গ্রামে উন্নয়নের হাওয়া ও বৈষম্যের ফাঁদ!
গ্রামীণ অর্থনীতিতে অনেক দিন ধরেই এক ধরনের নীরব রূপান্তর ঘটছে। আমরা যদি লক্ষ্য করি, তাহলে দেখব, জিডিপিতে কৃষি খাতের অবদান ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছে, অন্তত জিডিপি উৎপাদনের দিক থেকে তা সত্য। জিডিপিতে কৃষি খাতের বর্তমান অবদান কেউ বলছেন মাত্র ১৪ শতাংশ। আবার কেউ বলছেন সর্বোচ্চ ১৮ শতাংশ। জিডিপিতে কৃষি খাতের বর্তমান অবদান কত শতাংশ সেই বিতর্কে না গিয়েও আমরা নিশ্চিতভাবেই বলতে পারি, কৃষি খাতের অবদান কমছে।
এক সময় আমাদের দেশের জিডিপিতে কৃষি খাতের অবদান ছিল প্রায় ৫০ শতাংশের মতো। গ্রামীণ কৃষি অর্থনীতিতে বিপুল পরিমাণ আপেক্ষিক অগ্রগতি কমে গেলো কেন? তাতে কি সামগ্রিকভাবে কৃষি উৎপাদন কমে গেল? তা তো নয়। সাম্প্রতিক সময়ে মোট কৃষি উৎপাদন বেড়েছে ঠিকই তবে তা হয়তো বেড়েছে প্রতি বছর ৩ থেকে ৪ শতাংশ হারে; কিন্তু প্রতি বছর সার্বিকভাবে জিডিপি প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৬ থেকে ৭ শতাংশ হারে তাই স্বাভাবিকভাবেই কৃষির আপেক্ষিক গুরুত্ব কমে গেছে; কিন্তু কর্মসংস্থান সৃষ্টির দিক থেকে কৃষি এখনো সর্বোচ্চ গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে রয়েছে। কেউ কেউ বলেন, কৃষি খাতে কর্মসংস্থানের হার মোট কর্মে নিয়োজিতদের ৪০ শতাংশ। আবার কেউ বলেন, এটা ৫০ শতাংশের কাছাকাছি। তবে কর্মসংস্থানের মাপকাঠিতে হয়তো এখনো সেবা বা শিল্প পৃথক পৃথকভাবে কারও গুরুত্বই কৃষিকে অতিক্রম করতে পারেনি। তবে গ্রামীণ অর্থনীতির চেহারা ও কাঠামো দ্রুত অকৃষির চরিত্র ধারণ করছে, তা সকলেই বর্তমানে স্বীকার করেন। গ্রাম আজ আর কৃষিপ্রধান গ্রাম নয়।
সাম্প্রতিক সময়ে গ্রামীণ অর্থনীতির একটি বড় পরিবর্তন হচ্ছে এটাই যে গ্রামে যেসব লোক কৃষি খাতে সবসময় জুড়েই কর্মসংস্থান করত তাদের অনেকেই এখন আর কৃষিতে সর্বদা কর্মসংস্থান করছে না। তারা নানা অকৃষি খাতে ধীরে ধীরে চলে যাচ্ছে। অকৃষি খাতে স্থানান্তরের মাধ্যমে কিছু লোক হয়তো একদম শহরে চলে আসছে। কেউ বা গ্রামেই কৃষি বহির্ভূত কোনো কাজে নিয়োজিত হচ্ছে। একটি অংশ আবার বেশি অর্থের আশায় বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে। স্থানান্তরের মাধ্যমে এই যে বিভিন্ন স্থানে/খাতে যাচ্ছে গ্রামীণ মানুষ তাদের পরিবার কিন্তু বেশির ভাগ সময় বা পরবর্তী কিছু সময় গ্রামেই থেকে যাচ্ছে। যারা গ্রাম থেকে কর্মসংস্থানের জন্য শহরে আসছে অথবা বিদেশি যাচ্ছে তাদের পরিবার আগের মতোই হয়তো গ্রামেই থেকে যাচ্ছে। অর্থাৎ গ্রামের সঙ্গে তাদের বিদ্যমান নাড়ির সম্পর্ক আগের মতোই বহাল থাকছে-হয়তো কিছু দুর্বল হয়েছে। শহরে বা গ্রামে যারা বিভিন্ন ধরনের ছোটখাটো কাজ করতেন তারাও অনেক সময় ভালো মজুরি পাবার আশায় এক গ্রাম/শহর থেকে অন্য শহরে/গ্রামে গমন করেন। অনেকেই গ্রাম থেকে শহরে এসে সাময়িকভাবে রিকশা চালায় অথবা অন্য কোনো কাজ করেন; কিন্তু তাদের পরিবার গ্রামের বাড়িতেই থাকেন।
এখন প্রশ্ন হলো, যারা গ্রাম থেকে শহরে অথবা অন্য কোনো অকৃষি খাতে স্থানান্তরিত হচ্ছেন কিন্তু তাদের পরিবার গ্রামেই থেকে যাচ্ছে তাদের আন্তঃসম্পর্ক কেমন হচ্ছে? পর্যবেক্ষণ করে দেখা যাচ্ছে, যারা গ্রামে রয়ে যাচ্ছেন এবং যারা গ্রাম ছেড়ে শহরে অথবা গ্রামেই অকৃষি খাতে স্থানান্তরিত হচ্ছেন তাদের মধ্যে সম্পদ অর্জনের ক্ষেত্রে এক ধরনের বৈষম্য সৃষ্টি হচ্ছে। যারা অকৃষি খাতে যাচ্ছেন গ্রামে অথবা শহরে তাদের আয়-উপার্জন যারা গ্রামীণ অর্থনীতিতে পরিপূর্ণভাবে বা শুধু কৃষির সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকছেন তাদের চেয়ে বেশি। ফলে গ্রামের মানুষের মধ্যে অকৃষি খাতে স্থানান্তরের আগ্রহ বা প্রবণতা ক্রমেই বাড়ছে। যেহেতু গ্রাম থেকে যারা শহরে এসে অথবা গ্রামে থেকেই অকৃষি খাতেই নিজেদের সম্পৃক্ত করছেন তাদের আয় এবং সম্পদ দুটোই বেশি, সে জন্য কেউই পূর্ণ কৃষক আর থাকতে চাচ্ছেন না। আর এ কারণেই গ্রামীণ অর্থনীতিতে শহরের বা অকৃষি খাতের সঙ্গে যুক্তদের আধিপত্যই বেশি।
খাঁটি কৃষক, যারা সরাসরি কৃষি উৎপাদনের সঙ্গে যুক্ত গ্রামীণ অর্থনীতিতে তাদের আধিপত্য এখন আর নেই। গ্রামে কৃষি উৎপাদনের সঙ্গে যারা সরাসরি সম্পৃক্তরা ক্রমেই প্রান্তিক জনগোষ্ঠীতে পরিণত হচ্ছেন। এককভাবে যারা শুধু ফসল উৎপদেনের সঙ্গে জড়িত তাদের অবস্থা এখন আর আগের মতো নেই। তবে যারা ফসল উৎপাদনের সঙ্গে সঙ্গে অকৃষি তাতে নিজেদের যুক্ত করতে পারছেন তাদের অবস্থা তুলনামূলকভাবে কিছুটা ভালো। যারা কৃষিতে বহুমুখীকরণ করতে পারছেন অথবা কৃষির পরিপূরক অন্যান্য নানা ধরনের কাজ করতে পারছেন অথবা পরিবারের কিছু সদস্যকে সম্পূর্ণ বা আংশিক অকৃষি খাতে পাঠিয়ে দিতে পারছে সেই পরিবারগুলোর হাতে কাঁচা টাকা জমা হচ্ছে। আর সংগত কারণেই এরা গ্রামীণ সমাজে অর্থনৈতিক ক্ষমতাও অর্জন করছে।
যারা স্থানান্তরের মাধ্যমে গ্রাম থেকে শহরে চলে যাচ্ছেন তারা কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই একান্ত প্রয়োজন না হলে গ্রামে থাকা তাদের জমিটা বিক্রি করছেন না। আমাদের দেশের কেউই একান্ত অপারগ না হলে জমি বিক্রি করতে চান না। কারণ পৈতৃক ভিটার প্রতি মানুষের আবেগের সম্পর্ক জড়িত। আরো একটি কারণ এখানে কাজ করে তাহলো, আমাদের দেশে জনগণের মাথাপিছু জমির পরিমাণ খুবই কম। তাই জমির চাহিদা ক্রমেই বাড়ছে। আগামীতে জমির মূল্য তাই শুধু বাড়তেই থাকবে। এমন এক সময় আসতে পারে যখন উচ্চমূল্য দিয়েও জমি সহজে পাওয়া যাবে না। আমাদের দেশে একটি কথা প্রচলিত আছে, ‘দলিল এবং দখলি স্বত্ব ঠিক থাকলে জমিতে বিনিয়োগ করে কখনোই লোকসান হয় না। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে জমির দাম যেভাবে বেড়েছে অন্য কোনো পণ্যের মূল্য সেভাবে বৃদ্ধি পায়নি। যারা গ্রামীণ কৃষি ব্যবস্থা থেকে নানা অকৃষি খাতে সরে আসছেন তারাও গ্রামে থাকা তাদের জমি বিক্রি না করে যারা সরাসরি কৃষি উৎপাদনের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন তাদের দিয়ে দিচ্ছে বর্গাচাষ করার জন্য অথবা চুক্তিভিত্তিক চাষের জন্য। জমিকে ভবিষ্যৎ মূল্যবান সম্পদ হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। অনুপস্থিত জমির মালিকদের জমি ব্যবহারের অধিকার পেয়ে যাচ্ছেন তারা যারা সরাসরি কৃষিতে ফসল উৎপাদনের সঙ্গে যুক্ত।
কিন্তু তারা কোনোভাবেই জমির মালিকানা পাচ্ছেন না। কারণ জমির মালিক সরাসরি কৃষিতে যুক্ত না থাকলের জমির মালিকানা হারাতে রাজি নন। গ্রামীণ অর্থনীতি বা সমাজ ব্যবস্থায় এখন ভূমিহীন মানুষের হার ৬০ শতাংশের মতো। অনুপস্থিত ভূমির মালিকরা তাদের জমি নানা প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সরাসরি কৃষি উৎপাদনের সঙ্গে যুক্তদের ব্যবহারের অনুমতি দেবার কারণে এসব ভূমিহীন কৃষকের জন্য তাদের আর্থিক অবস্থার উন্নয়নের অন্তত কিছুটা উল্টোভাবে সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। তাদের আর্থিক অবস্থা উন্নয়নের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে মূলত দুই অর্থে। কারণ আবাদি জমির অভাবটা এখন আর তাদের থাকছে না, ভূমিহীন হওয়া সত্ত্বেও! শ্রম ও কৃষি খাতে যাদের দক্ষতা এবং জীবিকার প্রয়োজনে যাদের বর্ধিত জমির চাহিদা রয়েছে তারা জমি চুক্তিতে ভাড়া নিতে পারছেন।
আবার যারা কৃষি থেকে অকৃষি খাতে চলে যাচ্ছেন, বিশেষ করে শহরে অভিবাসন করছেন তাদের জমি রক্ষণাবেক্ষণ এবং বাড়তি কিছু আয়ের জন্য তারা ভূমিহীন পরিবারকে জমি দিয়ে দিচ্ছে ‘সন জমা’ চুক্তির ভিত্তিতে। এভাবে জমির সাময়িক ব্যবহারের জন্য হলেও ভূমিহীনদের হাতে জমি যাচ্ছে যদিও মালিকানা আগের মতোই বিত্তবানদের হাতেই থেকে যাচ্ছে। এটা অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ বিবেচনায় ব্যবহারিক বণ্টনের দিক থেকে ভালো এটা স্বীকার করতেই হবে। উৎপাদনের দিক থেকেও এটা ভালো কারণ জমি গ্রহীতারা প্রাণপণ শ্রম দিয়ে জমিটাতে সর্বোচ্চ উৎপাদন নিশ্চিত করে থাকেন। গ্রামীণ অর্থনীতিতে অতীতে জমি মালিকানায় যে জমিদার বা বড় জোতদার সৃষ্ট অসমতা, মেরুকরন বা ভারসাম্যহীনতার সৃষ্টি হচ্ছিল এই ব্যবস্থার মাধ্যমে তা কিছুটা কমে আসছে। গ্রামে এন্টারপ্রেনার কৃষকদের নতুন অভ্যুদয় হচ্ছে।
আরেক দিকে দরিদ্ররা যারা অকৃষি খাতে চলে যাচ্ছেন অথবা কর্মসংস্থানকল্পে বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছেন তারা অপেক্ষাকৃত ভালো উপার্জন করছেন। গ্রামে কেউ জমি বিক্রি করলে তারা কেউ কেউ সেই জমি কিনেও নিচ্ছেন অথবা নিজের বাসগৃহকে আধুনিকায়ন করছেন। বাজার অর্থনীতিতে গ্রামের অতি ধনীরা অনেকেই আবার গ্রামের আবাদি জমিটুকু বিক্রি করে সেই টাকা দিয়ে শহরে কিছু সম্পদ ক্রয় করে রাখছেন। তারা এটা খুব ভালো করেই জানেন শহরের জমির উপযোগিতা এবং মূল্য সবচেয়ে বেশি দ্রুত বৃদ্ধি পাবে। সামগ্রিকভাবে আমি বলব, আগে গ্রামীণ অর্থনীতি এবং সমাজ ব্যবস্থায় একটি প্রবণতা ছিল তাহলো গরিব আরও গরিব হবে, ধনী আরও ধনী হবে এবং গ্রাম দুই মেরুতে বিভক্ত হয়ে পরবে, এই চিরাচরিত প্রবণতা এখন আর গ্রামে এত সরলভাবে প্রত্যক্ষ করা যাচ্ছে না। যারা গ্রামীণ অর্থনীতিতে সবচেয়ে নিচের পর্যায়ে রয়েছেন তাদের আর্থিক অবস্থা উন্নয়নের একটি সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। জমির মালিকদের একাংশ কৃষি থেকে সরে আসার ফলে যে দরিদ্ররা কৃষিতে থাকছেন সেই দরিদ্র মানুষদের জন্য আর্থিক অবস্থার উন্নয়নের একটি সম্ভবনার সৃষ্টি হয়েছে। এটি গ্রামীণ অর্থনীতির একটি নতুন পরিবর্তন, যা আমাদের বিবেচনায় রাখতে হবে। সারা বিশ্বের অভিজ্ঞতা থেকে আমরা জানি, জমির মালিকানা সহজে কেউ ছেড়ে দেয় না। এটা নিয়ে কার্ল কাউস্কির একটি কথা এখানে স্মরণ করা যেতে পারে। তিনি বলেছেন, গরিব কৃষকের জমি হচ্ছে ‘নববধূর নিকট গয়নার পুঁটলির মতো’ কোনোভাবেই যা সে হাতছাড়া করতে চায় না। গরিব কৃষকের যে ক্ষুদ্র জমিটুকু হয়তো অনুৎপাদনশীল হয়ে আছে তাও সে ছাড়তে চাইবে না। যক্ষ্মের ধনের মতো কৃষক তার জমি আঁকড়ে ধরে থাকতে চায়। তাই কৃষিতে পুঁজিবাদী উৎপাদন pure and simple রূপ লাভ করছে না।
কিন্তু কৃষি এখন বাণিজ্যিক পণ্যে পরিণত হয়েছে। যে কোনো কৃষি উপকরণ পেতে গেলে অর্থ ব্যয় করতে হয়। কিন্তু জমির মালিক কোনো কোনো কৃষকের হাতে পর্যাপ্ত পরিমাণ অর্থ নেই। ফলে তারা সব সময় কৃষি উপকরণ ক্রয় করতে পারেন না। তবে ইদানীং তারা এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে তাদের আর্থিক চাহিদা অনেকটাই পূরণ করতে পারছেন। কৃষি উৎপাদন এখন অতিমাত্রায় পণ্য এবং বাজার নির্ভর হয়ে পড়েছে। কৃষিতে এখন বাজার ব্যবস্থা তৎপর হচ্ছে। অকৃষি খাতে হালকা মওসুমে কাজ করে নগদ টাকা বাঁচিয়ে তা ভর মৌসুমে কৃষিতে খাটাতেও দেখা যায়।
যারা গ্রাম থেকে প্রবাসে গিয়েছেন তাদের প্রেরিত রেমিটেন্স গ্রামীণ অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিনিয়োগ হচ্ছে না এমন একটি অভিযোগ প্রায়শই উত্থাপিত হতে শোনা যায়। এই অভিযোগ পুরোপুরি সত্যি নয়। কারণ যারা বিদেশ থেকে অর্থ প্রেরণ করছেন তাদের সেই অর্থ গ্রামে বাড়ি-ঘর নির্মাণসহ বিভিন্ন অবকাঠামোগত উন্নয়নে ব্যয় হচ্ছে। যারা গ্রাম থেকে কর্মসংস্থান উপলক্ষে বিদেশে যাচ্ছেন তাদের অধিকাংশই নিম্নবিত্ত পরিবার থেকে আগত। কাজেই তাদের প্রথম লক্ষ্যই থাকে তাদের বাড়িঘর মেরামত করে বসবাসের অধিকতর উপযোগী করে গড়ে তোলা। ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়ার ব্যবস্থা করাসহ পরিবারের জন্য উন্নত জীবন ধারণের সুযোগ সৃষ্টি করা। বর্তমানে গ্রামীণ অর্থনীতিতে ভূমির মালিকানা পরিবর্তনের ক্ষেত্রে প্রবাসী বাংলাদেশিদের প্রেরিত রেমিট্যান্স বিশেষ অবদান রাখছে। প্রাথমিক চাহিদা পূরণের পর প্রবাসীদের স্থানীয় সুবিধাভোগিদের অনেকেই উদ্বৃত্ত অর্থ কৃষি বহির্ভূত কাজে ব্যবহার করে আয় বর্ধনের চেষ্টা করছেন। প্রবাসী বাংলাদেশির প্রেরিত অর্থে যে জমি ক্রয় করা হচ্ছে সেই জমিটা ক্রয় করছেন যারা তারা নিজেরা চাষ না করলেও কাউকে না কাউকে তো তা চাষ করতে দিচ্ছেন। এর মাধ্যমে উৎপাদন বৃদ্ধি পাচ্ছে। কাজেই প্রবাসী বাংলাদেশিদের প্রেরিত অর্থ বিনিয়োগে আসছে না, মানব পুঁজি তৈরি করছে না বা অকৃষির জন্য প্রণোদোনা সৃষ্টি করছে না- এসব কথা ঢালাওভাবে মন্তব্য করা সম্ভবত ঠিক হবে না। জমি বাড়ে না কিন্তু জমি ছাড়া অন্যান্য পুঁজি তো বৃদ্ধি পায়। মানুষের ধর্মই হচ্ছে জমিভিত্তিক উৎপাদন ব্যবস্থায় বেশি দিন স্থায়ী না হওয়া। তারা এমন সব উৎপাদন ব্যবস্থায় নিজেদের সম্পৃক্ত করতে চান যেখানে সীমাহীন উৎপাদন ও উচ্চ মুনাফার হার এর সুযোগ তুলনামূলকভাবে বেশি।
বর্তমান সরকারের একটি বিশেষ নির্বাচনি অঙ্গীকার হচ্ছে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তোলা। সাধারণত ধারণা করা হয়, স্মার্ট বাংলাদেশের অর্থ হচ্ছে আধুনিক তথ্য-প্রযুক্তির ব্যবহার সংবলিত একটি উন্নত বাংলাদেশ গড়ে তোলা। আমাদের গ্রামীণ সমাজ ব্যবস্থা এখনো আধুনিক প্রযুক্তি জ্ঞানে সমৃদ্ধ হয়নি। আর স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তুলতে হলে গ্রামকে বাদ দিয়ে তা কখনোই সম্ভব নয়। কারণ এখনো দেশের বেশির ভাগ মানুষ গ্রামে বাস করেন। কাজেই স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তুলতে হলে প্রথমেই স্মার্ট গ্রাম তৈরি করতে হবে। গ্রামে স্কুল তৈরি করতে হবে। হাসপাতাল নির্মাণ করতে হবে। অর্থাৎ গ্রামে এমন একটি উন্নত পরিবেশ তৈরি করতে হবে যেন মানুষকে সাধারণ প্রয়োজনের জন্য শহরে আসতে না হয়। প্রতিটি গ্রামে বিদ্যুৎ যেতে হবে। মোট কথা গ্রামকে স্মার্ট করা না গেলে সামগ্রিকভাবে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তোলা কোনোভাবেই সম্ভব নয়।
বর্তমানে জাতীয় বাজেটে শহরের জন্য যে অতিরিক্ত ব্যয় বরাদ্দ রাখা হচ্ছে তা কমিয়ে এনে গ্রামের জন্য বরাদ্দ সুচিন্তিত ভাবে বাড়াতে হবে। গ্রামে যেসব ব্যাংকের শাখা রয়েছে তাতে যে আমানত সংরক্ষণ করা হয় তা গ্রামে ব্যবহার না হয়ে শহরে চলে আসছে। এতে এক ধরনের গ্রাম-শহরের অর্থনৈতিক বৈষম্য সৃষ্টি হচ্ছে। গ্রামে যদি পর্যাপ্তসংখ্যক শিল্প-কারখানা গড়ে উঠত তাহলে ঋণ ও সঞ্চয় সেখানেই ব্যবহৃত হতে পারত। এখন নানা দিক থেকে সম্পদ বা পুঁজি এসে শহরে জমা হচ্ছে। এই অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে হবে। গ্রামের পুঁজি যাতে শহরের দিকে ধাবিত না হয় এমন একটি ব্যবস্থা চালু করতে হবে। শরীরের সমস্ত রক্ত মুখে এসে জমা হলে তাকে যেমন সুস্বাস্থ্য বলা যায় না তেমনি দেশের সমস্ত পুঁজি এসে শহরে জমা হলে তাকে সত্যিকার সুষম অর্থনৈতিক উন্নয়ন বলা যাবে না। সরকারকে এমন একটি পন্থা খুঁজে বের করতে হবে যাতে উদ্বৃত্ত পুঁজি গ্রামমুখী ধাবিত হয়। এ জন্য প্রথমেই গ্রামীণ ভৌত ও সামাজিক অবকাঠামোর ব্যাপক উন্নয়ন করতে হবে।
সরকার একাধিকাবার শহরের সেবা সুবিধাগুলো গ্রামে নিয়ে যাবার কথা বলেছেন। শহরে যেসব সুবিধা পাওয়া যায় তার কিছু কিছু এখন গ্রাম পর্যন্ত সম্প্রসারিত হয়েছে। তবে এ ব্যাপারে আরও তৎপর হতে হবে। গ্রামকে যদি শহরের মতো উন্নত করা না যায় তাহলে স্মার্ট বাংলাদেশ গঠনের স্বপ্ন কোনোভাবেই পূরণ হবে না।
লেখক: অর্থনীতিবিদ ও অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
অনুলিখন: এম এ খালেক
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে