পোশাক শিল্পে বাড়ছে রপ্তানি, কাটছে অস্থিরতা
জুলাইজুড়ে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের পর গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা দেশ ত্যাগ করলে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়। তারপর থেকেই ব্যবসা-বাণিজ্যের বিভিন্ন খাতে শুরু হয় চরম বিশৃঙ্খলা। বাদ যায়নি তৈরি পোশাক খাতও। বকেয়া-বেতনসহ বিভিন্ন দাবি আদায়ের নামে আগস্ট-সেপ্টেম্বরের পুরো সময়ই পোশাক শ্রমিকরা আন্দোলন করেন। এতে ব্যাহত হয় উৎপাদন কার্যক্রম। ফলে বড় প্রভাব পড়ে রপ্তানিতে। জুলাই-আগস্টে রপ্তানি বাড়লেও কমে যায় সেপ্টেম্বরে। তবে অস্থিরতা কাটিয়ে অক্টোবরে ইতিবাচক ধারায় ফিরেছে পোশাক রপ্তানি।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের তুলনায় ২০২৪-২৫ অর্থবছরের শুরু থেকেই পোশাক রপ্তানি ছিল ইতিবাচক। জুলাই মাসে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ৩১৭ কোটি ৮৪ লাখ ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়। আগের অর্থবছরের জুলাই মাসে পোশাক রপ্তানি হয়েছিল ৩০৮ কোটি ৯১ লাখ ডলারের। অর্থাৎ রপ্তানি বৃদ্ধি পায় ৮ কোটি ৯৩ লাখ ডলার বা ২ দশমিক ৮৯ শতাংশ। পোশাক রপ্তানির এই ধারাবাহিকতা চলতি বছরের আগস্টেও ছিল। এই মাসে রপ্তানি হয় ৩৩২ কোটি ৫৯ লাখ ডলারের। তবে সেপ্টেম্বরে রপ্তানি কমে। এই মাসে রপ্তানি হয় ৩০১ কোটি ডলারের পোশাক। অর্থাৎ আগস্টের চেয়ে সেপ্টেম্বরে রপ্তানি কমে ৩১ কোটি ৫৮ লাখ ডলার বা ৯ দশমিক ৫০ শতাংশ। তবে অক্টোবরে এসে রপ্তানি হয় ৩২৯ কোটি ৬৪ লাখ ডলারের। অর্থাৎ এ মাসে রপ্তানি বেড়েছে ২৮ কোটি ৬৩ লাখ ডলার বা ৯ দশমিক ৫১ শতাংশ।
খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রাজনৈতিক অস্থিরতা ও শ্রমিকদের আন্দোলনসহ বিভিন্ন কারণে তৈরি পোশাক খাতে কিছুটা নেতিবাচক প্রভাব পড়লেও এখন সে অবস্থা কাটতে শুরু করেছে। বিশেষ করে চীনের ওপর আমেরিকার ১০ শতাংশ ট্যাক্স আরোপের কারণে চীনের কিছু ব্যবসা বাংলাদেশে আশার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। আশা করা যাচ্ছে, আগামী দুই প্রান্তিকে পোশাক রপ্তানি আরও বাড়বে।
ইপিবির তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জুলাইয়ে ৩১৭ কোটি ৮৪ লাখ ডলার, আগস্টে ৩৩২ কোটি ৫৯ লাখ ডলার, সেপ্টেম্বরে ৩০১ কোটি ১ লাখ ইউএস এবং অক্টোবরে ৩২৯ কোটি ৬৪ লাখ ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়েছে। সে হিসাবে অর্থবছরের চার মাসে পোশাক রপ্তানি হয় ১ হাজার ২৮১ কোটি ১০ লাখ ডলারের, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ১২৩ কোটি ৮৫ লাখ ডলারের বেশি। গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় অক্টোবরে পোশাক রপ্তানি বেড়েছে ৬১ কোটি ১৯ লাখ ডলার।
বাংলাদেশ থেকে নিটওয়্যার ও ওভেন পোশাক বেশি রপ্তানি হয়। ইপিবির তথ্য অনুযায়ী, গত অর্থবছরের চেয়ে চলতি অর্থবছরের (২০২৪-২৫) জুলাইয়ে ওভেন পোশাকের রপ্তানি ৩ দশমিক ৯৩ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৪৪ কোটি ৯৪ লাখ ডলারে। আগস্টে ৩ দশমিক ১১ শতাংশ বেড়ে দাঁড়ায় ১৪৩ কোটি ৪৮ লাখ ডলারে, সেপ্টেম্বরে ১৭ দশমিক ২২ শতাংশ বেড়ে দাঁড়ায় ১২৮ কোটি ৬ লাখ ডলারে। আর অক্টোবরে ২০ দশমিক ৫৪ শতাংশ বেড়ে রপ্তানি হয়েছে ১৪৩ কোটি ৮৭ লাখ ডলার।
নিটওয়্যার পোশাক রপ্তানি গত বছরের তুলনায় জুলাইয়ে ২ দশমিক ০৪ শতাংশ বেড়ে দাঁড়ায় ১৭২ কোটি ৯০ লাখ ডলারে। আগস্টে ১০ দশমিক ৫৩ শতাংশ বেড়ে দাঁড়ায় ১৮৯ কোটি ১১ লাখ ডলার, সেপ্টেম্বরে ১২ দশমিক ৭৪ শতাংশ বেড়ে ১৭২ কোটি ৯৫ লাখ ডলার। আর অক্টোবরে ২৪ দশমিক ৬০ শতাংশ বেড়ে রপ্তানি হয় ১৮৫ কোটি ৭৬ লাখ ডলার।
পোশাক রপ্তানির এই ইতিবাচক ধারা অব্যাহত থাকবে বলে আশা করছেন খাত সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, আশুলিয়া-সাভার এলাকার কারখানাগুলোতে আগস্ট-সেপ্টেম্বরজুড়ে শ্রমিক অসন্তোষে আন্দোলন, ভাঙচুর ও কারখানা বন্ধের মতো ঘটনাও ঘটে। এতে সময় মতো অর্ডার রেডি করেতে পারেননি অনেক রপ্তানিকারক। তাই আমদানিকারকের চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ করা যায়নি। তবে শ্রমিক অসন্তোষ অনেকটাই কেটে গেছে। দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিও স্থিতিশীল হওয়ার প্রক্রিয়ায় রয়েছে। তাই আগামীতে রপ্তানি আরও বাড়বে বলে আশা করা যাচ্ছে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সাবেক সভাপতি খন্দকার রফিকুল ইসলাম ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, শ্রমিকদের আন্দোলনের কারণে উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় সেপ্টেম্বরের রপ্তানি কমেছে। সেই ধাক্কা কাটিয়ে অক্টোবরে অবশ্য রপ্তানি বেড়েছে। তবে যে কোনো পরিস্থিতি বোঝার জন্য অন্তত দুই প্রান্তিকের (৬ মাস) ফলাফল দেখা দরকার হয়। আগামী এপ্রিল-মে পর্যন্ত যদি পজিটিভ গ্রোথ থাকে, তাহলে আশা করা যায়, পোশাক খাত নিয়ে দুশ্চিন্তা কেটে যাবে।
পজিটিভ গ্রোথ থাকার সম্ভাবনা দেখছেন কি না জানতে চাইলে রফিকুল ইসলাম বলেন, ট্রাম্প চীনা পণ্যের ওপর অতিরিক্ত ১০ শতাংশ ট্যাক্স (শুল্ক) আরোপের কথা বলেছেন। সেক্ষেত্রে চীন থেকে ভালো একটি ব্যবসা মুভ করে আমাদের দেশে আশার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে এটি নির্ভর করছে আমাদের দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ওপর। আইনশৃঙ্খলার উন্নতি হলে বায়ারদের আস্থা বাড়বে। এটা বড় একটি ফ্যাক্টর। তবে আমরা আশাবাদী সামনে আইনশৃঙ্খলা ভালো অবস্থায় যাবে।
জানা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের দিনই চীন, মেক্সিকো ও কানাডার ওপর বড় ধরনের ট্যাক্স আরোপ করার কথা জানিয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। এদের মধ্যে মেক্সিকো ও কানাডা থেকে আমদানি করা সব পণ্যের ওপর ২৫ শতাংশ এবং চীনা পণ্যের ওপর অতিরিক্ত ১০ শতাংশ ট্যাক্স আরোপ করা হবে বলে জানিয়েছেন ট্রাম্প।
পোশাক ব্যবসায়ীরা বলছেন, ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্ত কার্যকর হলে আমেরিকার ব্যবসায়ীদের একটি অংশ চীন ছেড়ে বাংলাদেশের ওপর নির্ভর করতে পারে। এতে পোশাকের অর্ডার বাড়তে পারে। তাই আগামী প্রান্তিকগুলোতে রপ্তানি আরও বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) সম্প্রতি ‘পোশাক খাতে সাম্প্রতিক মজুরি বিতর্ক: কী শিখলাম’ শীর্ষক সংলাপে নিজেদের পর্যবেক্ষণ তুলে ধরে। সেখানে দাবি করা হয়, তৈরি পোশাক শিল্পে শ্রমিকদের সাম্প্রতিক অসন্তোষের প্রধান কারণ মজুরি কাঠামো নির্ধারণে ত্রুটিপূর্ণ প্রক্রিয়া। নতুন বেতন কাঠামো ঘোষণার আগে ও পরের বিভিন্ন ধাপের কাজে যে ত্রুটিপূর্ণ প্রক্রিয়া অবলম্বন করা হয়েছিল তার ফলে শ্রমিকদের মধ্যে অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়ে। মজুরি নির্ধারণের ক্ষেত্রে যথার্থ প্রাতিষ্ঠানিক প্রক্রিয়া অবলম্বন করা হয়নি।
মজুরি বৃদ্ধির ক্ষেত্রে গ্রেডভিত্তিক তারতম্য সৃষ্টি হওয়ায় শ্রমিকদের মধ্যে অঞ্চল ও গ্রেডভেদে মিশ্র উপলব্ধিও জন্ম হয়। অন্যদিকে একেক কারখানায় পৃথকভাবে মজুরি বাস্তবায়ন ঘটেছে। অনেক কারখানা নতুন কাঠামো অনুসরণ করে মজুরি বাড়ায়নি। এতে বৈপরিত্য তৈরি হয়। এই অবস্থা নিরসন করা গেলে পোশাক রপ্তানি বাড়বে বলেও মনে করে সিপিডি।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে