পুনর্বিবেচনার মাধ্যমে বিটিআরএ’র সুনির্দিষ্ট আইনি নীতিমালা প্রয়োজন
বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন রেগুলেটরি অ্যাক্টের (বিটিআরএ) সংশোধনের প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। সংগঠনটি গঠিত হয় ২০০১ সালে। আইনগত অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হলে এর আইনগুলো বোঝা জরুরি; কিন্তু, এর অত্যধিক আইনি সংজ্ঞা বোঝা একটা কঠিন ব্যাপার। বর্তমান খসড়াটিও আগের সমস্যাগুলো জিইয়ে রেখেছে। এসব সমস্যা টেলিযোগাযোগ ও নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঐতিহ্যগতভাবেই বিটিআরএ-এর নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতার ক্ষেত্র ছাড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতা রয়েছে। আমরা জানি, টেলিযোগাযোগ নিজেই আলাদা একটি ক্ষেত্র, এখানে অন্যান্য যোগাযোগমাধ্যম যুক্ত হলে টেলিকমের প্রকৃতি নিয়ে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়।
নিঃসন্দেহে টেলিযোগাযোগ প্রযুক্তি প্রাচীন ডাক ও টেলিগ্রাফ পরিষেবার চেয়ে অনেক শক্তিশালী, টেলিযোগাযোগ তাৎক্ষণিক যোগাযোগের সুযোগ দেয়, তাই টেলিকমের নিয়ন্ত্রক ভূমিকা কেবল এর ওপরই নিবদ্ধ থাকা উচিত। এই নামে পরিচিত অন্যান্য মাধ্যমগুলো আর এর সঙ্গে জড়ানো উচিত না। ভোক্তাদের আইনি-সুবিধা দেয়ার জন্য যারা এই আইনগুলো তৈরি করেছেন, নিয়ন্ত্রক তদারকি বেড়ে যাওয়ার ফলে এগুলো নিয়ন্ত্রণ কঠিন হয়ে পড়েছে, আইনি বিভ্রান্তি দেখা দিয়েছে। ধরা যাক রাষ্ট্রদ্রোহের কথা, যে কোনো জাতির জন্যই এটা একটি বড় অপরাধ। রাষ্ট্রদ্রোহমূলক বক্তব্য প্রচার বা মানহানির বিবৃতি দেয়া নিঃসন্দেহে বেআইনি। এখন দেশদ্রোহ বক্তব্য বা তথ্য ডাক পরিষেবায় পাঠানো যদি দোষ না হয়, তাহলে টেলিকম নেটওয়ার্ক অপারেটরদের তাদের নেটওয়ার্কে প্রেরিত এই ধরনের বিষয়বস্তুর জন্য দায়ী করা অযৌক্তিক।
একইভাবে, নকল বা চোরাচালান পণ্য বিক্রি একটি ফৌজদারি অপরাধ, তবে এটি দণ্ডবিধি বা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের আওতাভুক্ত। খুচরা বিক্রেতারা তাদের পরিষেবা প্রচার বা যোগাযোগের জন্য যে প্ল্যাটফর্মগুলো ব্যবহার করে, তার দিকে মনোযোগ দেয়া নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানের কাজ নয়। আজকের দুনিয়ায় শিক্ষা, খুচরা বাজার আর বিনোদন জগৎসহ জীবনের সবই অনলাইনে পরিব্যপ্ত। টেলিকম আইন আর বিধান দিয়ে সব সেক্টরের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর জন্য কঠিন। এই বাড়তি নীতিমালাগুলো নাগরিকদের একদিকে যেমন জরুরি প্রয়োজনীয় সুরক্ষা থেকে বঞ্চিত করে, অন্যদিকে তাদের ওপর মাত্রাতিরিক্ত রক্ষণাবেক্ষণের খরচ চাপিয়ে দেয়। টেলিকম লিখিত আইনগুলো তাই নির্দিষ্ট এখতিয়ারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকা উচিত। এই পরিষেবাগুলোতে কী ধরনের তথ্য আর সেবা দেয়া হবে, তার পরিবর্তে নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোকে অবকাঠামো উন্নয়ন আর ট্রান্সমিশন সুবিধার দিকেই মনোযোগ দেয়া উচিত।
বিটিআরএ-এর মূল উদ্দেশ্য হওয়া উচিত সব নাগরিকের অধিকার ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, তারা যেন সবচেয়ে কম খরচে টেলিযোগাযোগ সেবা পেতে পারেন তা নিশ্চিত করা। এই শিল্পে বিনিয়োগকারীদের অযৌক্তিক হস্তক্ষেপ, ব্যাঘাত এবং বাধা থেকেও রক্ষা করবে বিটিআরএ। আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ছাড়া আর কারও দ্বারা যেন প্রতিষ্ঠানটি প্রশ্নের সম্মুখীন না হয়, তাও দেখতে হবে। এই পুনর্বিবেচনার সময়টি বিটিআরএ-এর ফোকাসকে পুনরায় সংগঠিত করার একটি সুযোগ দিয়েছেন। এটি তার সঠিক এখতিয়ারের মধ্যে থাকে। অত্যধিক আইনি তথ্যের ভার এড়িয়ে যায়। এখন এটা নিশ্চিত করতে হবে যে, বিটিআরএ যেন এর সঠিক এখতিয়ারের মধ্যে থাকে এবং যোগাযোগের সুবিধা বাড়ায়। পরিধি বেড়ে যাওয়ার কারণে এর আইনের সংখ্যাও বেড়েছে, আর আইনের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার কারণে এর কার্যকারিতা কমেছে এবং অপ্রয়োজনীয় আইনি জটিলতার সৃষ্টি করেছে।
উদাহরণস্বরূপ, এখন অটিটি পরিষেবাগুলোও টেলিকম কাঠামোর অধীনে, যা অনেকটা আলাদা ক্ষেত্রই বলা চলে। অটিটি পরিষেবার মধ্যে রয়েছে স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্ম, সোশ্যাল মিডিয়া এবং অন্যান্য ইন্টারনেটভিত্তিক সুবিধা। টেলিকম নেটওয়ার্কে মধ্যেই অটিটি স্বাধীনভাবে কাজ করে; কিন্তু অটিটির জন্য এখন পৃথক নিয়ন্ত্রক সংস্থা প্রয়োজন, যা তাদের অন্যান্য চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে সাহায্য করবে, আরও কর্মক্ষম ও গতিশীল করতে সাহায্য করবে। একইভাবে এখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, রোবোটিক্স এবং অটোমেশনের অগ্রগতি নতুন শিল্প তৈরি করেছে এবং অন্যান্য সব মাধ্যমের সঙ্গে মিলে গেছে। এই প্রযুক্তিগুলোরও নিজস্ব নীতি, নিরাপত্তা ও গোপনীয়তা আছে। অর্থনীতিতে এগুলো নির্দিষ্ট প্রভাব ফেলে। টেলিকম ছাতার অধীনে এগুলোর পরিচালনা এগুলোর স্বতন্ত্র নিয়ন্ত্রক প্রয়োজনীয়তাকে উপেক্ষা করে। এগুলোর নিজস্ব উদ্ভাবনকে বাধা দেয়।
একটি শক্তিশালী টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রক কাঠামোর প্রকৃত অর্থে নেটওয়ার্ক পরিকাঠামো উন্নত করার দিকেই ফোকাস করা উচিত। ন্যায্য প্রতিযোগিতার প্রচার, ভোক্তা সুরক্ষা নিশ্চিত করা এবং বিনিয়োগের সুবিধা প্রদান করার দিকেই এর সর্বোচ্চ মনোযোগ দেয়া দরকার। এর মধ্যে রয়েছে নেটওয়ার্ক নির্ভরযোগ্যতা, ডাটা নিরাপত্তা এবং পরিষেবার মানের জন্য মান নির্ধারণ করা। সেইসঙ্গে এমন একটি পরিবেশ তৈরি করতে হবে যেখানে টেলিকম অপারেটররা অপ্রয়োজনীয় আমলাতান্ত্রিক বাধা ছাড়াই উন্নতি করতে পারে। সংশোধিত আইনটি বাড়তি সমস্যাগুলো সমাধানের জন্য অন্যান্য নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর সঙ্গে সহযোগিতা করবে। অন্যান্য সংস্থাগুলোকেও সমান অগ্রাধিকার দেবে। উদাহরণস্বরূপ, বিটিআরএ ই-কমার্স রেগুলেশন বা ডিজিটাল বিষয়বস্তু নীতিতে তথ্য মন্ত্রণালয় ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কাজ করতে পারে।
এই ধরনের সহযোগিতামূলক প্রচেষ্টা এখতিয়ারগত দ্বন্দ্বের সমস্যাগুলো এড়িয়ে নিয়ন্ত্রক প্রক্রিয়াগুলোকে প্রবাহিত করতে পারে এবং স্টেকহোল্ডারদের সুস্পষ্ট নির্দেশনা প্রদান করতে পারে। পরিশেষে এটাই বলতে চাই, টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রক কাঠামোর লক্ষ্য হওয়া উচিত আরও গতিশীল, কেন্দ্রীভূত। নিজের সীমানা ছাড়িয়ে এটি যেন প্রযুক্তিগত অগ্রগতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে সক্ষম হয়। বিটিআরএ-এর আজ্ঞাপত্র টেলিকমিউনিকেশন অবকাঠামো এবং পরিষেবাগুলোর মধ্যে সীমাবদ্ধ থেকেই আরও স্পষ্ট হতে হবে। একমাত্র এর নিজস্ব কার্যকলাপ বজায় রেখেই আমরা এই আইনের মাধ্যমে আরও সুসংগত এবং কার্যকর নিয়ন্ত্রক পরিবেশ তৈরি করতে পারি।
উপসংহারে এ কথাই বলা যায়, বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন রেগুলেটরি অ্যাক্টের পুনর্বিবেচনার মাধ্যমে অতীতের বাড়তি নীতিগুলো সংশোধন করা জরুরি। এর কেন্দ্রীভূত, দক্ষ নিয়ন্ত্রক কাঠামো প্রতিষ্ঠার এটি একটি বড় সুযোগ। বিটিআরএকে তার মূল লক্ষ্যে মনোনিবেশ করতে হবে। খরচ কমিয়ে উন্নত টেলিযোগাযোগ প্রযুক্তি সরবরাহ করতে হবে। এ শিল্পের বিনিয়োগ রক্ষা করাসহ, বড় বড় সমস্যা সমাধানের জন্য অন্যান্য নিয়ন্ত্রক সংস্থার সঙ্গে সহযোগিতা করতে হবে। লক্ষ্যবস্তু নির্ধারণেই মাধ্যমেই আমরা নিশ্চিত করতে পারব যে, বাংলাদেশের টেলিযোগাযোগ খাত কতটা বিকাশ লাভ করবে। এর বিকাশ মানে ডিজিটাল যুগে টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থার উদ্ভাবন ও প্রবৃদ্ধি বাড়ানো।
লেখক: পাবলিক পলিসি অ্যাডভোকেট।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে