Views Bangladesh

Views Bangladesh Logo

সমাজ-রাষ্ট্রের মর্মমূল থেকে দুর্নীতি দূর করুন

Editorial  Desk

সম্পাদকীয় ডেস্ক

বৃহস্পতিবার, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪

দুর্নীতি শব্দটা প্রথম ব্যবহার করেন দার্শনিক এরিস্টটল। পরে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক মরিস শব্দটির ব্যাখ্যা দেন এভাবে, দুর্নীতি হলো ব্যক্তিগত স্বার্থের জন্য অবৈধভাবে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার ব্যবহার। বলা যায় রাষ্ট্রের উৎপত্তি যখন থেকে, দুর্নীতিরও উৎপত্তি তখন থেকেই। যুগে যুগে, শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বিভিন্ন জাতি-রাষ্ট্রে বিভিন্ন রকম দুর্নীতি হয়েছে। দুর্নীতির নানারকম সামাজিক-রাজনৈতিক-দার্শনিক-ধার্মিক সংজ্ঞা, অর্থ আছে। শব্দটি আজ আর কারও কাছেই অপরিচিত নয়। বাংলাদেশের একটা স্কুলপড়ুয়া শিশুও হয়তো জানে দুর্নীতি কত প্রকার ও কী কী?

কারণ আমাদের সমাজ-রাষ্ট্র আজ এতটাই দুর্নীতিগ্রস্ত। দুর্নীতির মাত্রা বিশ্বের যেসব দেশে সবচেয়ে বেশি, আন্তর্জাতিক সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের ধারণাসূচকে, তার মধ্যে ২০২৩ সালে বাংলাদেশের স্থান দশম। দুর্নীতিতে বাংলাদেশ কয়েকবার চ্যম্পিয়নও হয়েছে। ২০২৩ সালে দশম স্থান অধিকার করলেও গর্বের কিছু নাই। আপাত অর্থে দুর্নীতি কিছুটা কমেছে বলে মনে হলেও এখনো সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছেয়ে আছে ঘনকালো দুর্নীতির জাল।

বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দুর্নীতি একেবারে সমাজ-রাষ্ট্রের কণ্ঠনালি চেপে ধরেছিল, যার ফলে দেখা গেছে দুর্নীতি দমন কমিশন পর্যন্ত দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়েছিল। গণঅভ্যুত্থানের পর প্রকাশ্য দুর্নীতি অনেকটাই কমেছে; কিন্তু তার ফলে যা হয়েছে, কাজের গতিও সঙ্গে সঙ্গে অনেক কমে গেছে। গতকাল বুধবার (২৫ ডিসেম্বর) সংবাদমাধ্যমে প্রাপ্ত খবরে জানা যায়, জুলাই-আগস্টের পর প্রকাশ্যে দুর্নীতি কমার পাশাপাশি কাজের গতিও কমেছে বলে মন্তব্য করেছেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. হোসেন জিল্লুর রহমান। তিনি বলেছেন, আমাদের জনপ্রশাসনে ঘাটতি আছে। সার্বিকভাবে পুরো সিস্টেম ব্রোকার সিস্টেমে (দালাল প্রথায়) আটকে আছে।

তার মানে দুর্নীতি ছাড়া যে এ রাষ্ট্রে আর কাজ হবার নয়। এমনই দূষিত হয়ে গেছে আমাদের জনপ্রশাসন। মঙ্গলবার রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজের (সিজিএস) উদ্যোগে গণতান্ত্রিক পুনর্গঠনের জন্য আয়োজিত ধারাবাহিক সংলাপে জনপ্রশাসনবিষয়ক আলোচনায় তিনি আরও বলেন, একটি পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষার ওপর বাংলাদেশ দাঁড়িয়ে আছে। তাই বড় আঙ্গিকে সংস্কার প্রয়োজন।

এখন সবাই সংস্কার সংস্কার করছেন; কিন্তু সংস্কার কোথায় হবে, কীভাবে হবে এ নিয়ে এখনো কোনো পরিষ্কার ধারণা জনগণ পায়নি। ৬টি সংস্কার কমিশন তাদের মতো করে কাজ করছেন; কিন্তু জাতির যে মূল্যবোধ দূষিত হয়ে গেছে, তাকে পরিশুদ্ধ করবে কে? কী দিয়ে করবে? তা কি শুধু সংস্কার দিয়েই সম্ভব?

এ কথা অবশ্যই সত্য যে, রাজনৈতিক প্রভাব ও আইনশৃঙ্খলার অভাবেই বেশির ভাগ দুর্নীতি হয়; কিন্তু একটা জাতির মানুষের তো কিছু আদর্শ- মূল্যবোধ থাকে, সেই নীতিবোধ কোথায় আমাদের দেশের? সুযোগ পেলেই একটা প্রশাসন দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে যাবে, আর সুযোগ না থাকলে কাজ করবে না এ কেমন কথা? এটাকে ঠিক কীভাবে মেনে নেয়া সম্ভব? কোন সমাজতাত্ত্বিক গবেষণায় একে ব্যাখ্যা করা সম্ভব? সরকার বিতাড়িত হয়েছে তার সঙ্গে সঙ্গে অনেক আমলাও বিতাড়িত হয়েছে, এমনটি আর কোনো দেশে ঘটে!

আমরা দেখেছি, দেশ স্বাধীনের পর থেকেই আমাদের আমলারা ব্যাপক হারে দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন। বিগত আওয়ামী লীগের সময় তা বহুলাংশে বেড়েছে। এখন নানারকম সংস্কার হচ্ছে আমরা তাকে সাধুবাদ জানাই; কিন্তু সমাজ-রাষ্ট্রের মর্মমূলে যে ব্যাপক দুর্নীতি ছেয়ে আছে তাকে দূর করতে আমাদের নীতিবোধেরও উন্নতি জরুরি। আর তার জন্য দরকার দেশপ্রেম, মানবপ্রেম।

এ কথা সত্য, চোরে না শোনে ধর্মের কাহিনি, তাই আইন-আদালতও দরকার। বিচারব্যবস্থা শক্তিশালী করা দরকার। আর এ কথাও সত্য, অনেক দুর্নীতি হয় মূলত প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনারই কারণে। তাই জনপ্রশাসনে সুব্যবস্থাপনাও দরকার, যা পদ্ধতিগতভাবেই দুর্নীতি কমাবে। তার জন্য বিকেন্দ্রীকরণ ও জবাবদিহির বিকল্প নেই। দীর্ঘদিন ধরে আমাদের জনপ্রশাসনের বিকেন্দ্রীকরণের কথা শোনা গেলেও কার্যত তেমন কোনো নজির বিগত সময়ে দেখা যায়নি।

আমরা চাই বর্তমান সরকার সংস্কার কমিশনগুলোর মাধ্যমে বিকেন্দ্রীকরণে ভূমিকা রাখুক। পরে সরকারে যারাই আসুক তারাও যেন দুর্নীতি দমনেই সর্বোচ্চ মনোযোগ দেয়। দুর্নীতি আমাদের সমাজের এত গভীরে ঢুকে গেছে যে, অল্প সময়ে তার হাত থেকে হয়তো নিস্তার পাওয়া যাবে না। তাই কথার কথা বলে মিথ্যে প্রতিশ্রুতি না দিয়ে সমাজ-রাষ্ট্র থেকে দুর্নীতি দূর করতে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করুন।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ