Views Bangladesh

Views Bangladesh Logo

কেতাবে আছে গ্রামীণ খেলা, মাঠে নেই

Mahbub  Sarkar

মাহবুব সরকার

সোমবার, ১৫ এপ্রিল ২০২৪

‘কাজীর গরু কেতাবে আছে, গোয়ালে নেই’- এ প্রবাদ শতভাগ খাটছে দেশের গ্রামীণ খেলাধুলার ক্ষেত্রে, যা পুস্তকে খুঁজে পাবেন, বাস্তবে অবশ্য অস্তিত্ব নেই।

২০২২ সালে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ (এনএসসি) ঘোষিত খসরা ক্রীড়ানীতির তিনটি অনুচ্ছেদে দেশের গ্রামীণ খেলাধুলার কথা উল্লেখ করা আছে। একসময়কার বহুল চর্চিত খেলাগুলো এভাবেই কিতাববন্দি; আদতে যার চর্চা নেই। নেই খেলাগুলোকে বাঁচিয়ে রাখার উদ্যোগও।
হারিয়ে যেতে বসেছে গ্রামীণ খেলাধুলা, মৃতপ্রায় এ খেলার বিভিন্ন দল। যে কারণে কানামাছি, বউচি, হা-ডু-ডু, গোল্লাছুট, ডাংগুলি, মারবেল, রশিটানা, ইচিং-বিচিং, ওপেন টু বায়স্কোপ, মল্লযুদ্ধ, লাঠিখেলা, দাড়িয়াবান্ধা, লুকোচুরি, মোরগ লড়াই, কড়ি, ধাপ্পা, কুতকুত, পুতুলের বিয়ে, চড়ুইভাতি, এলাডিং বেলাডিং, সাত চাড়া নামগুলোই বর্তমান প্রজন্মের কাছে কেমন যেন দুর্বোধ্য!

ক্রীড়া নীতির ৩০ দশমিক শূন্য অনুচ্ছেদে বলা আছে, ‘সুস্থ দেহ ও সুন্দর মনের অধিকারী সুশৃঙ্খল জাতি গঠনের স্বার্থে এবং জাতীয় ক্রীড়ায় আবহমান বাংলায় লুকায়িত ঐতিহ্যকে ফুটিয়ে তোলার লক্ষ্যে ঐতিহ্যবাহী ক্রীড়া অনুষ্ঠান ও উৎসবকে উৎসাহিত করা হবে।’ আদতে তার বাস্তবায়ন খুব একটা দেখা যাচ্ছে না।

দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, অবহেলিত এসব খেলা এখনো ব্যাপক জনপ্রিয়। দেশের আনাচে-কানাচে গ্রামীণ এসব খেলার আয়োজনকে ঘিরে এখনো উপচেপড়া ভিড় লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ২০২১ সালে নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলা প্রশাসন আয়োজিত নৌকাবাইচ যার প্রমাণ দিয়ে গেছে। সদর উপজেলার ধর্মগঞ্জ থেকে ডিক্রিরচর খেয়াঘাট পর্যন্ত ধলেশ্বরী নদীতে অনুষ্ঠিত নৌকাবাইচ দেখতে নদীর দুই পাড়ে হাজারো মানুষ ভিড় করেছেন। ইঞ্জিনচালিত নৌকা নিয়েও উৎসবে শামিল হতে দেখা গেছে উৎসুক জনতাকে। বিপুল জনপ্রিয়তার পরও এ খেলা পরে আর আয়োজিত হয়নি। কী কারণে এ আয়োজনের ধারাবাহিকতা রক্ষা করা হয়নি? উত্তর জানা নেই আয়োজকদের। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে গ্রামীণ খেলাকে বাঁচিয়ে রাখার উদ্যোগ কেন নেয়া হচ্ছে না? এ প্রশ্নেও উত্তর নেই দেশের ক্রীড়াঙ্গনের অভিভাবক সংস্থার দায়িত্বশীলদের।

এ সম্পর্কে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের ক্রীড়া বিভাগ থেকে জানানো হয়, ‘সরকারিভাবে গ্রামীণ খেলাধুলাকে বাঁচিয়ে রাখার নানা পরিকল্পনা হাতে নেয়া হয়েছে। প্রতি বাজেটে এ জন্য আলাদা অর্থও বরাদ্দ করা হয়ে থাকে।’ তারপরও কেন গ্রামীণ খেলাধুলার চর্চা নেই? কিংবা হারিয়ে যেতে বসা খেলাগুলোকে বাঁচিয়ে রাখার উদ্যোগ নেই? এ প্রশ্নের উত্তরটাও জানা নেই সংশ্লিষ্টদের।

যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণাধীন সংস্থা ক্রীড়া পরিদপ্তরেও উপেক্ষিত গ্রামীণ খেলাধুলা। সংস্থাটি ঘোষিত ২০২৩-২৪ মৌসুমের ক্রীড়াপঞ্জির কোথাও স্থান হয়নি গ্রামীণ খেলাধুলার। বরং ৮ পৃষ্ঠার ক্রীড়াপঞ্জিতে ৪১টি ক্রীড়া ইভেন্ট আয়োজনের বিশদ উল্লেখ করা আছে। সেখানে একটিও গ্রামীণ খেলা আয়োজনের উদ্যোগ নেই। পরিদপ্তরের অধীন সংস্থা জেলা ক্রীড়া অফিসের মাধ্যমে গ্রামীণ খেলার আয়োজন করতে পারে। পরিদপ্তরের ভিশনেও কিন্তু সেটা বলা আছে, ‘তৃণমূল পর্যায়ে ক্রীড়ার সম্প্রসারণের মাধ্যমে তরুণ প্রজন্মকে ক্রীড়ায় উদ্বুদ্ধকরণ এবং ব্যাপকভাবে ক্রীড়া চর্চার মাধ্যমে দক্ষ মানবসম্পদে রূপান্তর।’

একটা সময় ঘটা করেই গ্রামীণ খেলাধুলার আয়োজন করে আসছিল বাংলাদেশ অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশন (বিওএ)। ২০০৮ সালে রংপুরে বিভাগীয় আয়োজন দেখতে ঢাকা বিভিন্ন গণমাধ্যমের ২৫-৩০ সংবাদকর্মী গিয়েছিলেন। মনোমুগ্ধকর সে আয়োজন দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল এ প্রতিবেদকেরও। সে আয়োজন দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন বিওএর তৎকালীন কর্তাব্যক্তিরাও। প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন গ্রামীণ খেলাধুলা চর্চার এ উদ্যোগটা ধারাবাহিকভাবেই চলবে; কিন্তু সে ধারাবাহিকতা রক্ষা হয়নি।

যে খেলাগুলো একসময় জীবনের অংশ ছিল; সেগুলো এখন কালে-ভদ্রে বিশেষ উপলক্ষে আয়োজিত হয়। ২০২৩ সালে ধানমন্ডি সোসাইটি বিজয় মেলার অংশ হিসেবে আয়োজন করেছিল গ্রামীণ খেলার। বিশেষ দিবস উদযাপনের অংশ হিসেবে নৌকাবাইচ, কাবাডি, হা-ডু-ডু, লাঠিখেলা এবং বলি খেলার মতো আয়োজন চোখে পড়ে। সেগুলো সীমিত পরিসরে।

জনপ্রিয় কিছু গ্রামীণ খেলা:

এক্কাদোক্কা: এটি মেয়েদের মধ্যে খেলা হয়। মাটির পাত্রের ছোট টুকরো দিয়ে মাটিতে কোর্ট কেটে খেলতে হয়। এটি আয়তক্ষেত্রাকার বা গোলাকার সমতল ভূমিতে খেলা হয়।

গোল্লাছুট: এ খেলায় দৌড়াদৌড়ি ও ছোটাছুটির বড় জায়গার প্রয়োজন হয়। সমানসংখ্যক সদস্যের দুই দলের মধ্যে এ খেলা অনুষ্ঠিত হয়। খেলোয়াড়ের সংখ্যা ৪ থেকে ৬ কিংবা ৮ থেকে ১০ জন পর্যন্ত হতে পারে।

ডাংগুলি: এই খেলার দুটি উপকরণ হলো- একটি দেড় থেকে দুই ফুট লম্বা লাঠি (ডাং)-অপরটি গুলি, যা প্রায় দুই ইঞ্চি লম্বা ছোট লাঠি। যার দুই প্রান্ত থাকে কিছুটা সুচালো। দুই থেকে পাঁচ-ছয়জন করে দুই দলে বিভক্ত হয়ে এটি খেলা যায়। ছোট গর্ত ওপর গুলি রেখে ডান্ডা মেরে সেটিকে দূরে ফেলার চেষ্টা করে। প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়রা চারদিকে দাঁড়িয়ে থেকে সেটি লুফে নেয়ার চেষ্টা করে। লুফে নেয়ার প্রচেষ্টা সফল হলে ওই খেলোয়াড় আউট।

ইচিং-বিচিং: কেবল বাংলাদেশ নয়, ভারত উপমহাদেশের একটি জনপ্রিয় গ্রামীণ খেলা ছিল এটি। সাধারণত এই খেলার জন্য সবুজ মাঠ ব্যবহার করা হয়। উচ্চতা অতিক্রম এই খেলার প্রধান বৈশিষ্ট্য। দুজন খেলোয়াড় পাশাপাশি বসে খেলোয়াড়দের অতিক্রম করার জন্য উচ্চতা নির্মাণ করে। ক্রমেই সে উচ্চতা বাড়িয়ে অতিক্রমের কাজটা কঠিন করে তোলা হয়।

ওপেন টু বায়স্কোপ: দুই দলের নেতা ফুল কিংবা ফলের নামে নিজেদের দলের নামকরণ করে থাকে। মুখোমুখি দাঁড়িয়ে দুহাত দিয়ে একটি তোরণ নির্মাণ করা হয়। অংশগ্রহণকারীরা পরস্পরের কাঁধে হাত রেখে রেলগাড়ির মতো ছড়া বলতে বলতে তোরণের নিচ দিয়ে যাতায়াত করে। ছড়া শেষে যে খেলোয়াড় তোড়নের মধ্যে বন্দি হয়; তাকে জিজ্ঞাসা করা হয়- সে কোন দলে যোগ দেবে। সে পছন্দের দলে যোগ দেয়। এভাবে দল গঠনের পর মূল খেলা শুরু হয়।

কড়ি খেলা: চারটি কড়ি মসৃণ স্থানে হাত থেকে গড়িয়ে দিয়ে জোড়ায় জোড়ায় টোকা দিয়ে আঘাত করে পয়েন্ট সংগ্রহ করা হয়। আঘাত করতে ব্যর্থ হলে বা কড়ি একসঙ্গে লেগে থাকলে ওই খেলোয়াড়ের দান নষ্ট হয়। তখন অন্যজন খেলা শুরু করে।

কানামাছি: কাপড় দিয়ে একজন খেলোয়াড়ের চোখ বেঁধে দেয়া হয়। ওই অবস্থায় সতীর্থদের ধরার চেষ্টা করতে হয়। যার চোখ বাঁধা হয়, সে হয় কানা। অন্যরা মাছি। মাছিরা চারদিক ঘিরে ছড়া বলতে বলতে কানার গায়ে টোকা দেয়। চোখ বাঁধা অবস্থায় সে অন্যদের ধরার চেষ্টা করে। কানা কাউকে ধরে নাম বলতে পারলে ধৃত খেলোয়াড়কে কানা সাজতে হয়।

লাঠি খেলা: এটি ঐতিহ্যগত মার্শাল আর্ট। এ খেলার খেলোয়াড়কে লাঠিয়াল বলা হয়। এ খেলায় ব্যবহৃত লাঠি সাড়ে চার থেকে পাঁচ ফুট লম্বা এবং তৈলাক্ত হয়। প্রত্যেক খেলোয়াড় নিজ নিজ লাঠি দিয়ে নানা কসরত প্রদর্শন করে।

কুতকুত: প্রথমে মাটিতে ৭-৮টি ঘর আঁকা হয়। যার শেষ মাথায় অর্ধচন্দ্রাকৃতির একটি ঘর বানানো হয়। প্রথম ঘরে গুটি ফেলে এক পা শূন্যে রেখে দম দিতে দিতে গুটিকে সব ঘর অতিক্রম করাতে হয়। অর্ধচন্দ্রাকৃতির ঘরে এনে পা নামিয়ে দম ফেলা যায়। তার পর এ ঘর থেকে গুটিকে পা দিয়ে আঘাত করে সব ঘর অতিক্রমের চেষ্টা করা হয়।

ষাঁড়ের লড়াই: দুটি ষাঁড় গরুকে পরস্পরের সঙ্গে লড়াইয়ের জন্য ছেড়ে দেওয়া হয়। উপস্থিত দর্শকরা ঢাক-ঢোল পিটিয়ে ও বিভিন্ন তালে তালে গান করতে থাকে। এদিকে দুটি ষাঁড় লড়াইয়ে জেতার জন্য একে অপরকে আঘাত করে যায়। জয়ী ষাঁড়ের গলায় পুরস্কার বেঁধে হাট-বাজার ও এলাকায় দেখানো হতো।

বউচি: ৮ থেকে ১০ জন নিয়ে গড়া দুটি দল এ খেলায় অংশগ্রহণ করে। ২০-২৫ ফুট দূরত্বে মাটিতে দাগ কেটে দুটি ঘর তৈরি করতে হয়। যে দল প্রথমে খেলার সুযোগ পায়, তাদের একজনকে বউ নির্বাচন করা হয়। দুটি ঘরের একটি হয় বড়। যেখানে বউ ছাড়া সব খেলোয়াড় থাকে। ছোট ঘরে থাকে বউ। খেলার হার-জিত নির্ভর করে বউয়ের বিচক্ষণতার ওপর। বউকে তার ঘর থেকে বড় ঘরে ছুটে আসতে হয়। বউ ঘরের বাইরে আসার পর বিপক্ষ দলের কেউ তাকে ছুঁয়ে দিলে এক পক্ষের খেলা শেষ।

দাড়িয়াবান্ধা: খেলার মাঠ ৫০ ফুট লম্বা ও ২০ ফুট প্রস্থের হয়ে থাকে। মাঝখানে সমান্তরাল ৫০ ফুট লম্বা ও ১ ফুট চওড়া একটি লাইন থাকবে। মাঠে আড়াআড়ি চারটি লাইনে সমগ্র কোর্ট ১০টি খোপে বিভক্ত থাকবে। আড়াআড়ি ৬ লাইন ১ ফুট চওড়া হয়ে থাকে। প্রতি দলে ৬ জন করে খেলোয়াড় থাকে। টসের মাধ্যমে আক্রমণকারী ও প্রতিরক্ষাকারী নির্বাচন করা হয়। ২৫ মিনিট খেলার পর ৫ মিনিট বিশ্রাম; পুনরায় ২৫ মিনিট খেলা চলে। এক ফুট চওড়া লাইনের মধ্যে থেকে খেলোয়াড়কে ফাঁকি দিয়ে প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়রা এক ঘর থেকে আরেক ঘরে যাওয়ার চেষ্টা করেন।

নৌকাবাইচ: নদীতে নৌকা চালনার প্রতিযোগিতা এটি। একদল মাঝি নিয়ে একটি দল গঠিত হয়। অনেক দলের মধ্যে নৌকা চালনা প্রতিযোগিতা হয়। যে নৌকা সবার আগে ফিনিশিং লাইনে পৌঁছাবে, সেটি বিজয়ী হবে।

হা-ডু-ডু: ৮-১০ জনের সমন্বয়ে গড়া দুটি দলের মধ্যে হয়ে থাকে এ খেলা। একদল নির্দিষ্ট কোর্টের মধ্যে অবস্থান করবে। অপর দলের একজন ওই কোর্টে রেইড দিতে আসেন। রেইডার কোর্টের মধ্যে থাকা প্রতিপক্ষের কোনো খেলোয়াড়কে ছুঁয়ে নিজের কোর্টে ফিরে যেতে পারলে পয়েন্ট পাবেন। অন্যদিকে রেইডারকে যদি ডিফেন্ডাররা ধরে রাখতে পারেন, তবে তারাও পয়েন্ট পাবেন। গ্রামে-গঞ্জে এ খেলার নিয়মে ভিন্নতা আছে। জাতীয় পর্যায়ে অবশ্য আন্তর্জাতিক নিয়ম মেনেই এ খেলা হয়ে থাকে। যার নাম কাবাডি। এটি বাংলাদেশের জাতীয় খেলা।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ