সড়ক দুর্ঘটনা
সেদিন কেঁদেছিল পাঁচ গ্রামের মানুষ
হঠাৎ নীরবতায় স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল যশোরের বাঘারপাড়া উপজেলার জহুরপুর ইউনিয়নের যাদবপুর গ্রাম। মর্মান্তিক এক সড়ক দুর্ঘটনায় যমজ দুই শিশু সন্তানসহ একই পরিবারের পাঁচজনের মর্মান্তিক মৃত্যুর সান্ত্বনা খুঁজে পাননি পুরো গ্রামবাসী। নিহতদের স্বজনদের বুকফাটা আর্তনাদ ছুঁয়ে গিয়েছিল তাদের হৃদয়ও। করুণ এ দৃশ্যে চোখের পানি যেমন ধরে রাখতে পারেননি, তেমনি হারিয়ে ফেলেছিলেন মুখের ভাষাও।
গত বছরের ৮ জুলাই রাতে যাদবপুরের সেই শোক ছড়িয়ে পড়েছিল বাঘারপাড়া উপজেলার দুটি এবং যশোর সদর উপজেলার দুটিসহ আরও চারটি গ্রামে। ওই পাঁচ গ্রামের আটজন মানুষ চোখের নিমেষে একই দুর্ঘটনায় পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নেন। সেদিন থেকে হারিয়ে গেছে নিহতদের হাসি-খুশি পরিবারগুলোর সব আনন্দ। স্বজন হারানো মানুষগুলোর চোখে-মুখে এখন শুধুই শূন্যতা আর শোকের কাতরতা।
ওইদিন সন্ধ্যায় যশোর-মাগুরা সড়কের লেবুতলার তেঁতুলতলা বাজারে দুর্ঘটনাটি ঘটে। যশোর থেকে মাগুরাগামী একটি যাত্রীবাহী বাস স্পিডব্রেকারের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে উল্টোদিক থেকে আসা একটি যাত্রীবাহী ইজিবাইককে চাপা দেয়। এতে ঘটনাস্থলেই সাতজন এবং পরে একজনের মৃত্যু হয়। তারা সবাই ছিলেন ইজিবাইকটির চালক-যাত্রী।
নিহতদের মধ্যে যাদবপুরের জমজ সহোদর হাসান-হোসেন ছাড়াও ছিলেন তাদের নানি মাহিমা, মাহিমার বোন রাহিমা এবং রাহিমার মেয়ে জেবা তাহেরা। হাসান-হোসেন গ্রামের হেলাল মুন্সির ছেলে। তাদের নানি মাহিমা একই গ্রামের বাবুল মুন্সির স্ত্রী। মাহিমার বোন রাহিমা একই উপজেলার বন্দবিলা ইউনিয়নের সেকেন্দারপুর গ্রামের সাইদুল ইসলামের স্ত্রী এবং রাহিমার শিশুকন্যা জেবা। দুর্ঘটনার মাসচারেক আগে সংসারে সাচ্ছন্দ্য ফেরাতে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছিলেন সাইদুল।
নিহত অন্য তিনজন হলেন, ইজিবাইক চালক বন্দবিলা ইউনিয়নের মথুরাপুর গ্রামের ওবায়দুর রহমানের ছেলে আবু মুসা (১৭) এবং দুই যাত্রী সদর উপজেলার তালবাড়িয়া গ্রামের মারুফ হোসেন মুন্না ও সুলতানপুর গ্রামের সাইদুল ইসলামের ছেলে ইমরান। দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হন হাসান-হোসেনের বোন খাদিজা এবং মা সোনিয়া। তিন সন্তান ও মা-খালাকে নিয়ে ডাক্তার দেখাতে ইজিবাইকটিতে চড়ে যশোর শহরে যাচ্ছিলেন সোনিয়া।
দুর্ঘটনার এক বছর পরেও সোনিয়া খাতুন পুরোপুরি সুস্থ হয়ে ওঠেননি। এ পর্যন্ত তার শরীরে দুবার অস্ত্রপচার করা হয়েছে। একটি চোখ সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে গেছে। বাকিটা দিয়েও খুব একটা ভালো দেখতে পান না। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ডাক্তার জানিয়েছেন, চলতি ডিসেম্বর মাসের মধ্যেই চোখে অস্ত্রোপচার করা না হলে এ চোখটিও নষ্ট হয়ে যাবে। খরচ লাগবে প্রায় ৬০ হাজার টাকা।
দুই সন্তানকে হারিয়ে শোকাতুর সাভারের হেমায়েতপুর ট্যানারির শ্রমিক হেলাল মুন্সি বলেন, ‘সেদিনের দুর্ঘটনা আমার জীবন থেকে সব আনন্দ কেড়ে নিয়েছে। গ্রামে যেটুকু জায়গা জমি ছিল, তা বিক্রি করে মেয়ে ও স্ত্রীর চিকিৎসা করিয়েছি। মেয়ে ভালো হলেও স্ত্রীকে আজ পর্যন্ত সুস্থ করতে পারলাম না। তার চিকিৎসার টাকা নিয়েই চোখে অন্ধকার দেখছি। ডাক্তার বলেছেন, এ মাসের মধ্যেই সোনিয়ার চোখে অপারেশন করাতে হবে; কিন্তু খরচের টাকা এখন পর্যন্ত জোগাড় করতে পারিনি।’
হেলাল মুন্সি বলে, ‘অসুস্থ অবস্থায়ও নাড়িছেঁড়া ধন দুই শিশুকে খুঁজে ফেরেন হাসান-হোসেনের মা সোনিয়া।’ মামলা হয়েছিল কি-না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘মামলার উদ্যোগ নিয়েছিলাম সেই সময়; কিন্তু এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তি ও চাচাদের কথায় হয়ে ওঠেনি।’ গ্রামবাসী জানান, পরে ঘাতক বাসের মালিকের সঙ্গে তিন লাখ টাকার বিনিময়ে সমঝোতা হলেও হেলাল মুন্সি পেয়েছিলেন ১ লাখ টাকা। বাকি টাকা চলে গেছে মাতব্বরদের পকেটে।
নিহত মাহিমার স্বামী ও হাসান-হোসেনের নানা বাবুল মুন্সি ঢাকার একটি কোম্পানিতে চাকরি করেন। স্ত্রী ও যমজ দুই নাতির স্মৃতি হাঁতড়ে ফেরেন এখনো। তিনি বলেন, ‘বাড়িতে বেশি একটা আসি না। কাজের ফাঁকে ওদের কথা মনে পড়লে খুব কষ্ট হয়। অজান্তেই চোখ ভিজে যায়। ভয়ঙ্কর কষ্টের কথা কাউকে বলে বোঝানো যায় না। একমাত্র দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারই জানেন।’
আজও বিলাপ থামেনি দাদি রেণুকা বেগমের। কাঁদতে কাঁদতে তিনি বলেন, ‘তুমরা আমার মণিগের আইনে দ্যাও। হাসান-হোসেন ছিল আমার পরাণ।’ যাদবপুর কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ প্রাঙ্গণে মুন্সীবাড়ি পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয় জমজ দুভাই ও তাদের নানিকে। সেকেন্দারপুরে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয় রাহিমা ও তার শিশুকন্যাকে। ইজিবাইক চালক আবু মুসাকে দাফন করা হয় মথুরাপুর গ্রামে।
পরিবারটিকে সান্ত্বনা দিতে সেদিন দূর-দূরান্ত থেকে ছুটে এসেছিলেন সাধারণ মানুষ। এসেছিলেন রাজনৈতিক নেতা, জনপ্রতিনিধি, সামাজিক নেতারাও। ‘কিন্তু এখন আর কেউ খোঁজও নেন না। স্ত্রী সোনিয়ার চিকিৎসা আর সংসার চালানোর টাকা জোগাড়ে ছোটাছুটি করতে হচ্ছে একা আমাকেই’- বলছিলেন বাবুল মুন্সি।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে