বহু কারণের সমষ্টিগত ফল সড়ক দুর্ঘটনা
সিলেট থেকে ৩৬ জন যাত্রী নিয়ে সুনামগঞ্জের উদ্দেশ্যে যাত্রা বাসচালক টিটু লাল দাসের। শহর ছাড়িয়ে প্রায় ৯ কিলোমিটার দূরে মোল্লারগাঁওয়ে বাঁপাশ থেকে হঠাৎ করেই গাড়ির সামনে দৌড়ে ছুটে আসে একটি গরুর বাছুর। ডানদিক থেকে তখন সিলেটের দিকে যাচ্ছিল একটি কাভার্ডভ্যান। দুটি গাড়িই চলছিল দ্রুতগতিতে; কিন্তু হঠাৎ করেই পরিস্থিতি বেসামাল। কি করবেন বুঝে উঠতে পারছিলেন না টিটু। অগত্যা বাসযাত্রী, কাভার্ডভ্যান এবং গরুর বাছুর রক্ষায় টানলেন হার্ডব্রেক। ঘটনাস্থলেই উল্টে যায় তার বাসটি। তাতে যাত্রীরা সামান্য আহত হলেও টিটু লাল দাস চালকের আসন থেকে ছিটকে পড়ে যান রাস্তার বাঁপাশে।
জ্ঞানহীন ছিলেন ঘণ্টাখানেক। জ্ঞান ফিরে নিজেকে হাসপাতালের বেডে দেখতে পেয়ে সম্বিত ফিরে পান টিটু লাল দাস; কিন্তু চিকিৎসক জানান, ডান পায়ের অবস্থা খুব ভালো নয়। দ্রুত অস্ত্রোপচার করতে হবে। অপারেশন সফল হলেও সেই থেকে টিটু লাল দাসকে স্ক্র্যাচে ভর করে চলতে হচ্ছে।
ঘটনাটি গেল বছরের ২৩ জানুয়ারির। সেই থেকে প্রায় দুই বছর গৃহবন্দি পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম যুবক সুনামগঞ্জের জামালগঞ্জ উপজেলার বেহেলি গ্রামের টিটু লাল দাস। বাবা মতি লাল দাসের তিন সন্তানের মধ্যে বড় সন্তান তিনি।
এভাবেই নানা কারণে সড়ক দুর্ঘটনায় বাসচালক আহত হওয়ার ঘটনা ঘটেই চলেছে। যাত্রীসহ গাড়িচালক মারাও যাচ্ছেন সচরাচর। আর এক একটি দুর্ঘটনায় টিটু লাল দাসের মতোই জীবন-জীবিকা থেঁতো হয়ে যাচ্ছে অনেকের। যে মানুষটি ছিলেন পরিবারের একমাত্র অবলম্বন, তার মৃত্যু অন্য সদস্যদের সব স্বপ্ন আশা-আকাঙ্ক্ষা ভেঙে চুরমার করে দেয়। তাদের ভবিষ্যৎ হয়ে পড়ে অনিশ্চিত। জীবনে নেমে আসছে চরম দুর্ভোগ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সড়কের ত্রুটি, যানবাহনের ত্রুটি, পারিপার্শ্বিক পরিবেশ ও আবহাওয়াগত সমস্যা, চালকের অদক্ষতা, বেপরোয়া আচরণ, ক্লান্তিজনিত ঘুম, পথচারীর অসচেতনতাসহ বহু কারণের সমষ্টিগত ফলাফল সড়ক দুর্ঘটনা।
নিরাপদ সড়ক চাইর (নিসচা) সিলেট বিভাগীয় কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এ বিভাগে সড়ক দুর্ঘটনা প্রতি মাসেই বাড়ছে। অক্টোবরে ৩৬টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৩৪ জন নিহত ও ৬৭ জন আহত হন। এর মধ্যে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে গাড়ি উল্টে সাতটি দুর্ঘটনায় আটজন, মুখোমুখি সংঘর্ষে ১২টি দুর্ঘটনায় ১৪ জন এবং বৈদ্যুতিক খুঁটি ও গাছের সঙ্গে ধাক্কায় তিনজন নিহত হন। সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা ঘটেছে সিলেট জেলায় আর সবচেয়ে কম হয়েছে সুনামগঞ্জ জেলায়। সিলেট জেলায় ১৬টি দুর্ঘটনায় ১৪ জন নিহত ও ১৯ জন আহত এবং সুনামগঞ্জ জেলায় তিনটি দুর্ঘটনায় তিনজন নিহত ও দুজন আহত হয়েছেন। মৌলভীবাজার জেলায় পাঁচটি সড়ক দুর্ঘটনায় চারজন নিহত ও তিনজন আহত এবং হবিগঞ্জ জেলায় ১২টি সড়ক দুর্ঘটনায় ১৩ জন নিহত ও ৪৩ জন আহত হয়েছেন। এর আগে সেপ্টেম্বর মাসে সিলেট বিভাগে ২৪টি সড়ক দুর্ঘটনায় ২০ জন নিহত ও ২৪ জন আহত হয়েছিলেন।
নিসচা কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক, সিলেট বিভাগীয় কমিটির সদস্য সচিব ও জেলার আহ্বায়ক জহিরুল ইসলাম মিশু জানান, পাঁচটি স্থানীয় দৈনিক পত্রিকা ও অনলাইন এবং দুটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকার তথ্য, অনুমেয় অনুচ্চ বা অপ্রকাশিত ঘটনা এবং নিসচার শাখা সংগঠনগুলোর তথ্যের ভিত্তিতে বিভাগীয় কমিটি এ প্রতিবেদন তৈরি করেছে।
প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়, অক্টোবর মাসে নিহত ৩৪ জনের ২৮ জন পুরুষ, পাঁচজন নারী ও একজন শিশু। এ সময় ১৮ জন চালকও নিহত হন। নিহতদের ১৩ জনই মোটরসাইকেল চালক ও আরোহী, পাঁচজন সিএনজিচালিত অটোরিকশা-লেগুনা চালক ও যাত্রী এবং সাতজন পথচারী।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে সড়ক দুর্ঘটনা বেশি ঘটায় ওভারটেকিং প্রবণতা। সাধারণত রাস্তায় ধীরগতির গাড়িগুলোকে ওভারটেকিংয়ের প্রয়োজন পড়ে। এ সময় হর্ন বাজিয়ে সামনের গাড়িকে সংকেত দিতে হয়; কিন্তু অনেক সময় সংকেত না দিয়ে একজন আরেকজনকে ওভারটেকের চেষ্টা চালায়। ফলে সামনের দিক থেকে আসা গাড়ি বের হতে না পেরে মুখোমুখি সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। তাই সঠিক নিয়ম মেনে সতর্কতার সঙ্গে ওভারটেক করা উচিত।
ত্রুটিপূর্ণ সড়ক ব্যবস্থায় মহাসড়কগুলোতে বাঁক থাকায় সামনের দিক থেকে আসা গাড়ি দেখতে না পেয়ে দুর্ঘটনা ঘটিয়ে থাকেন অনেক চালক। রাস্তার পাশে হাট-বাজার স্থাপন এবং ওভারব্রিজ না থাকাও দুর্ঘটনা ঘটাচ্ছে। আরেকটি বড় কারণ হলো, মহাসড়কগুলোতে দ্রুতগতির যানবাহনের পাশাপাশি ধীরগতির যানবাহন চলাচল। গতির তারতম্য থাকায় দ্রুতগতির গাড়ির সঙ্গে ধাক্কা লেগে ধীরগতির বাহন রাস্তা থেকে ছিটকে পড়ে। তাই মহাসড়কে ধীরগতির যানবাহন চলাচল বন্ধেও গুরুত্বারোপ সংশ্লিষ্টদের।
সিলেটের উপপুলিশ কমিশনার (ট্রাফিক) এ বি এম আশরাফ উল্লাহ তাহের বলেন, ট্রাফিক আইন অমান্যেও সড়ক দুর্ঘটনা ঘটছে। তাছাড়া হালকা যানবাহন চালকের লাইসেন্স থাকলেও নিয়মভঙ্গ করে চালানো হচ্ছে ভারি যানবাহন। সড়ক-মহাসড়কের স্থানে স্থানে স্পিডব্রেকার, নিয়ন্ত্রণ নির্দেশিকা এবং সড়ক-মহাসড়কে গাড়ি চালানোর রীতিনীতি সম্পর্কে না জানায় অহরহ ঘটছে দুর্ঘটনা। আবার জেলা থেকে মেট্রো এলাকায় প্রবেশকালে আসা সব ধরনের যানচালকরাই মাথায় রাখছেন না গতি নিয়ন্ত্রণের নিয়মনীতি।
তিনি বলেন, ‘দুর্ঘটনারোধে প্রচার-প্রচারণা এই সময়ে গুরুত্বপূর্ণ হলেও বিষয়টি উপেক্ষিত। আমাদের ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণব্যবস্থাকেও আরও উন্নত করতে হবে। সড়ক-মহাসড়কগুলোকে ডিজিটাল নজরদারির আওতায় নিয়ে আসতে হবে।’
‘সড়ক দুর্ঘটনারোধে প্রয়োজন সমন্বিত উদ্যোগ। সরকার, চালক, মালিক, শ্রমিক ও যাত্রী সবাইকে সতর্ক ও সচেতন থাকতে হবে। মনে রাখতে হবে, সময়ের চেয়ে জীবনের মূল্য অনেক বেশি।’
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে