Views Bangladesh Logo

পূর্ণ নাগরিকত্ব ও মৌলিক অধিকারের নিশ্চিয়তা নিয়েই ফিরতে চান রোহিঙ্গারা

Manik Miazee

মানিক মিয়াজী

ম্প্রতি মিয়ানমার সরকার জানিয়েছে, বাংলাদেশের দেয়া তালিকা থেকে তারা ১ লাখ ৮০ হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থীকে ফেরত নেবে। এ সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছে বাংলাদেশ। তবে, রোহিঙ্গা শরণার্থীরা বলছে, পূর্ণ নাগরিকত্ব ও মৌলিক অধিকার নিশ্চিত না হলে তারা মিয়ানমারে ফেরত যাবেন না। তারা আশঙ্কা করছেন, নাগরিকের মর্যাদা নিশ্চিত না হলে আগের মতো নির্যাতন ও বৈষম্যের শিকার হতে পারেন তারা। রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের নেতারা বলছেন, নাগরিকত্বের নিশ্চয়তা, নিরাপত্তা, এবং স্বাধীন চলাফেরার অধিকার না পেলে তারা ফেরত যেতে রাজি নন।

২০১৮-১৯ সালে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছিল, কারণ শরণার্থীরা নিরাপত্তা ও নাগরিকত্বের নিশ্চয়তা না পেয়ে ফেরত যেতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন। বর্তমান পরিস্থিতিতেও মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সহিংসতা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা অব্যাহত রয়েছে, যা রোহিঙ্গাদের ফেরার পথে প্রধান বাধা হিসেবে দাঁড়িয়েছে। ২০১৭ সালের আগস্টে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর অভিযানে ৭ লাখের বেশি রোহিঙ্গা পালিয়ে আসে বাংলাদেশে। জাতিসংঘ এই অভিযানকে ‘জাতিগত নিধন’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে।

বর্তমানে কক্সবাজার ও বান্দরবানে প্রায় ১২ লাখের মতো রোহিঙ্গা শরণার্থী অবস্থান করছেন। মানবাধিকার সংস্থাগুলো মিয়ানমার ও বাংলাদেশের মধ্যে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন পরিকল্পনা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। তারা মনে করেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানো তাদের জীবনের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। তারা জোর দিয়ে বলছেন যে, রোহিঙ্গাদের স্বেচ্ছায়, নিরাপদে ও মর্যাদার সঙ্গে ফেরার জন্য মিয়ানমারকে অবশ্যই তাদের নাগরিকত্ব ও মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করতে হবে।

বাংলাদেশ সরকার দীর্ঘদিন ধরে রোহিঙ্গাদের নিরাপদ প্রত্যাবাসনের পক্ষে কাজ করে আসছে। তবে, শরণার্থীদের নিরাপত্তা ও অধিকার নিশ্চিত না হলে এ প্রক্রিয়া সফল হবে না বলে মনে করছেন মানবাধিকার কর্মীরা। তবে, বাংলাদেশ সরকার আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহায়তায় মিয়ানমারের ওপর চাপ অব্যাহত রেখে চলেছে, যাতে করে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়।

রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের দেশে প্রত্যাবর্তন বিষয়ে নতুন এ ঘোষণা একদিকে যেমন কূটনৈতিক অগ্রগতি হিসেবে দেখা হচ্ছে, অন্যদিকে রোহিঙ্গা শিবিরে তৈরি হয়েছে উদ্বেগ ও আতঙ্কের এক নতুন অধ্যায়। ‘নাগরিকত্ব ছাড়া ফিরি কেমনে? আবার যদি সেনারা ধরে নিয়ে যায়, আবার যদি ঘর পুড়ে, বাচ্চা খুন হয়?’- চোখে পানি নিয়ে বলছিলেন ৩৫ বছরের রোহিঙ্গা নারী হালিমা খাতুন। তিনি ২০১৭ সালে রাখাইন থেকে পালিয়ে এসে আশ্রয় নিয়েছেন কক্সবাজারের কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পে, সম্প্রতি মোবাইল ফোনে ভিউজ বাংলাদেশকে কথাগুলো বলেন তিনি।

রোহিঙ্গারা দাবি করছেন, তারা মিয়ানমারে ফিরে যেতে চান; কিন্তু সেটি হতে হবে সম্মানজনক ও নিরাপদ প্রত্যাবাসনের মাধ্যমে। অর্থাৎ, তারা চান পূর্ণ নাগরিকত্ব, নিরাপত্তার গ্যারান্টি, জমি ও সম্পত্তির অধিকার ফেরত পাওয়া, স্বাধীন চলাফেরার অধিকার, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা। কক্সবাজারের কুতুপালং এবং বালুখালী ক্যাম্পের কথা হয় কয়েকজন রোহিঙ্গা নাগরিকের সঙ্গে। তাদের প্রত্যেকেই প্রত্যাবাসনের বিষয়ে দ্বিধান্বিত।

মুহিবুল্লাহ (২২) বলেন, ‘আমি রাখাইনে বড় হইছি; কিন্তু এখন যদি নাগরিকই না হই, আবার যদি ID (পরিচয়পত্র) না দেয়, তাইলে আমি কার দেশে যামু?’ নূর সানা (৪৫) নামের এক মাঝবয়সী রোহিঙ্গা বলেন, ‘আমাগো খুন্দিয়া দিছে, গেরামে আগুন দিছে, মাইয়াগো ধর্ষণ করছে। এখন কয় ফিরায় দিব- কিন্তু আবার ওরা যদি এক মাস পরে হামলা করে?’

এদিকে বাংলাদেশ সরকারও চাইছে এই সমস্যার স্থায়ী সমাধান। বাংলাদেশ চায় রোহিঙ্গাদের সম্মানজনক প্রত্যাবাসন। তবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলছে, এ ব্যাপারে আন্তর্জাতিক চাপ দরকার। রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার ভলকার তুর্ক বলছেন, ‘মিয়ানমার সরকার এখনো নাগরিকত্ব আইন সংস্কার করেনি। রোহিঙ্গারা এখনো বৈষম্যের শিকার। ফলে এই অবস্থায় তাদের প্রত্যাবর্তন প্রক্রিয়া সুষ্ঠু হবে না বলে মনে করেন তিনি।

মিয়ানমারে ১৯৮২ সালে যে নাগরিকত্ব আইন প্রণয়ন হয়, তাতে রোহিঙ্গাদের বৈধ জাতি হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। ফলে তারা রাষ্ট্রবিহীন অবস্থায় জীবন কাটাতে বাধ্য হয়েছে। রোহিঙ্গা তরুণ মোহাম্মদ হারুন বলেন, ‘আমরা চাই, মিয়ানমার সরকার আমাদের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দিক। আমরা রোহিঙ্গা। এ পরিচয় লুকিয়ে রাখা যাবে না।’

মিয়ানমার সরকার যদি তাদের ন্যাশনাল ভেরিফিকেশন কার্ড বা এনসিভি দেয়, তবে কি তিনি দেশে ফিরবেন, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এনসিভি মানে আমরা বিদেশি। আমরা তা মানি না।’ নারীদের মধ্যে দেশে ফেরা নিয়ে আতঙ্ক আরও প্রবল। মোহসিনা খাতুন (৩২) বলেন, ‘আমার শ্বশুর-শাশুড়ি মিয়ানমারে নিহত হইছে। আমি চাই আমার ছেলে যেন এমন জীবন না পায়। নাগরিক হইয়া, স্কুলে গিয়া, ডাক্তার হইতে পারে।’

রোহিঙ্গা তরুণদের মধ্যে হতাশা ও উদ্বেগ দুই-ই রয়েছে। বিশেষত, যারা কক্সবাজারে জন্মেছে বা শৈশবে এসেছে- তারা নিজ দেশ সম্পর্কে তেমন কিছুই জানে না। রাশেদ (১৮) বলেন, ‘আমার জন্ম ক্যাম্পে। আমি জানি না আমার বাড়ি কোথায়। যদি ফিরতে হয়, আমি সেখানে মানিয়ে নিতে পারব তো?' অনেক রোহিঙ্গা চান তৃতীয় দেশে পুনর্বাসনের সুযোগ; কিন্তু আন্তর্জাতিক রাজনীতির জটিলতায় তা কার্যকর করা সম্ভব হয়নি। তবে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার কর্মীরা মনে করছেন, রোহিঙ্গা সংকটের স্থায়ী সমাধান সম্ভব যদি মিয়ানমার রাজনৈতিকভাবে স্থিতিশীল হয়; কিন্তু সেখানে বর্তমানে গৃহযুদ্ধ চলছে।

এদিকে ভাসানচরে স্থানান্তরিত রোহিঙ্গাদের একটি অংশ দেশে ফিরতে চায়। রহিম উল্লাহ, যিনি ২০২১ সালে ভাসানচরে যান, বলেন, ‘এখানে ভালোই আছি; কিন্তু আমরা সম্মানের সঙ্গে রাখাইনে ফিরতে চাই।’ প্রত্যাবাসনের ইস্যু এখন শুধু দ্বিপক্ষীয় নয়, এটি আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির বড় ফ্যাক্টর। চীন, ভারত ও অন্যান্য শক্তিধর দেশগুলোর ভূমিকাও এখানে গুরুত্বপূর্ণ।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন বাধ্যতামূলক হলে হবে না। হতে হবে স্বেচ্ছায়, নিরাপদ ও মর্যাদার সঙ্গে। পূর্ণ নাগরিকত্ব, নিরাপত্তা এবং মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা না থাকলে তারা মিয়ানমারে ফিরে গেলে ফের অমানবিকতার শিকার হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তারা বলেন, এই সংকটের স্থায়ী সমাধান কেবল তখনই সম্ভব, যখন মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে, সমান অধিকার নিশ্চিত করবে।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ