রিকতা আখতার হোক আমাদের আত্মবিশ্বাসের শক্তি
‘মানুষ ধ্বংস হয়ে যেতে পারে; কিন্তু পরাজিত হতে পারে না,’ কথাটা বিশ্ববিখ্যাত লেখক আর্নেস্ট হেমিংওয়ের। রিকতা আখতার হয়তো হেমিংওয়ের ‘ওল্ড ম্যান এন্ড দ্য সি’ উপন্যাসটা পড়েননি, এই অসামান্য কথাটা কখনো শুনেননি; কিন্তু জীবনসংগ্রামের ধর্মে, মাতৃত্বের অপরিসীম শক্তির প্রেরণায় তিনি সেটাই প্রমাণ করলেন।
বাকপ্রতিবন্ধী সন্তানকে তিনি স্কুলে ভর্তি করিয়েছিলেন। প্রথমে এখান থেকেই তার লড়াই শুরু। এমনিতেই আমাদের সমাজে দেখা যায় সন্তান একটু বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন হলে অনেক বাবা-মা তাকে স্কুলে দিতে চান না। আর রিকতা আখতার যে অঞ্চলে থাকেন, চিলমারীর এক প্রত্যন্ত অঞ্চলে, সেখানে অনেক স্বাভাবিক সন্তানকেও অনেকে স্কুলে দেন না, সেখানে রিকতা আখতার তার বাকপ্রতিবন্ধী মেয়ে তানভীন দৃষ্টি মণিকে নিয়ে সরকারি প্রাথমিক স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিলেন। কিছুদিন পর স্কুল থেকে জানানো হলো এই মেয়েকে স্কুলে পড়ানো যাবে না।
বাধ্য হয়ে রিকতা আখতার মেয়ের স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দেন; কিন্তু স্কুলে যেতে না পেরে দৃষ্টি মণি কান্নাকাটি করে। সমবয়সীদের স্কুলে যেতে দেখে নিজের হাত-পা কামড়ায়। মেয়ের দুঃখ দেখে রিকতা আখতার আবার স্কুলে গিয়ে শিক্ষকদের অনেক অনুরোধ করেন; কিন্তু কোনো অনুরোধেই কাজ হয় না। শিক্ষকরা কিছুতেই রাজি হন না দৃষ্টি মনিকে স্কুলে পড়াতে। প্রতিবন্ধী মেয়েকে পড়াতে চান বলে তাকে গালাগালিও করেছেন।
মনের দুঃখে ভাবতে থাকেন কী করবেন? রিকতা আখতা কুড়িগ্রামের চিলমারী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের নার্স। একদিন স্বামীর সঙ্গে পরামর্শ করেন। স্বামী আবু তারিক তাকে এক খণ্ড জমি দেন। সেই জমিতে নিজের নামে একটি প্রতিবন্ধী স্কুল প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন রিকতা আখতার। অনেকেই তাকে নিরুৎসাহিত করেন। অনেকে বোঝানোর চেষ্টা করেন, এই গহীন গ্রামে কে আসবে তার প্রতিবন্ধী সন্তানকে পড়াতে; কিন্তু রিকতা আখতার তার লক্ষ্যে অবিচল। ২০০৯ সালে একটি টিনের ঘর তোলেন। স্কুলের নাম দেন- ‘রিকতা আক্তার বানু লার্নিং ডিজেবিলিটি স্কুল।’
স্কুল প্রতিষ্ঠার পর দেখা গেল অন্য বিপত্তি। শিক্ষার্থী পাওয়ার চেয়েও বড় সংকট হলো শিক্ষক পাওয়া। প্রতিবন্ধী শিশুদের কেউ পড়াতে রাজি নন। নিজের দেবরকে রিকতা আখতার ভালো করে বোঝালেন। দেবর তার ব্যাকুলতা দেখে পড়াতে রাজি হলেন। দেবর শিক্ষক হিসেবে যোগ দেবার পর আরও কিছু শিক্ষক পেলেন। প্রথম বছরেই ৬৩ জন শিক্ষার্থী পেয়ে গেলেন; কিন্তু সেখানেও তো লড়াই কম নয়। দূর দূর অঞ্চল থেকে প্রতিবন্ধী শিশুরা কীভাবে স্কুলে আসবে? রিকতা আখতার শিশুদের নিয়ে আসার জন্য ভ্যানের ব্যবস্থা করে দিলেন।
এখন সেই স্কুলে শিশু থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত ২৯৪ শিক্ষার্থী আছে। ২০২০ সালে বিদ্যালয়টি এমপিওভুক্ত হয়। আধাপাকা ভবনের স্কুলটিতে এখন শিক্ষক আছেন ২১ জন। রিকতা এখন স্কুলের ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি। এতটুকু রিকতা আখতারের একার লড়াই-সংগ্রামের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস। এক সপ্তাহ আগেও অনেকে অনেকে তার নাম জানতাম না, তার সম্পর্কে কিছু জানতাম না, তার লড়াইয়ের গল্প জানতাম না।
এর আগেও সংবাদ মাধ্যমে তাকে নিয়ে কিছু প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে; কিন্তু তা আরও অনেক খবরের ভিড়ে নিশ্চয়ই অনেকের চোখে পড়েনি; কিন্তু আজ রিকতা আখতার এমনই ঔজ্জ্বল্যে আবির্ভূত হলেন যে, তার দিকে আরও কারও দৃষ্টি না পড়ে পারে না। আজ বাংলাদেশের অনেক মানুষের সঙ্গে পৃথিবীর অনেকেই রিকতা আখতার বানুর নাম জানেন। এর কারণ বিবিসির ২০২৪ সালের ১০০ নারীর তালিকায় স্থান পেয়েছেন রিকতা আখতার। এটা শুধু রিকতা আখতারের জন্য নয়, পুরো বাংলাদেশের জন্যই একটা গর্বের বিষয়।
বিবিসি ২০২৪ সালের জন্য বিশ্বের ১০০ জন অনুপ্রেরণাদায়ী ও প্রভাবশালী নারীর তালিকাটি গত মঙ্গলবার প্রকাশ করেছে। পাঁচটি বিভাগে (ক্যাটাগরি) ১০০ নারীকে বেছে নেওয়া হয়েছে। বিভাগগুলো হলো জলবায়ু কর্মী; সংস্কৃতি ও শিক্ষা; বিনোদন ও ক্রীড়া; রাজনীতি ও অ্যাডভোকেসি এবং বিজ্ঞান, স্বাস্থ্য ও প্রযুক্তি। বিজ্ঞান, স্বাস্থ্য ও প্রযুক্তি বিভাগে স্থান পেয়েছেন বাংলাদেশের রিকতা বানু। এ তালিকায় রয়েছেন শান্তিতে নোবেলজয়ী নারীসহ নভোচারী, অলিম্পিক অ্যাথলেট, জলবায়ুকর্মী, লেখকসহ আরও অনেকে। বিজ্ঞান, স্বাস্থ্য ও প্রযুক্তি বিভাগে স্থান পেয়েছেন বাংলাদেশের রিকতা আখতার বানু।
বিবিসির শত নারীর তালিকায় স্থান পেয়ে রিকতা আখতার বানু সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘মেয়ের কারণেই আজ বিবিসির শত নারীর তালিকায় স্থান পেয়ে সম্মানিত হয়েছি। আমি আপ্লুত। এ কৃতিত্ব আমার একার নয়। এটা বিবিসি পরিবার, সংবাদকর্মীসহ আমার কাজে উৎসাহ দেয়া সবার।’ তিনি আরও বলেন, যার ঘরে প্রতিবন্ধী সন্তান আছে, তিনি ছাড়া অন্য কেউ আমাদের যন্ত্রণা বুঝবেন না।
বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন সন্তান যাদের আছে তারা জানেন ওই বিশেষ সন্তানটির প্রতি কতটা যত্নশীল হতে হয়। সারাক্ষণই তাকে বিশেষ যত্নে রাখতে হয়। একেক বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুর যত্ন একেকরকম। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে একজন বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন সন্তানের দেখাশোনার জন্য বাবা-মা বা কারও না কারও সেই শিশুর সঙ্গে সার্বক্ষণিকভাবে জড়িত থাকতে হয়। তাদের শিক্ষা, ট্রেনিং, যত্নের জন্য অনেক খরচ আছে।
স্বাভাবিক একটি সন্তান বড় হয়ে হয়তো বাবা-মার অবলম্বন হন, সে ক্ষেত্রে বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুকে যেহেতু সারাজীবন শিশুর মতোই থেকে যায়, তাই বাবা-মাকে তাদের লালন-পালন করতে হয় সারাজীবন। অনেকক্ষেত্রে সেই বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুকে যদি দেখার মতো কেউ না থাকে. অনেক বাবা-মা এমনো কামনা করেন তাদের মৃত্যুর আগেই যেন সেই সন্তানটির মৃত্যু হয়। এটি একটি অত্যন্ত কষ্টকর বিষয়। বাংলাদেশে এমন শিশুদের জন্য তেমন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বা সেবাকেন্দ্র এখনো তেমন গড়ে ওঠেনি।
তাই ব্যক্তি উদ্যোগেই অনেককে এসব স্কুল প্রতিষ্ঠা করতে হয়, পরিচালনা করতে হয়। সেই জায়গাতে রিকতা আখতার এক অনন্য উদাহরণ। তিনি শুধু নারীদের জন্য নন, সব মানুষের জন্যই এক বিশাল অনুপ্রেরণা। এটা শুধু একটা দেশের গর্বের ব্যাপার নয়, এটা সব মানুষের জন্যই এমন এক শক্তির ব্যাপার, যা যে কোনো প্রতিবন্ধকতায় আমাদের নতুন করে বাঁচতে ও লড়াই করতে সাহস জোগায়।
রিকতা আখতার সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, তার লড়াই এখনো শেষ হয়নি। তিনি বলেন, ‘এখনো আমাদের সমাজে প্রতিবন্ধী শিশুদের বৈষম্যের চোখে দেখা হয়। সমাজ থেকে প্রতিবন্ধী শিশুদের প্রতি সামাজিক বৈষম্য যেদিন শেষ হবে; এসব শিশুরা যেদিন স্বাভাবিকভাবে সমাজের সবার সঙ্গে হাসিমুখে চলাফেরা করার সুযোগ পাবে সেদিন একজন প্রতিবন্ধী শিশুর মা হিসেবে আমার যুদ্ধের শেষ হবে।’
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে