স্বাধীনতার ৫৪ বছরেও প্রতিষ্ঠা হয়নি প্রত্যাশিত আইনের শাসন
বহু মানুষের আত্মত্যাগ ও রক্তের বিনিময়ে ১৯৭১ সালে অর্জিত হয়েছে আমাদের স্বাধীনতা। দেখতে দেখতে পার হয়েছে ৫৪ বছর। প্রতি বছরের মতো এবারও যথাযোগ্য মর্যাদায় ২৬ মার্চ পালিত হচ্ছে মহান স্বাধীনতা দিবস। অথচ এই ৫৪ বছরেও দেশে প্রতিষ্ঠিত হয়নি কাঙ্ক্ষিত আইনের শাসন। হবেই বা কীভাবে? যে দেশে বিচার বিভাগই আক্ষরিক অর্থে স্বাধীন হতে পারেনি, সে দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা কীভাবে সম্ভব? এমন প্রশ্ন আইনজ্ঞদেরই। তাদের মতে, এখনো এদেশে ক্ষমতাবান ও বিত্তশালীরা অপরাধ করে পার পেয়ে যান। আর সাধারণ মানুষের জীবন কাটে চরম নিরাপত্তাহীনতায়। যার প্রভাব পড়ছে পুরো রাষ্ট্রে। স্বাধীন হওয়ার পর ৫৪ বছরে কখনোই মানুষ পায়নি পূর্ণাঙ্গ বাকস্বাধীনতা। জনগণের নৈতিকতা ও মূল্যবোধের অবক্ষয় ঘটেছে আশঙ্কাজনকভাবে। শক্তিশালী আইনের শাসনের অভাবে দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা, অরাজকতা, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, হত্যা, গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যা, মব জাস্টিস, শিশু ধর্ষণ, গণধর্ষণ, ঘুষ, অপহরণ, অর্থ আত্মসাৎ ও অর্থ পাচারের মতো ঘটনা দিন দিন বেড়েই চলছে।
১৯৯৯ সালে ঐতিহাসিক মাজদার হোসেন মামলার রায়ের পরও পুরোপুরি স্বাধীন হতে পারেনি দেশের বিচার বিভাগ। এখনো নির্বাহী বিভাগ থেকে পুরোপুরি আলাদা হতে পারেনি বিচার বিভাগ। বিচার বিভাগে বিশেষ করে বিচারিক আদালতে সরকারের হস্তক্ষেপ কোনো সরকারের আমলেই বন্ধ হয়নি। সুপ্রিম কোর্ট ও দেশের সব বিচারিক আদালতে বর্তমানে ৪২ লাখেরও বেশি মামলার স্তূপ। যা এখন বিচার বিভাগের গলার কাঁটা। অন্যদিকে বিচার বিভাগ সম্পূর্ণ স্বাধীন হতে না পারার কারণে খর্ব হচ্ছে জনগণের সাংবিধানিক অধিকারও।
আইনজ্ঞ ও মানবাধিকার বিশেষজ্ঞদের মতে, সংবিধানের ২৬-৪৩ অনুচ্ছেদে অসামঞ্জস্যপূর্ণ আইন বাতিল, সমতা, আইনের আশ্রয় লাভ, জীবন ও ব্যক্তিস্বাধীনতা, গ্রেপ্তার ও আটক সম্পর্কে রক্ষাকবচ, সম্পত্তির অধিকারসহ ১৮টি মৌলিক অধিকারের বিষয় নিশ্চিত করা হয়েছে। কোনোভাবে এর লঙ্ঘন হলে ৪৪ এবং ১০২ অনুচ্ছেদের অধীনে আদালতের মাধ্যমে মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করার সুযোগ রয়েছে। অথচ স্বাধীনতার ৫৪ বছর পর বাংলাদেশে গণতন্ত্র এবং আইনের শাসনের যে প্রাতিষ্ঠানিক আকৃতি থাকার প্রত্যাশা ছিল তা অর্জিত হয়নি। কারণ হিসেবে তারা উল্লেখ করেন যারা আইন প্রয়োগ এবং যারা আইন প্রণয়ন করেন তারাই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আইন ভাঙেন। এর জন্য তাদের বিচার বা শাস্তি তো দূরের কথা জবাবদিহিতা নেই বললেই চলে। আবার বিরোধী দলে থাকা অবস্থায় দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত হয়ে ক্ষমতায় গেলে সে অভিযোগ নিমিশেই শেষ হয়ে যায়। বৃদ্ধাঙুলি দেখানো হয় আইনের শাসনকে। আবার যারা ক্ষমতার বাইরে থাকেন তাদের বিরুদ্ধে করা হয় আইনের অতি প্রয়োগ। যতটুকু অন্যায় তাদের থাকে তার থেকে বেশি শাস্তি ও অপমানের বন্দবস্ত করা হয়।
এদিকে, সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়- আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় প্রথম ধাক্কাটি আসে স্বাধীনতার ঠিক পরপরই। ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনকে ‘কালো আইন’ বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। অথচ ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর সুযোগ ছিল এর থেকে বেরিয়ে আসা; কিন্তু এর পর যত শামরিক ও গণতান্ত্রিক সরকার রাষ্ট্র ক্ষমতায় এসেছে তারা কেউই জনগণের স্বার্থে ও দেশে সত্যিকারের আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য ওই কালো আইন বাতিল করেনি। বরং সব সরকারই তাদের স্বার্থে এই আইন ব্যবহার করেছেন। তার মানে হচ্ছে এই ইস্যুতে সব সরকারই একমত! এছাড়া ১৯৭৫ থেকে ১৯৯০ পর্যন্ত দেশে সামরিক কর্তাব্যক্তিদের নিয়ন্ত্রণেই ছিল রাষ্ট্র। ওই সময় আইনের শাসন ঝাপসা হয় বারুদের ধোঁয়ায়। এ সময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে সপরিবারে হত্যা, জাতীয় চার নেতাকে কারাগারে বিনা বিচারে গুলি করে হত্যা, প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকে হত্যা, নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানে নূর হোসেন ও ডা. মিলনসহ বিপুলসংখ্যক মানুষকে হত্যাসহ বহু সামরিক ও বেসামরিক মানুষকে হত্যা করা হয়। এর মধ্যে ১৯৭৫ সালে ২৬ সেপ্টেম্বর জারি করা হয় ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স। যার মাধ্যমে বন্ধ হয়ে যায় বেশ কিছু হত্যার বিচার।
এর পর ১৯৯১ সালে দেশে আবার সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পায়। ক্ষমতায় আসে বিএনপি। তবে বিচারহীনতার সংস্কৃতি মোটেই দমেনি। বহাল থাকে ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বিরোধী দলের সর্বাত্মক বয়কট ও প্রতিরোধের মুখে প্রায় ভোটারবিহীন ও সন্ত্রাসপূর্ণ এক পরিবেশে একদলীয় প্রহসনের নির্বাচন করে বিএনপি। যদিও তা বেশি দিন টেকেনি। ১৯৯৬ সালের ১২ জুন সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে জয় পায় আওয়ামী লীগ। এই আমলে ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স বাতিল করে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার করা হয়; কিন্তু গুম, খুন ও অরাজকতা মোটেই কমেনি। ২০০১ সালে ক্ষমতায় আসে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকার। এসেই ২০০২ সালে শুরু করে অপারেশন ক্লিনহার্ট। এটি ছিল বাংলাদেশের সেনাবাহিনী, বাংলাদেশ নৌবাহিনী, বাংলাদেশ রাইফেলস, বাংলাদেশ পুলিশ এবং বাংলাদেশ আনসার সদস্যদের দ্বারা যৌথভাবে পরিচালিত একটি অপরাধবিরোধী অভিযান। শুরু হয় ক্রসফায়ারের নামে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড। তৎকালীন বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবরের মাধ্যমে জানা যায়, অপারেশন ক্লিনহার্ট চলাকালে ১২ হাজার ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। যাদের বিচার নিয়ে উঠেছিল প্রশ্ন।
২০০৪ সালে তৎকালীন সরকার গঠন করে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)। এই বাহিনীর বিরুদ্ধেও আসতে থাকে একের পর বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ। এরপর রক্তক্ষয়ী আন্দোলনের মাধ্যমে চারদলীয় সরকারের বিদায়ের পর ২০০৭ সালে ১১ জানুয়ারি রাষ্ট্রক্ষমতায় বসেন ফখরুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার। এ সময় বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতৃবৃন্দসহ অনেককেই বিচার করা হয় বিশেষ জজ আদালতে। দেয়া হয় শাস্তিও। যদিও এই আদালতকে অনেকেই ‘ক্যাঙ্গারু কোর্ট’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। এরপর ২০০৮ সালের নির্বাচনে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ সরকার। বিচার শুরু হয় যুদ্ধাপরাধের। আইনের শাসন এবার বোধহয় প্রতিষ্ঠিত হবে, এমন আশায় বুক বাঁধে দেশবাসী; কিন্তু হতাশ হতেও সময় লাগেনি। যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়েও ওঠে প্রশ্ন। আন্দোলনের মুখে পাল্টে যায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন। শুরু হয় বিরোধী মতের বিরুদ্ধে দমন-পীড়ন। এরপর ২০১৪, ২০১৮ ও সব শেষ ২০২৪ সালের বিতর্কিত নির্বাচন করে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার আইন ও নির্বাচন ব্যবস্থাকেই নষ্ট করে দেন। আর এই সময়ে অরাজকতা, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, হত্যা, গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যা, ধর্ষণ, গণধর্ষণ, ঘুষ, অপহরণ, শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি, অর্থ আত্মসাৎ ও অর্থ পাচারের মতো ঘটনা ঘটতে থাকে।
এরপর কোটা আন্দোলন থেকে শুরু ছাত্র-জনাতার তীব্র আন্দোলনের মুখে গত বছরের ৫ আগস্ট দেশ ত্যাগ করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী। ক্ষমতায় আসেন ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। তারা এসেও পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে নিতে পারেননি আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি। রাজনৈতিক প্রতিহিংসা, গায়েবি মামলা, অরাজকতা, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, হত্যা, গুম, ছিনতাই, ডাকাতি, জ্বালাও-পোড়াও, ভাঙচুর, বিচারবহির্ভূত হত্যা, মব জাস্টিস, শিশু ধর্ষণ, গণধর্ষণের মতো ঘটনা এখনো ঘটেই চলছে। বতর্মান সরকার আরও কঠোর হস্তক্ষেপে এসব দমন করে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠাই এখন সবার প্রত্যাশা।
এ ব্যাপারে সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, ‘স্বাধীনতার পর থেকে এখন পর্যন্ত দেশে প্রকৃত আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা হয়নি। ক্ষমতা ও টাকা যার আছে তার বিচার হয় না। দেশে আইন প্রয়োগ হয় সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রে। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডও বন্ধ হয়নি। প্রতিষ্ঠা হয়নি স্বাধীন বিচার বিভাগও। কোনো দেশে আইনের শাসন সুপ্রতিষ্ঠিত না হলে সে দেশ কখনো স্থিতিশিল হবে না।’
সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ আহসানুল কমির ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, ‘দেশে যে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়নি তা বোঝা যায়- দেশে বিচারবহির্ভূত হত্যা, মব জাস্টিস, শিশু ধর্ষণ, গণধর্ষণ, ডাকাতি ও অর্থ পাচারের মতো ঘটনা ঘটেই চলছে। এটা দেশের জন্য খুবই হতাশার।’
মানবাধিকার নেত্রী ফাওজিয়া করিম ফিরোজ ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, ‘বিচারালয়ে বিচার চললেই দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বলা যাবে না। আইনের শাসন মানে জনহীতকর আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা হওয়া। জনগণের জন্য ক্ষতিকর কোনো আইন চাপিয়ে দিয়ে দেশ চালালে তাকে আইনের শাসন না বলে আইনের দুঃশাসন বলা যায়।’
সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ও মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট মনজিল মোরসেদ ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, ‘দেশে এখনো বিচারের বাণী নিভৃতে কাঁদে। সাধারণ মানুষের জন্য সুশাসন ও আইনের শাসন এখনো প্রতিষ্ঠিত হয়নি। স্বাধীনতার ৫৪ বছর পর বাংলাদেশে গণতন্ত্র এবং আইনের শাসনের যে প্রাতিষ্ঠানিক আকৃতি থাকার প্রত্যাশা ছিল তা অর্জিত হয়নি। যারা আইন প্রয়োগ ও প্রণয়ন করেন তারাই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আইন ভাঙেন। এর জন্য তাদের বিচার বা শাস্তি তো দূরের কথা জবাবদিহিতা নেই বললেই চলে। আবার বিরোধী দলে থাকা অবস্থায় দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত হয়ে ক্ষমতায় গেলে সে অভিযোগ নিমিশেই শেষ হয়ে যায়। বৃদ্ধাঙুলি দেখানো হয় আইনের শাসনকে। প্রত্যাশিত আইনের শাসন থাকলে এমনটা হতো না।’
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে