Views Bangladesh Logo

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন: বাস্তবতা বনাম শোরগোল

ম্প্রতি ব্যাংকক থেকে ঢাকা পর্যন্ত রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বিষয়টি নিয়ে শোরগোল উঠেছে। আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক মহল থেকে শুরু করে দেশের গণমাধ্যমেও আলোচনা চলছে- মিয়ানমার নাকি এক লাখ ৮০ হাজার রোহিঙ্গাকে ফেরত নিতে রাজি হয়েছে। এই প্রচারণা দেখে মনে হতে পারে- সমস্যার সমাধান এবার বুঝি দোরগোড়ায়; কিন্তু বাস্তবতা অনেক বেশি জটিল এবং এই প্রচারণার পর্দার আড়ালে আছে নানা কূটকৌশল ও স্বার্থের সংঘাত। এখানে যেমন আছে শুভঙ্করের ফাঁকি, তেমনি লুকিয়ে আছে সাম্রাজ্যবাদী রাজনীতির ভাঁওতাবাজি।


রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ইস্যু নিয়ে বারবার আশ্বাস ও চুক্তির পরও বাস্তবে কোনো অগ্রগতি দেখা যায়নি। কিছু সময় পরপর আন্তর্জাতিক মহল কিছু আলোচনার ধোঁয়া তুলে আবার নীরব হয়ে যায়। এতে প্রশ্ন জাগে- এই প্রচারণা কি সত্যিই সমস্যা সমাধানে উৎসাহী, নাকি শুধু কূটনৈতিকভাবে চাপমুক্ত হওয়ার একটি মাধ্যম?

সবচেয়ে বড় প্রশ্নটি হলো- কেন এখন এই আলোচনার হঠাৎ গতি? রোহিঙ্গা সমস্যা দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের কাঁধে চেপে বসে আছে। অথচ আন্তর্জাতিক শক্তিগুলো তেমন কোনো কার্যকর ভূমিকা পালন করেনি। বর্তমান পরিস্থিতিতে একটি আশঙ্কা জোরালোভাবে সামনে আসছে- এই ইস্যুকে পুঁজি করে বাংলাদেশে ‘সাময়িক সরকার’ ব্যবস্থা দীর্ঘায়িত করার একটি আন্তর্জাতিক মতলব থাকতে পারে। বিশেষ করে এমন এক সময়ে যখন রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা বিদ্যমান তখন রোহিঙ্গা ইস্যুকে একটি কৌশলগত হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করার আশঙ্কা একেবারে উড়িয়ে দেয়া যায় না।
১ লাখ ৮০ হাজার রোহিঙ্গাকে ফিরিয়ে নেয়ার কথাটা শুনতে আশাব্যঞ্জক মনে হলেও, বাস্তবতা কিন্তু ভিন্ন। বাংলাদেশ ২০১৮ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে ছয়টি ধাপে মোট আট লাখ রোহিঙ্গার তালিকা মিয়ানমার সরকারের কাছে পাঠিয়েছিল। সেই বিশাল তালিকা থেকে মাত্র এক লাখ ৮০ হাজার রোহিঙ্গাকে ফেরতযোগ্য বলে স্বীকৃতি দিয়েছে মিয়ানমার। তাহলে বাকি ৬ লাখ ২০ হাজার রোহিঙ্গা? তাদের কী হবে?

তার ওপর সময়ের সঙ্গে সঙ্গে রোহিঙ্গা সংকট আরও জটিল হয়েছে। গত বছরই প্রায় ৭০ হাজার নতুন রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। আবার ২০১৭ সালের পর থেকে প্রতি বছর গড়ে প্রায় ৩০ হাজার শিশু রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে জন্ম নিয়েছে। সাত বছরে সংখ্যাটা দাঁড়ায় প্রায় দুই লাখ। তাহলে সব মিলিয়ে- পুরনো আট লাখ, নতুন ৭০ হাজার এবং শিশু দুই লাখ- বর্তমানে রোহিঙ্গা জনসংখ্যা প্রায় ১০ লাখ ৭০ হাজারের কাছাকাছি। এখন প্রশ্ন হলো, এই বিপুলসংখ্যক মানুষের জন্য বাস্তবিক অর্থে প্রত্যাবাসনের পরিবেশ তৈরি হয়েছে কি?
উত্তর- না।

রোহিঙ্গাদের আদি নিবাস মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে; কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে এই অঞ্চল আর মিয়ানমারের সামরিক জান্তা সরকারের নিয়ন্ত্রণে নেই। এটি এখন ‘আরাকান আর্মি’ নামক এক জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠীর দখলে- যারা দীর্ঘদিন ধরে জান্তাবিরোধী সংগ্রাম চালিয়ে আসছে। সুতরাং, রাখাইন প্রদেশের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারানো সরকারের সঙ্গে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের কোনো চুক্তি কতটা ফলপ্রসূ হবে তা নিয়ে সন্দেহ অমূলক নয়।

মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিস্থিতিও খুব একটা অনুকূল নয়। রাখাইন রাজ্য, যেখান থেকে রোহিঙ্গারা বিতাড়িত হয়েছিল, তার বড় একটা অংশ এখন আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণে। সেখানে মিয়ানমার সরকারের অস্তিত্বই প্রশ্নবিদ্ধ। তাহলে তারা রোহিঙ্গাদের ফেরত নেবে কোথায়? বা কীভাবে?


আরাকান আর্মিও কোনোভাবে রোহিঙ্গাবান্ধব নয়। উল্টো, তারা নিয়ন্ত্রণ নেয়ার পরও রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন চালিয়েছে। সেই নির্যাতনের ফলে গত বছরই নতুন করে ৭০ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে।
এ অবস্থায় কীভাবে প্রত্যাবাসন সম্ভব?

আন্তর্জাতিক নীতিমতে, প্রত্যাবাসনের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শর্ত হলো স্বেচ্ছায় ফেরা এবং নিরাপদ পরিবেশ। রোহিঙ্গারা যদি নিজ ইচ্ছায় ফিরতে না চায়, কিংবা তারা যদি মনে করে ফেরার পর তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত নয়- তাহলে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে তাদের জোর করে পাঠানোর কোনো সুযোগ নেই।

এ ব্যাপারে অতীত অভিজ্ঞতা সুখকর নয়। রাখাইনে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব, অধিকার ও নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়নি। ২০১৭-এর আগেও কিছু রোহিঙ্গাকে ফেরত পাঠানো হয়েছিল; কিন্তু তাদের ওপর নির্যাতন চলতে থাকে। বেশিরভাগ রোহিঙ্গাই জানেন যে ফেরত গেলে তাদের জীবন ঝুঁকিতে পড়বে। ফলে, যদি মিয়ানমার কিছু রোহিঙ্গাকে ফেরত নিতেও রাজি হয়, রোহিঙ্গারা যেতে অস্বীকার করলে বাংলাদেশের পক্ষে জোর করে পাঠানো সম্ভব নয়।

কিন্তু বর্তমানে যে আলোচনা চলছে, তা কি এই শর্তগুলো পূরণ করছে? নাকি এটি শুধুই একটি ‘কালক্ষেপণ কৌশল’, যার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক চাপ সাময়িকভাবে কমিয়ে ফেলা হচ্ছে? এর পেছনে রাজনৈতিক বা কূটনৈতিক কোনো উদ্দেশ্য রয়েছে কি?
অভিজ্ঞজনের মতে, বর্তমান বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক রাজনীতিতে বাংলাদেশের ভূমিকা ক্রমেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। বিশেষ করে, বাংলাদেশে রাজনৈতিক উত্তরণের এই সময়ে রোহিঙ্গা ইস্যুকে একটি ‘চাপের হাতিয়ার’ হিসেবে ব্যবহার করার অপচেষ্টা থাকতে পারে। কেউ কেউ মনে করেন, আন্তর্জাতিক মহল বাংলাদেশের ওপর এই সংকটকে টিকিয়ে রেখে ভবিষ্যতের জন্য কৌশলগত সুবিধা নিতে চাইতে পারে।

বাংলাদেশ ইতোমধ্যে ১১ লাখ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়ে মানবিকতার অনন্য উদাহরণ সৃষ্টি করেছে; কিন্তু এই মানবিকতাকে কোনোভাবেই রাজনৈতিক ফাঁদে পরিণত হতে দেওয়া যাবে না। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের নামে যদি বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব ও অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা হুমকির মুখে পড়ে তাহলে তা কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না।

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিঃসন্দেহে একটি দীর্ঘমেয়াদি ও ধাপে ধাপে বাস্তবায়নযোগ্য প্রক্রিয়া। এটি কেবল চুক্তি করে বা প্রচারণা চালিয়ে সমাধান সম্ভব নয়। প্রয়োজন আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত নিরপেক্ষ তদারকি, মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা ও নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করার অঙ্গীকার।

বাংলাদেশ ইতোমধ্যে যে মানবিক দায়িত্ব পালন করেছে তা বিশ্ব ইতিহাসে বিরল; কিন্তু এই মানবিকতা যাতে কোনো রাষ্ট্র বা আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীর রাজনৈতিক কৌশলের বলি না হয়, সে বিষয়ে এখনই সচেতন হওয়া জরুরি।


রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান কূটনৈতিক প্রচারণা বা ভূরাজনৈতিক চালবাজিতে নয়, বরং একটি টেকসই ও ন্যায়ভিত্তিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই সম্ভব। বাংলাদেশকে সতর্ক ও দূরদর্শী হয়ে এই ইস্যুতে এগোতে হবে, যাতে কোনোভাবেই এই সংকটকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করার সুযোগ না তৈরি হয়। রোহিঙ্গাদের নিরাপদ প্রত্যাবাসনই কাম্য; কিন্তু তা যেন কোনো গোপন রাজনৈতিক এজেন্ডার অংশ না হয়- সেই দাবি আজ সবার।

এই পরিস্থিতিতে প্রয়োজন বাস্তবমুখী কূটনৈতিক পদক্ষেপ, শুধু কাগুজে ঘোষণা বা শোরগোল নয়। রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে আন্তর্জাতিক চাপ প্রয়োগ, যথাযথ মানবাধিকার সংস্থার জবাবদিহি এবং দীর্ঘমেয়াদে সমন্বিত পরিকল্পনা ছাড়া কোনো টেকসই সমাধান সম্ভব নয়।


কারণ, চোখে আঙুল দিয়ে দেখানো যাচ্ছে- রোহিঙ্গারা যাবে না। বাস্তবতা তাদের যাবার পক্ষে নয়। তবু শোরগোল তোলা হচ্ছে। রোহিঙ্গা সংকটের স্থায়ী সমাধান মিয়ানমারের রাজনৈতিক ইচ্ছা, রাখাইনের শান্তি ও রোহিঙ্গাদের নাগরিক অধিকারের ওপর নির্ভরশীল। যতদিন না এই শর্তগুলো পূরণ হচ্ছে, ততদিন প্রত্যাবাসন আলোচনা কেবলই রাজনৈতিক শোরগোল থেকে যাবে।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ