ভবনে যে কোনোভাবেই হোক আগুন লাগতেই পারে; কিন্তু আমরা যদি আগে থেকেই অগ্নি দুর্ঘটনার ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন করি, তাহলে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ অনেকটাই সীমিত রাখা সম্ভব। প্রতিটি ভবনে যদি অ্যালার্ম সিস্টেম কার্যকর থাকত, তাহলে আগুন লাগার সঙ্গে সঙ্গে মানুষ নিরাপদ স্থানে সরে যেতে পারত। ৫-৬ তলা ভবন থেকে দ্রুত নামলে ২-৩ মিনিটের মধ্যেই নিচে নেমে আসা সম্ভব। যদি অ্যালার্ম না থাকে, তাহলে তিন বা চার তলায় থাকলে আগুন লাগার খবর পেতে আমার বিলম্ব হতে পারে। ইতিমধ্যে আগুন ভয়াবহ আকারে চারদিকে ছড়িয়ে পড়তে পারে। যখন কোনো ভবনে অগ্নিকাণ্ড ঘটে তখন প্রচুর ধোঁয়ার সৃষ্টি হয়। এই ধোঁয়ার কারণে মানুষ দম বন্ধ হয়ে মারা যেতে পারে। বিভিন্ন সময় সংঘটিত অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, যত মানুষ সরাসরি আগুনে পুড়ে মারা যায়, তার চেয়ে অনেক বেশি মানুষ ধোঁয়ার কারণে দম বন্ধ হয়ে মারা যায়। কাজেই প্রতিটি ভবনে পর্যাপ্তসংখ্যক জানালা থাকা প্রয়োজন, যাতে অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত হলে সৃষ্ট ধোঁয়া বাইরে চলে যেতে পারে। রুম ডেকোরেশনের সময় প্লাস্টিক বোর্ড ব্যবহার করা হয়। এগুলো প্রচুর ধোঁয়া সৃষ্টি করে। কোনো কারণে একটি ফ্ল্যাটে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটলে এই প্লাস্টিক বোর্ড থেকে প্রচুর ধোঁয়া উদগিরণ করে। এই ধোঁয়া মানুষের মৃত্যুর জন্য অন্যতম দায়ী। কাজেই ফ্ল্যাটের অভ্যন্তরে ডেকোরেশনের সময় প্লাস্টিক বোর্ড যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলা ভালো।
বিল্ডিং এমনভাবে তৈরি করা প্রয়োজন যাতে কোনো কারণে অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত হলে উৎপত্তিস্থলেই আগুন সীমাবদ্ধ থাকে। আশপাশে ছড়িয়ে পড়তে না পারে। আজকাল অনেক ধরনের প্রযুক্তি উদ্ভাবিত হয়েছে। এসব আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে অগ্নিকাণ্ডের ভয়াবহতা থেকে অনেকটাই রক্ষা পাওয়া সম্ভব। অগ্নিকাণ্ডে সংঘটিত হবার পর প্রতিকারের চেষ্টা না করে আগুন যাতে না লাগে সে ব্যাপারে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। একই সঙ্গে ভবন তৈরির সময় এমন সব ম্যাটেরিয়াল ব্যবহার করতে হবে অগ্নিনিরোধক। প্রতিটি বহুতল ভবনে পর্যাপ্ত পরিমাণে প্রশস্ত সিঁড়ি থাকা উচিত। অগ্নিকাণ্ডের সূচনা হলে এসব সিঁড়ি দিয়ে মানুষ দ্রুত নিচে নেমে আসতে পারবে। আর সিঁড়িতে যাতে কোনো মালামাল রাখা না হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে। বেইলি রোডের যে বিল্ডিংয়ে আগুন লেগেছিল সেই বিল্ডিংয়ের লোকজন নিশ্চয়ই আগুন নেভানোর চেষ্টা করেছে। এক সময় তারা ব্যর্থ হয়ে হয়তো সরে গেছে। এই সময়ের মধ্যে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি চলে এসেছে। আগুন লাগার পর থেকে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি চলে আসার মধ্যবর্তী সময়ে ওপরের তলার মানুষজন যদি নেমে আসতে পারত, তাহলে এতগুলো জীবনহানি হতো না। সে ক্ষেত্রে শুধু সম্পদের ক্ষতি হতো।
বেইলি রোডে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ৪৬ জন মানুষের প্রাণহানি হয়েছে। এই ৪৬ জন মানুষের জীবন তো অমূল্য। এই মৃত্যুর কোনো আর্থিক মূল্যায়ন করা সম্ভব নয়। এই অগ্নিকাণ্ডে জন্য ভবন মালিকের গাফিলতিকে দায়ী করা যায়। তিনি ভবনটি যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে নির্মাণ করেননি। তিনি আবাসিক ভবন বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছেন। যারা ঢাকা শহরের বিভিন্ন ভবন তদারকির দায়িত্বে আছেন তারা তাদের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করেননি। তারা যদি তাদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতেন তাহলে এমন একটি ঝুঁকিপূর্ণ ভবন এভাবে ব্যবহৃত হতে পারত না। তিতাসের পর্যাপ্ত পরিমাণ গ্যাসের সরবরাহ না থাকায় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ব্যাপকভাবে সিলিন্ডারের গ্যাস ব্যবহার করছে। সিলিন্ডারের গ্যাস ব্যবহারের ফলে অগ্নি দুর্ঘটনা প্রায়শই ভয়াবহ আকার ধারণ করছে।
আমাদের দেশে দেখা যায়, কোনো একটি দুর্ঘটনা ঘটলে তা নিয়ে কিছুদিন হৈ চৈ হয়। তদন্ত কমিটি গঠিত হয়। তদন্ত কমিটি রিপোর্ট দিলেও জনগণ সাধারণত তা জানতে পারে না। তদন্ত কমিটি কোনো সুপারিশ প্রদান করলে তা বাস্তবায়ন করা হয় না। ফলে পুনরায় একই রকম দুর্ঘটনা ঘটে থাকে। একটি দেশের সুশাসন এবং সকল পর্যায়ে জবাবদিহি থাকলে এমনটি হতো না। আমাদের দেশের অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানেরই জবাবদিহি নেই। অভ্যন্তরীণ সুশাসনের অভাব পরিলক্ষিত হয় সর্বস্তরে। ফলে কেউ অপরাধ করলেও তার কোনো শাস্তি হয় না। এই মুহূর্তে আমাদের জরুরি ভিত্তিতে যে কাজটি করা প্রয়োজন তাহলে রাজধানীর ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলো চিহ্নিত করে তাতে নোটিশ টাঙিয়ে দিতে হবে ‘এই ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ’ তাহলে মানুষ এসব ভবন ভাড়া নেয়ার ক্ষেত্রে সাবধানতা অবলম্বন করবে। এতে দুর্ঘটনা অনেকটাই কমে যাবে। যেসব ভবন বেশি মাত্রায় ঝুঁকিপূর্ণ সেগুলো বন্ধ করে দেয়া যেতে পারে। কারণ ভবনের চেয়ে মানুষের জীবনের মূল্য অনেক বেশি।
অগ্নিকাণ্ডে প্রতি বছর দেশে কি পরিমাণ আর্থিক ক্ষতি হয় তার সঠিক হিসাব বের করা খুবই কঠিন। অগ্নিকাণ্ডে প্রায়শই মানুষের প্রাণহানি ঘটছে। মানুষের প্রাণহানির বিষয়টি তো কোনো আর্থিক মানদণ্ডে বিচার করা যাবে না। পরিবারে উপার্জনক্ষম ব্যক্তিটি যদি কোনো দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান তাহলে সেই পরিবারটি আর্থিকভাবে নিঃস্ব হয়ে পড়ে। কোনো কোনো সূত্র দাবি করে প্রতি বছর আমাদের দেশে যেসব অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে তাতে যে আর্থিক ক্ষতি হয় তার পরিমাণ ৩০০ কোটি টাকার বেশি এই হিসাব পূর্ণাঙ্গ বলে মনে হয় না। ক্ষতির পরিমাণ আরও বেশি হবে।
লেখক: অধ্যাপক, সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্ট, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে