Views Bangladesh

Views Bangladesh Logo

বেশিরভাগ নিত্যপণ্যের দাম ঊর্ধ্বমুখী, খাদ্য মজুদেও ঘাটতি

Mahedi Hasan Murad

মেহেদী হাসান মুরাদ

রবিবার, ৮ ডিসেম্বর ২০২৪

স্বাভাবিক দাম নিয়ন্ত্রণে নিত্যপ্রয়োজনীয় ছয়টি পণ্যের শুল্ককর ছাড় দিয়েছে সরকার। তবে শুল্কছাড়ের দেড় মাস পার হলেও আমদানি তেমন একটা বাড়েনি। ফলে দু-একটির দাম কিছুটা কমলেও বেশিরভাগ পণ্যের দাম এখনো চড়া। এদিকে, দেশে চাল ও গমের অভ্যন্তরীণ সংগ্রহ উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেছে, কমেছে খাদ্যশস্য আমদানিও। ফলে সরকারি গুদামে খাদ্যের মজুদ কমে আসছে।

তবে আমদানিকারক ও ব্যবসায়ীরা বলছেন, আমদানির অনুমতি দেয়া ও শুল্ককর কমানোর সুফল হলো, বাজার স্থিতিশীল হয়েছে। খাদ্য মজুদের ঘাটতিতে সতর্ক করে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অভ্যন্তরীণ সংগ্রহের ধীরগতি এবং আমদানি কমায় দেশের খাদ্যনিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা রয়েছে। পরিস্থিতির দ্রুত উন্নতি না হলে বাজারে চালের দাম বাড়তে পারে, যা সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রায় বড় ধরনের প্রভাব ফেলবে।

খাদ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, ২৭ নভেম্বর সরকারি গুদামে মজুদ ছিল ১১ লাখ ৬৭ হাজার টন খাদ্যশস্য। কিন্তু ৩ ডিসেম্বর তা কমে দাঁড়িয়েছে ১০ লাখ ৯০ হাজার টনে। অর্থাৎ, মাত্র পাঁচ দিনে ৭৭ হাজার টন বা দিনে গড়ে ১৫ হাজার টনেরও বেশি খাদ্য মজুদ কমছে। অথচ দৈনিক সংগ্রহ হচ্ছে মাত্র ১ হাজার ৭১৪ টন। অথচ চার মাস আগেও সরকারি গুদামে খাদ্যশস্যের মজুদ ছিল প্রায় ১৮ লাখ টন, যা বর্তমানের প্রায় দ্বিগুণ। অর্থাৎ, এই সময়ে খাদ্যের মজুত কমেছে আট লাখ টন।

বর্তমান মজুদের মধ্যে চাল রয়েছে ৬ দশমিক ৬৯ লাখ টন, গম ৪ দশমিক ২০ লাখ টন এবং ধান মাত্র ১ হাজার টন।

চলতি আমন মৌসুমে ১০ লাখ টন ধান, চাল ও গম সংগ্রহের লক্ষ্য ঠিক করেছে সরকার। তবে ১৭ নভেম্বর থেকে ৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত ১৫ দিনে সরকারি গুদামে সংগ্রহ হয়েছে মাত্র ২৪ হাজার টন, যা দিনে গড়ে ১ হাজার ৭১৪ টন। অথচ দৈনিক সংগ্রহ হওয়ার কথা ১১ হাজার টনেরও বেশি। এই ধীরগতিতে নির্ধারিত সময়ে লক্ষ্যমাত্রা পূরণ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

সংগ্রহের গতি কমের কারণ সম্পর্কে তেমন কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি মন্ত্রণালয়ের সংগ্রহ বিভাগের কর্মকর্তারা। সংগ্রহ চালিয়ে যাচ্ছেন বলে জানিয়েছেন তারা। দেশের খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিতে মাসে গড়ে ৫ লাখ ৫২ হাজার টন খাদ্য আমদানি করা প্রয়োজন। তবে চলতি অর্থবছরে আমদানির গতি উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে মোট ৬৬ দশমিক ২৮ লাখ টন খাদ্য আমদানি হয়েছে, যার পুরোটাই গম। চাল আমদানির হার খুবই কম।

খাদ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুসারে, গত অর্থবছরে সরকারিভাবে কোনো চাল আমদানি হয়নি। তবে ২০২২-২৩ অর্থবছরে ১০ লাখ ৫৬ হাজার টন চাল আমদানি হয়েছিল। চলতি বছরের প্রথম পাঁচ মাসে আমদানি হয়েছে মাত্র ২২ লাখ ৬২ হাজার ২২০ টন খাদ্য, যা মোট চাহিদার ৩১ শতাংশ। বেসরকারি পর্যায়ে চাল আমদানি হয়েছে মাত্র ২৩ হাজার ৩১০ টন, যাও প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম।

খাদ্য মন্ত্রণালয় বলছে, বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগের কিছু নেই। মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মাসুদুল হাসান বলেন, ‘আমন মৌসুমে ফলন ভালো হয়েছে। নির্ধারিত সময়ে লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হবে বলে আমরা আশাবাদী’। তবে খাদ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুসারে, আগামী জুলাই নাগাদ সরকারি গুদামে ১১ লাখ টন খাদ্যের ঘাটতি দেখা দিতে পারে। সরকার চাল আমদানিতে শুল্ক তুলে দেয়ার পরও বেসরকারি আমদানিকারকদের অনীহা এবং বৈশ্বিক বাজারের উচ্চমূল্যে আমদানি আশানুরূপ হয়নি। এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় দ্রুত পদক্ষেপ নেয়া জরুরি। বিশেষ করে চালের আমদানি বাড়িয়ে খাদ্য মজুদের ঘাটতি পূরণ করতে হবে।

বিশ্লেষকরাও বলছেন, আমদানির এই ধীরগতি দেশকে খাদ্য মজুদের ঘাটতিতে ফেলতে পারে, যার প্রভাব বাজারে সরবরাহের চাপ বাড়াবে এবং উচ্চ মূল্যস্ফীতি আরও তীব্র হতে পারে। এখনই আমদানি বাড়ানোর উদ্যোগ না নিলে রোজায় সরবরাহে অনিশ্চয়তা থাকতে পারে বলেও হুঁশিয়ার করেন তারা।

কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. জাহাঙ্গীর আলম খান বলেন, বর্তমান সরকারি মজুদ কোনোভাবেই পর্যাপ্ত নয়। সরকারের উচিত, দ্রুত আমন সংগ্রহের গতি বাড়ানো। কমপক্ষে ১৫ লাখ টন চাল সংগ্রহ ও মজুদ করতে হবে। আগামী মার্চে পবিত্র রমজান মাস শুরু হবে। তাই শুল্ককর কমানোর পাশাপাশি রোজার পণ্যের আমদানি বাড়াতে ঋণপত্রের শর্ত শিথিল করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

চাল

চালের আমদানি বাড়াতে আমদানি শুল্ক ২৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১৫ শতাংশ, রেগুলেটরি শুল্ক ২৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে পাঁচ শতাংশ এবং পাঁচ শতাংশ আগাম কর সম্পূর্ণ প্রত্যাহার করেছে সরকার; কিন্তু সরকার প্রায় ১৫ লাখ মেট্রিক টন চাল আমদানির অনুমতি দিলেও আমদানি হয়েছে মাত্র ১৫ হাজার মেট্রিক টন। এতে গত একমাসে বাজারে মোটা চালের দাম কেজিতে দুই টাকা কমলেও মাঝারি ও সরু চালের দাম তিন থেকে চার টাকা বেড়েছে। বর্তমানে খুচরা পর্যায়ে প্রতি কেজি পাইজাম ও মিনিকেট ৭০ টাকা, বেথি ৬৫ টাকা, কাটারিভোগ ৮৫ টাকা এবং আটাইশ ৬২ দশমিক ৬৪ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

চট্টগ্রাম চাল মিল মালিক সমিতির সভাপতি ফরিদ উদ্দিন আহমদ বলেন, চাল আমদানি কমের কারণ, রপ্তানিকারক দেশে দাম বেশি এবং দেশে ডলারের মূল্য বৃদ্ধি। ফলে শুল্ক কমিয়েও চাল আমদানি লাভজনক হচ্ছে না।

চাল আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান আফসানা ট্রেডিংয়ের স্বত্বাধিকারী ওমর আজম বলেন, আমদানিতে প্রতি কেজি ব্যয় দাঁড়াচ্ছে ৫৫ টাকার মতো; কিন্তু বাজারে কেজিতে মোটা চালের দাম ৫২ থেকে ৫৩ টাকা। আমদানি করলে বাজারে দাম পাওয়া যাবে কি-না, সে চিন্তায় আগ্রহ কম দেখা যাচ্ছে। তিনি বলেন, আমদানির সুযোগ করে দেয়ায় চালের বাজার অস্থিতিশীল হচ্ছে না। তবে আমদানির অনুমতির সময়সীমা বাড়াতে হবে।

তেল
ভোজ্যতেল আমদানিতে দুই দফায় শুল্ককর কমানো হয়েছে। প্রথম দফায় ১৭ অক্টোবর ও দ্বিতীয় দফায় ১৯ নভেম্বর কমিয়ে তা নামানো হয়েছে মাত্র পাঁচ শতাংশে। তাতে প্রতিকেজি অপরিশোধিত সয়াবিন ও পাম তেলের শুল্ককর ১৭-১৮ টাকা থেকে কমে সাত টাকায় নেমেছে। অর্থাৎ, কেজিতে কমেছে ১০-১১ টাকা। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্যমতে, ২৩ নভেম্বর পর্যন্ত গতমাসের ২৩ দিনে চট্টগ্রাম বন্দরের ট্যাংক টার্মিনাল থেকে মোট ৬৫ হাজার টন সয়াবিন ও পাম তেল খালাস করেছেন ব্যবসায়ীরা। আরও ৪৫ হাজার টন তেল নিয়ে চারটি জাহাজ এসেছে। সাধারণত প্রতি মাসে ভোজ্যতেলের চাহিদা পৌনে দুই লাখ টন।

তবে বাজারে বর্তমানে প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন তেল বিক্রি হচ্ছে ১৬৭ টাকায়, যা দুই সপ্তাহ আগেও ছিল ১৫৬ টাকা। প্রতি লিটার খোলা পাম তেল বিক্রি হচ্ছে ১৫৫ টাকায়, দুই সপ্তাহ আগে যা ছিল ১৪৬ টাকা। আর পাম তেল সুপার প্রতি লিটার বিক্রি হচ্ছে ১৫৮ টাকায়, যা আগে ছিল ১৫১ টাকা।

ভোজ্যতেল আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান সিটি গ্রুপের পরিচালক (কর্পোরেট অ্যাফেয়ার্স) বিশ্বজিৎ সাহা বলেন, বিশ্ববাজারে ভোজ্যতেলের দাম বাড়তি। তবে সরকার শুল্ককর কমানোয় এই বাড়তি দাম সমন্বয় হয়ে গেছে। যদি শুল্ককর না কমানো হতো, তাহলে লিটারপ্রতি ১৩-১৪ টাকা দাম বাড়তো। এতদিন অনিশ্চয়তায় আমদানি কম হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, শুল্ককর কমায় সামনে সরবরাহ বাড়বে।

চিনি
চিনি আমদানিতেও শুল্ককর কমিয়েছে সরকার। আগে অপরিশোধিত চিনি আমদানিতে কেজিপ্রতি ৩৮-৪০ টাকা শুল্ককর দিতে হতো। এখন দিতে হচ্ছে, ২৩ টাকা। অর্থাৎ, কেজিতে শুল্ককর কমেছে ১৫-১৭ টাকা। ১৭ অক্টোবর শুল্ককর কমানোর পর ২৩ নভেম্বর পর্যন্ত চিনি আমদানি হয়েছে এক লাখ ৮১ হাজার টন। এর মধ্যে বাজারজাত হয়েছে ৫০ হাজার টন। ব্যবসায়ীরা বলছেন, চিনি আমদানি পরিস্থিতি সন্তোষজনক। তবে বাজারের চিত্র উল্টো। বর্তমানে প্রতি কেজি প্যাকেটজাত চিনি ১৪০ টাকা ও খোলা চিনি ১৩৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, যা দুই সপ্তাহ আগে ছিল ১৩০-১৩৫ টাকা।

পেঁয়াজ
পেঁয়াজ আমদানি বাড়াতে সেপ্টেম্বর ও নভেম্বরে দুই দফায় শুল্ককর কমায় সরকার। এতে গত এক মাসে পেঁয়াজ আমদানি হয়েছে ৭৭ হাজার টনের কিছু বেশি। গত বছর একই সময়ে আমদানি হয়েছিল ৬১ হাজার টন। শুল্ক কমায় আমদানি কিছুটা বাড়লেও ১০০ টাকার নিচে নামেনি আমদানিকৃত পেঁয়াজের দাম। বর্তমানে বাজারে খুচরা পর্যায়ে প্রতি কেজি ভারতীয় পেঁয়াজ ১২০ টাকা, পাকিস্তানি পেঁয়াজ ১০৫ টাকা ও মিশরের পেঁয়াজ ১০০ টাকার মধ্যে বিক্রি হচ্ছে।

খাতুনগঞ্জের পেঁয়াজ ব্যবসায়ী বলয় কুমার পোদ্দার জানান, পেঁয়াজের চাহিদার অন্তত ৩০ শতাংশ পূরণ করা হয় আমদানিতে। ফলে বছরের শেষদিকে দেশি পেঁয়াজের সরবরাহ কমে যাওয়ায় তখন আমদানি বাড়ে। বর্তমানে শুল্ক কমলেও ভারতীয় বাজারে পেঁয়াজের দাম বাড়ায় আমদানি খরচও বেড়ে গেছে। তাই শুল্ক কমিয়েও সুফল পাওয়া যাচ্ছে না। অন্যদিকে, গুণগত কারণে বাজারে দেশি ও ভারতীয় পেঁয়াজের চাহিদা বেশি। তাই বিকল্প দেশ হিসেবে পাকিস্তান ও মিশর থেকে পেঁয়াজ এলেও সেসব পেঁয়াজের চাহিদা কম থাকায় বাজারে প্রভাব পড়ছে না।

আলু
বাজার নিয়ন্ত্রণে ৫ সেপ্টেম্বর আলু আমদানিতে শুল্ককর ছাড় দেয় সরকার। দেশে প্রতি মাসে আট লাখ টনেরও বেশি আলুর চাহিদা থাকলেও শুল্ক ছাড়ের পর এখন পর্যন্ত আলু আমদানি হয়েছে মাত্র ৪০ হাজার টন। ফলে আমদানি করা সামান্য আলু বাজারে বড় প্রভাব ফেলছে না। টিসিবির হিসাবে, এক সপ্তাহেই প্রতি কেজি আলুর দাম ১০ টাকা বেড়েছে। এখন কেজিতে আলু বিক্রি হচ্ছে ৭৫ থেকে ৮৫ টাকা দরে। বাজারে নতুন আলু উঠতে শুরু করলেও তার প্রভাব পড়েনি দামে। সেগুলোও বিক্রি হচ্ছে ১০০-১২০ টাকা কেজিতে।

ডিম
বন্যায় খামার ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় সেপ্টেম্বরের শেষদিকে প্রতি ডজন ডিমের দাম ঠেকে ১৮০-১৮৫ টাকায়। এরপর ১৭ অক্টোবর ডিম আমদানিতে শুল্ক ২৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ করা হয়। এরপর এখন পর্যন্ত ৫৫ কোটি ডিম আমদানির অনুমতি পান ব্যবসায়ীরা। তবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)-এর তথ্যে, এখন পর্যন্ত ডিম আমদানি হয়েছে মাত্র ১০ লাখ। ব্যবসায়ীরা বলছেন, আমদানির অনুমতি দেয়ার পর দাম কিছুটা কমে প্রতি ডজন ডিম ১৪৫ টাকায় পৌঁছে। তবে আশানুরূপ আমদানি না হওয়ায় তা ধীরে ধীরে বেড়ে এখন আবার ১৫০-১৫৫ টাকায় ঠেকেছে।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ